বাণিজ্য বিস্তারে সাগরপথের গুরুত্ব ঠিক একদিন দুইদিনের ব্যাপার নয়। সভ্যতার আদিকেন্দ্র মিশরের নীলনদ, মেসোপোটেমিয়ার টাইগ্রিস–ইউফ্রেতিস, ভারতের সিন্ধু কিংবা ভাস্কো–দা–গামার দেখানো পথে ভারত আগমন, সুয়েজ খাল খনন… বিশ্বের বাণিজ্য বলতে আমরা যা বুঝি তার বিশাল অংশ জুড়ে আছে জলপথ। আরেকটু স্পষ্টভাবে বললে সাগরপথ।
জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সংক্রান্ত কনভেনশন অনুযায়ী বিশ্বের প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রই নিজেদের তটরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রের মালিকানা রাখে। বিশ্ব রাজনীতির অনেক কিছুই নির্ধারিত হতে পারে এই ১২ নটিক্যাল মাইলের সীমা পরিসীমার মাঝেই। ঠিক যেমনটি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের জন্য। বিশ্বরাজনীতিতে চাপে পড়লেই ইরান তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে এই হরমুজ প্রণালীকে।
হরমুজ প্রণালী কি?
হরমুজ প্রণালী মূলত একটি সরু জলপথ যা পশ্চিমের পারস্য উপসাগরকে পূর্বে ওমান উপসাগর ও আরব সাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে এবং আরব উপদ্বীপ থেকে ইরানকে পৃথক করেছে। ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রণালীটি পারস্য উপসাগরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ওমান ও ইরানকে সংযুক্ত করেছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় তেল রপ্তানি করা হয় হরমুজ প্রণালীর মাধ্যমে। এই সমুদ্র পথে আরব দেশগুলো থেকে তেল যায় এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অন্যান্য জায়গায়। বিশেষ করে অশোধিত তেলের জন্য এই পথটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
হরমুজ প্রণালীর একদিকে আছে আরব দেশগুলো। যার বেশিরভাগই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ। আর অন্যপাশে অবস্থান করছে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে মার্কিনীদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ইরান।
হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সংকীর্ণ যে অংশ সেখানে ইরান এবং ওমানের দূরত্ব মাত্র ২১ মাইল। এই প্রণালীতে জাহাজ চলাচলের জন্য দুটো লেন রয়েছে এবং প্রতিটি লেন দুই মাইল প্রশস্ত। তবে বিষ্ময়কর হলেও সত্য তেল পরিবহনের জন্য নিয়োজিত সবচেয়ে বড় আকারের জাহাজও এই দুই মাইলের মধ্য দিয়ে চলাচল করতে সক্ষম।
কেন এই প্রণালী ঘিরে এত উত্তেজনা?
হরমুজ প্রণালী সংকীর্ণ হতে পারে। কিন্তু জ্বালানী তেল বহনের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ চলাচল করার জন্য হরমুজ প্রণালী যথেষ্ট গভীর এবং চওড়া। হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশটি ১৯ কিলোমিটার বা ২১ মাইল প্রশস্ত৷
যেহেতু শীর্ষ পাঁচ তেল রপ্তানিকারক দেশের অবস্থান আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে, সেহেতু হরমুজ প্রণালী থেকে তেল পরিবহনের পরিমাণ ক্রমশই বাড়ছে৷ বলা হয়ে থাকে যে কালো সোনা বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র পথ হচ্ছে এটি৷
সমুদ্রপথে বিশ্বের যে পরিমাণ তেল পরিবহণ করা হয়, তার এক তৃতীয়াংশই এই প্রণালী ব্যবহার করে পরিবহণ করা হয়৷ আর বিশ্বের অন্যতম বড় তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) উৎপাদক কাতার এই গ্যাসের প্রায় পুরোটাই হরমুজ প্রণালী দিয়ে বর্হিবিশ্বে রপ্তানি করে৷
বিশ্ব অর্থনীতি যতদিন তেলের উপর নির্ভরশীল থাকবে, ততদিন এই প্রণালী থেকে তেল পরিবহনে কিছুটা বা অল্পসময়ের জন্য বিঘ্ন ঘটলেও তেলের বাজারে সেটির নাটকীয় প্রভাব পড়তে বাধ্য৷ কেননা এতে কুয়েত, বাহরাইন, ইরাক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে৷ আর সৌদি আরব তখন শুধুমাত্র লোহিত সাগরে থাকা সমুদ্রবন্দর থেকে তেল রপ্তানি করতে বাধ্য হবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি হয় ইরান নিয়ন্ত্রিত হরমুজ প্রণালী দিয়ে। এই প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন এক কোটি ৯০ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি হয়। মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসন কর্তৃপক্ষের মতে, ২০০৯ সালে সমুদ্রপথে তেল বাণিজ্যের ৩৩ শতাংশ হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে এবং ২০০৮ সালে হয়েছিল ৪০ শতাংশ। ২য় স্থানে রয়েছে মালাক্কা প্রণালী। যা দিয়ে দৈনিক জ্বালানী তেল রপ্তানি হয় এক কোটি ৬০ লাখ ব্যারেল এবং সুয়েজ খাল দিয়ে প্রতিদিন ৫৫ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি হয়।
স্বাভাবিকভাবেই হরমুজ প্রণালী ইরানের জ্বালানী তেল রপ্তানির প্রধান রুট। ইরানের মোট রপ্তানি আয়ের দুই–তৃতীয়াংশ আসে জ্বালানী তেল রপ্তানির মাধ্যমে। ২০১৭ সালে ইরান ৬৬০০ কোটি ডলারের তেল রপ্তানি করেছে। যার প্রায় পুরোটাই এই পথেই রপ্তানি করা হয়েছে। ইরান প্রতিদিন ২২ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল তেল রফতানি করে থাকে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইরান কি বৈধভাবে এই প্রণালী পথ বন্ধ করতে পারবে?
১৯৮২ সালে স্বাক্ষরিত সমুদ্র আইন সম্পর্কিত কনভেনশন অনুযায়ী একটি দেশের তটরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল অবধি সেই দেশের সমুদ্রসীমা হিসেবে বিবেচিত হয়। ইরান সরকার ১৯৮২ সালে তাতে স্বাক্ষর করলেও সেটি কখনোই সেদেশের সংসদে অনুমোদিত হয়নি৷ এক্ষেত্রে হরমুজ প্রণালী বন্ধে আইনের মারপ্যাঁচে ইরান নিজেদের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে পারে।
কিন্তু এই পানিপথটি ব্যবহারে বাধা দিয়ে ইরান তাঁর প্রতিবেশি দেশ এবং শত্রুর ক্ষতি করলেও নিজেরাও বেশ বিপদে পড়ে যাবে। কারণ তখন ইরানও অন্য দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকা হরমুজ প্রণালীর অংশ ব্যবহার করতে পারবে না।
এখন প্রশ্ন বারবার হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়া ইরান কি চাইবে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙের মত ঝুকিপূর্ণ কাজে নামতে?
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ
আরও পড়ুন- মিশরের ঐতিহাসিক সুয়েজ খাল
আরও পড়ুন- পানামা খাল: বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট