হরমুজ প্রণালী নিয়ে উত্তেজনার বর্তমান পরিস্থিতি 1 min read
Reading Time: 4 minutesযুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক বরাবরই তিক্ত। তাদের এ সম্পর্কের অনলে সব সময় সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘি ঢেলে এসেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে তার সূত্রপাতও সাম্প্রতিককালের কিছু ইস্যু নিয়ে।
২০১৫ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ‘ইরান পারমাণবিক চুক্তি’তে সই করেছিল। কিন্তু রক্ষণশীল ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই চুক্তি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সে চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র যে শুধু চুক্তি থেকে সরে আসে তাই নয়, পাশাপাশি ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল সেসবই পুনরায় বহালের ঘোষণা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং নতুন করে আরও কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
ট্রাম্পের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসাটা সমর্থন দেননি ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ। তারা ট্রাম্পকে তার সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য আহবান জানান। কিন্তু ট্রাম্প তার সিদ্ধান্তে অটল। বরং তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ইরানের কাছ থেকে তেল না কেনার জন্য উল্টো আহবান জানান। তার দাবি ছিল, ২০১৯ সালের ৪ নভেম্বরের পর থেকে ইরানের কাছ থেকে সব দেশ যেন তেল কেনা বন্ধ করে দেয়।
ইরানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই ভয়ংকর অবরোধ কি আর ইরান এমনি এমনি মেনে নিবে? ইরানও খুব কৌশলগত উপায়ে এর পাল্টা জবাব দিল। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির পক্ষ থেকে হরমুজ জলপ্রণালীটি বন্ধের আভাস পাওয়া যায়। তাঁর বক্তব্য হলো, “আমেরিকা দাবি করছে, তারা ইরানের তেল রপ্তানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে চায়। তারা এই দাবির অর্থ বুঝতে পারছে না। কারণ এই অঞ্চলের তেল রপ্তানি চালু থাকবে, আর ইরানেরটা বন্ধ থাকবে, এর কোন মানে হয় না।” তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে, হয় সবাই মিলে এই প্রণালীটি ব্যবহার করবে, নয়তো কেউ করতে পারবে না।
হরমুজ প্রণালীটি কৌশলগতভাবে খুবই গুরত্বপূর্ণ। এটি পারস্য উপসাগর এবং উমান উপসাগরকে পৃথককারী একটি জলপ্রণালী। পৃথিবীর মোট তেল মজুদের প্রায় ২০ শতাংশ এবং প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের প্রায় ২৫ শতাংশ এই প্রণালীর মধ্য দিয়ে আসে। আবার পারস্য উপসাগর থেকে মুক্ত সাগরে পৌঁছানোর জন্য এটাই একমাত্র জলপথ। শুধু ইরানই নয়, এই প্রণালীটির ওপর সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, ইরাক প্রভৃতি দেশও তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানীর জন্য ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাই এটা খুব সহজেই অনুমেয় যে, হরমুজ জলপ্রণালীতে যেকোন ধরণের জটিলতা গোটা মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানী হুমকির মুখে পড়বে।
পণ্যের সরবরাহ যদি কম থাকে তাহলে তার দাম তো বাড়বেই। তেলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। যদি হরমুজ প্রণালীতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়, তাহলে এশিয়ার বড় বড় তেল আমদানিকারক দেশ যেমন— চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এসব দেশে তেলের দাম বেড়ে যাবে। ফলে সমগ্র এশিয়াজুড়ে তেলের বাজারে প্রচন্ড অস্থিরতা তৈরি হবে। ইউরোপ আমেরিকার অনেক বড় বড় দেশেও তেলের বাজারে উত্তাপ ছড়াবে। যুক্তরাজ্যের চেম্বার অব শিপিংয়ের প্রধান ডেভিড বালস্টন জানান যে, যুক্তরাজ্যের মোট তেলের পাঁচ শতাংশ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের তেরো শতাংশ আসে হরমুজ প্রণালী দিয়ে। যদি এ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে যুক্তরাজ্যের তেল ও গ্যাসের দাম যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।
কিছুদিন ধরে ইরানকে নিয়ে যে উত্তেজনা চলছে তার সূত্রপাত হয়েছিল মে মাসের মাঝামাঝি। গত মে মাসের ১২ তারিখে ওমান উপসাগরের ফুজাইরাহ নামক উপকূলে ৪টি তেলের ট্যাংকার ভয়ংকর হামলার সম্মুখীন হয়। চারটি ট্যাংকারের মধ্যে সৌদি আরবের ২টি, আরব আমিরাতের ১টি এবং নরওয়ের ১টি ট্যাংকার ছিল।
