‘একেক অডিশনে দাঁড়াবার আগেই শুনতাম এই চরিত্রের জন্য নাকি আমি আনফিট। দেখতে ভালো নই, নায়কী চাল নেই। কত যে বাদ পড়েছি!’
‘ সেই ফিল্ম এজেন্সিতে অনেকবার কল করার পর তারা জানালো, তারা নাকি শুধু তারকাদের সাথেই কাজ করে। আমাকে স্রেফ রাস্তা মাপতে বলল!’
‘ প্রচুর… প্রচুর… অডিশন দিয়েছি। তারা বলেছেও বেশ ভালো। কিন্তু শেষমেশ বাদ। কেন? তারা কিছুই জানায় না। হতে পারে আমার কণ্ঠ মানাচ্ছে না, বা চুলের স্টাইল বদলাতে হবে। কিন্তু তারা কিছুই বলে না। স্রেফ বাদ।‘
‘দেখুন, আমি ১০০ বারের মতো অডিশন দিয়েছি। এরপর রোল মিলেছে। কাজ করেছি। শেষ পর্যন্ত কিন্তু পরিশ্রম আর মেধারই জয় হলো।‘
উপরের চার বক্তব্যের বক্তা যথাক্রমে কার্তিক আরিয়ান, আয়ুষ্মান খুরানা, নুসরাত ভারুচা এবং রাজকুমার রাও। বর্তমান সময়ে চারজনই বলিউডের ভীষণ ব্যস্ত তারকা। তরুণদের তো বটেই, আমজনতারও ক্রেজও এরা। কিন্তু আজকের অবস্থানে আসতে সবাইকেই বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
নেপোটিজম রন্ধ্রে রন্ধ্রে
অমিতাভ বচ্চন ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ তে বারবার অডিশন দিয়েও বাদ পড়েছিলেন। শাহরুখ খান বহু অডিশন থেকে বাদ পরার পড়ে টিভি সিরিয়ালে কাজ করে উঠে এসেছেন। নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি ‘সারফারোশ’ এ ছোট চরিত্র পেয়েছিলেন সেই নব্বইয়ের দশকে। এরপর বহু ঘাম ফেলে আজকের অবস্থানে আসা। নায়কসুলভ চেহারা নয়, একারণে প্রতিষ্ঠিত নায়িকার তদবিরে বাদ পড়েছেন রাজকুমার রাও। রোল দেবার কথা বলে বিদ্যা বালানের বেডরুম অব্দি আসতে চেয়েছিলেন এক পরিচালক।
প্রতি মাসেই মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান হাজার তরুণ। বছরের পর বছর অভিনয়-নাচ শিখেও এন্ট্রি পাওয়াটা কঠিন হয়ে যায় বলিউডের স্বপ্নরাজ্যে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাদ পড়ার অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেছেন অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী। কিন্তু আরেকদিকে ঠিকই ‘স্টারকিড’রা বিনা শ্রমে বিগ বাজেটের ছবি পেয়ে যান। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচা করে ঝকঝকে ছবির প্রচারও হয় প্রচুর। অথচ উল্টা পিঠের মুম্বাইয়ে স্ট্রাগলারদের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা।
স্বজনপ্রীতির ফসল
অমিতাভ-জয়া বচ্চনের সুযোগ্য পুত্র হিসেবে বলিউডে অভিষেকের অভিষেকটাও ছিল দশাসই। ২০০০ সালে জে পি দত্তের ‘রিফিউজি’ তে সাথে ছিল আরেক তারকা পরিবারের কন্যা- কারিনা কাপুর। বক্স অফিসে সাড়া ফেলতে পারেনি কারো পারফরম্যান্সই। এত বছর বাদে কারিনা নিজেকে ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করাতে পারলেও অভিষেকের ঝুলিতে হিটের সংখ্যা কমই। ধুম ফ্র্যাঞ্চাইজি,যুবা, সরকার, ব্লাফমাস্টার, গুরু বাদে খুব একটা সাফল্য নেই তার। আবার এগুলো হিটের পেছনে অভিষেকের চাইতে জন, ঋত্বিক, বিবেক, রিতেশ, অমিতাভ বা আমিরের অবদানটাই বেশি।
তবে শুধু অভিষেকই নয়- নেপোটিজমের চালে আরও বহু তারকা সন্তান পা রেখেছে বলিউডে। যেমন- সেলিম খানের তিন ছেলে –সালমান, সোহেল, আরবাজ, কাপুর খানদানের কারিনা, কারিশমা, রণবীর, রাকেশ রোশন তনয় ঋত্বিক রোশন, তনুজা কন্যা কাজল-তানিশা, অনিল কাপুর কন্যা সোনম ও পুত্র হর্ষবর্ধন কাপুর, সুনীল শেঠি তনয়া আথিয়া শেঠি, বনি কাপুর পুত্র অর্জুন কাপুর ও কন্যা জাহ্নবী কাপুর, শর্মিলা ঠাকুর-নবাব পতৌদি পুত্র সাইফ আলী খান- সোহা আলী খান, যশ চোপড়া পুত্র উদয় চোপড়া, ডিম্পল কাপাডিয়া কন্যা টুইংকেল খান্না- রিংকি খান্না, শত্রুঘ্ন-পুনম সিনহার কন্যা সোনাক্ষি সিনহা, মহেশ ভাট কন্যা আলিয়া ও পূজা ভাট এবং তাদের কাজিন এমরান হাশমি, জ্যাকি শ্রফ পুত্র টাইগার শ্রফ,
গোবিন্দ তনয়া নর্মদা, রাজ বাব্বর-স্মিতা পাতিল পুত্র প্রতীক বাব্বর, কন্যা জুনি বাব্বর, ধর্মেন্দ্র পুত্র সানি ও ববি দেওল, সানি দেওলের পুত্র করণ দেওল, ধর্মেন্দ্র-হেমা মালিনী কন্যা এশা দেওল, ডেভিড ধাওয়ান পুত্র বরুণ ধাওয়ান, ভাসু ভাগনানির ছেলে জ্যাকি ভাগনানি, সাইফ আলী খান- অমৃতা সিং কন্যা সারা আলী খান,চাংকি পাণ্ডে কন্যা অনন্যা পাণ্ডে, শক্তি কাপুর তনয়া শ্রদ্ধা কাপুর, সুরেশ ওবেরয় পুত্র বিবেক ওবেরয়, সিদ্ধার্থ রয় কাপুরের ভাতিজা আদিত্য রয় কাপুর, শিল্পা শেঠির বোন শমিতা শেঠি,আদিত্য পাঞ্চোলির ছেলে সুরাজ পাঞ্চোলি, ফিরোজ খানের ছেলে ফারদিন খান, শেখর সুমন পুত্র অধ্যয়ন সুমন, রবি ট্যান্ডনের মেয়ে রাভিনা ট্যান্ডন, আমির খানের ভাতিজা ইমরান খান, মুকেশ পরিবারের ছেলে নিল নিতিন মুকেশ, হ্যারি বাওয়েজা পুত্র হারমান বাওয়েজা, বিনোদ খান্না পুত্র অক্ষয়-রাহুল খান্না, নীলিমা আজিম-পঙ্কজ কাপুর পুত্র শহীদ কাপুর, নাসিরুদ্দিন শাহ্- রত্না পাঠক শাহ্ পুত্র ভিভান শাহ্, অনুপম খের- কিরন খের পুত্র সিকান্দার খের, মিঠুনপুত্র মহাক্ষয়, সঞ্জয় খান পুত্র জায়েদ খান, শহীদের সৎভাই ইশান খাট্টার প্রমুখ।
প্রতি বছরই এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সামনের দিনে সুনীল পুত্র আহান শেঠি, শাহরুখ কন্যা সুহানা খান এবং পুত্র আরিয়ান খানকে পর্দায় দেখার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
পারিবারিক ঐতিহ্যে বলিউড
স্বজনপ্রীতির কালিমা বহুদিন যাবতই বলিউডে বর্তমান। বেশ কিছু পরিবার বলিউডকে আপন সম্পত্তি ভাবেন বলেও অনেকে দাবি করেন। তাদের জন্যই বাইরের অভিনেতা- অভিনেত্রীরা রূপালি দুনিয়ায় আসতে হিমশিম খান- এ অভিযোগও আছে।