সৌদি আরব দাবি করেছে যে, এই নাশকতার পেছনে ইয়েমেন এবং ইরানের হাত আছে। কারণ কয়েকদিন ধরেই সৌদি আরব কর্তৃক ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠীর উপর আক্রমণকে নিয়ে ইরানের সাথে সৌদির মতবিরোধ চলছিল। তাই এটি হতে পারে তারই প্রতিশোধ। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গিত করছিল, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান নজরে আনার জন্য খুব জোরেসোরে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করল। পারস্য উপসাগরে শক্তিবৃদ্ধির জন্য মে মাসের ১০ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ইউএস আব্রাহাম লিংকন বিমান বাহক স্ট্রাইক গ্রুপ, বি-৫২ বোম্বার এবং একটি অ্যান্টিমিসাইল ব্যাটারি পাঠায়।
উত্তেজনা যখন তুঙ্গে তখন ওমান উপসাগরে আবার হামলার ঘটনা ঘটে। অনেকটা সঙ্গত কারণেই সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে দোষারোপ করেছে। কিন্তু ইরান এ অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে। উপরন্তু ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এ হামলার নিন্দা জানিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর তদন্তের আহবান জানান।
১২ মে এর হামলার তদন্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে এক বিশেষ টিম গঠন করা হয়। তারা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে নমুনা নিয়ে রাসায়নিক বিশ্লেষণ ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। পরীক্ষার পর তারা বলেন যে, কিছু শামুক আকৃতির বিস্ফোরক (Limpet mine) আছে যেগুলোকে জাহাজের গায়ে লাগিয়ে এ ভয়ানক বিস্ফোরণটি ঘটানো হয়েছিল।
এ হামলার ঠিক এক মাস পর (১৩ জুন) ওমান উপসাগরে আবারও একই ধরনের হামলা আরও দুটি ট্যাংকারে ঘটে। এবার জাপানের একটি ও নরওয়ের একটি ট্যাংকার আক্রমণের শিকার হয়। নরওয়ে ও সৌদি আরবের দাবি, এ হামলাগুলো অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন। জাহাজে আটকে পড়া নাবিকদের মার্কিন ও ইরানি সামরিক বাহিনী রক্ষা করে। গবেষণার পর জানা গেল, এবারও আগের হামলায় যে বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়েছিল এবারও তা-ই। যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় হামলার দায়টাও ইরানের ঘাড়েই চাপাল। এবার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জার্মানও সুর মিলিয়ে ইরানকে দায়ী করল। জার্মানের মত, ইরানের এ হামলায় সম্পৃক্ততার ব্যাপারে নাকি পাকাপোক্ত প্রমাণ রয়েছে। ইরান বরাবরই তার সম্পৃক্ততা নাকচ করে এসেছে। ইরান সেসব দেশকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে যেন ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে আর অশান্তি না করে।
উত্তেজনা যেন শেষ হতেই চায় না। এক সপ্তাহ পর জুন মাসের ২০ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের একটি চালকবিহীন গুপ্তচর ড্রোনকে ভূপাতিত করে ইরান। কিন্তু কোন জায়গায় ভূপাতিত করা হয়েছে তা অপ্রকাশিত। ইরানের দাবি ড্রোনটি ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশ করায় সেটিকে ভূপাতিত করতে বাধ্য করা হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে সেটি আন্তর্জাতিক আকাশসীমার মধ্যেই ছিল। এ ঘটনার পরপরই আমেরিকা ইরানে সামরিক হামলার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিক কি কারণে সে হামলা বাতিল করা হয় তা স্পষ্ট নয়।
খুব হাস্যকর হলেও সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্র নাকি গত ১৯ জুলাই হরমুজ প্রণালীতেই ইরানের একটি ড্রোনকে ভূপাতিত করেছে। কিন্তু ইরান বলছে, তাদের ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার কোন ঘটনাই ঘটে নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র নিজেরাই নিজেদের ড্রোন ভূপাতিত করে ইরানের কথা বলে প্রচার করছে।
সবকিছু মিলিয়ে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে বর্তমানে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। যদি এ অবস্থা চলতে থাকে তাহলে উপসাগরের আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে বড় ধরণের জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। ট্রাম্প ইরানের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু না হটলে পরিস্থিতির আরও তীব্র অবনতি ঘটত বলে অনেকে মনে করছেন। এদিকে ইরান হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তার উপর থেকে সব ধরণের নিষেধাজ্ঞা বাতিল না করে তাহলে ইরান পারমাণবিক চুক্তি লঙ্ঘন করে পুনরায় পারমাণবিক শক্তি সঞ্চয় করবে।
মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়া বাকি দেশগুলো ইরানের সাথে কোন রকম সংঘাতে যেতে চায় না। তাই এদিক থেকে ইরানের বাহুবল বেশ শক্ত। সেজন্যই ইরানের তেল রপ্তানিতে কোন ধরনের জটিলতার সৃষ্টি সমগ্র বিশ্বের তেল বাণিজ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।