সেদিক দিয়ে প্রথমেই আসে বিখ্যাত ‘খান’ পরিবারের কথা। অভিনেতা, প্রযোজক সেলিম খানের ছেলে সালমান, আরবাজ, সোহেল – এই তিন খানকে কে না চেনে! অভিনয়ের বিচারে তিন ছেলেই হয়তো নিচের সারিতে আছেন। কিন্তু স্রেফ পারিবারিক দাপটের কারণেই বলিউডে শক্ত রাজত্ব চলছে তাদের। এই খান পরিবারের হাত ধরেই গত বছর অর্পিতা খানের স্বামী আয়ুশ শর্মা ফিল্মি দুনিয়ায় নাম লেখান। তবে খুব একটা সুবিধা হয়নি এই ‘লাভরাত্রি’ হিরোর।
কাপুর পরিবারকেও আধিপত্য বিস্তারের আরেক কারিগর মানা হয়। পৃথ্বীরাজ কাপুরের হাত ধরে সেই যে নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে যাত্রা শুরু হয়েছিল- তা থামেনি আজও। একে একে রাজ কাপুর, ঋষি কাপুর, রণধীর কাপুর, সানজানা কাপুর, করণ কাপুর, কুনাল কাপুর, রাজিব কাপুর,কারিনা-কারিশমা কাপুর, রণবীর কাপুর প্রমুখে টইটম্বুর হয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য। বলিউডের এন্ট্রি টিকিট পেতে পরিবারই ছিল তাদের মূল ভরসা। তবে খানদের মতো কাপুরদের যোগ্যতা নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলে নি। এদিকে আমির খান, শাহরুখ খানও নাকি তাদের পুত্র কন্যাকে ঘিরে ইন্ডাস্ট্রিতে এমন পাকা সাম্রাজ্য গড়বার কথা ভাবছেন।
মেধার জোর
পরিবারের হাত ধরে এলেও প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন অনেকেই। ফারহান আখতার, রণবীর কাপুর, আলিয়া ভাট, আমির খান, ইশান-শহীদ, প্রতীক, বিবেক,কাজল, রানী প্রমুখ নিজেদের প্রমাণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে রাজকুমার রাও Zoom Tv কে বলেন, ‘দেখুন আমার ছেলে-মেয়ে অভিনয় করতে চাইলে আমিও মানা করবো না। হয়তো সহজ হবে তখন। কিন্তু অভিনয় দক্ষতা না থাকলে সে কাজ পাবেনা। অর্থাৎ, মেধাই আগে।‘
করণ জোহর বিতর্ক
‘রেঙ্গুন’ ছবির প্রচারণার জন্য ‘কফি উইথ করণে’র সিজন পাঁচে এসেছিলেন সাইফ আলী খান ও কঙ্গনা রানাউত। সেখানেই কঙ্গনা সরাসরি করণকে ‘স্বজনপ্রীতির পতাকাবাহক’ নাম দেন। তারকা বা তাদের সন্তানেরা ছাড়া যে কেউই করণের ছবিতে সুযোগ পায়না এটা সবারই জানা কথা।
একসময় করণ ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’, ‘কাভি খুশি কাভি গাম’- এর মতো চমৎকার ছবি উপহার দিয়েছিলেন। তবে ইদানীং ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার ১’ ও ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার ২’ এর মতো একরাশ স্টারকিড নিয়ে অর্থহীন ছবি নির্মাণেই বেশি দেখা যায় তাকে। ঝা চকচকে ও গল্পহীন বাজে ছবির জন্যই এখন করণ বেশি পরিচিত।
কঙ্গনার কথার জেরেই বলিউডের অন্য তারকারা মুখ খোলেন এই প্রসঙ্গে। জিম সার্ব একবার মন্তব্য করেন, ‘বলিউডে স্বজনপ্রীতি আছে। একটা ছোট চরিত্র পাওয়ার জন্য বাইরের কেউ যখন পাঁচ বছর শ্রম দেয় সেখানে কারোর ছেলে বিনা শ্রমে মূল চরিত্রে কাস্ট হয়। ‘ইশান খাট্টার এর বিপরীতে বলেন, ‘ এমন না যে আমাদেরও অডিশন দিতে হয়নি। মাজিদ মাজিদির ‘ Beyond the clouds’ এ অডিশনের পরেই ডাক পেয়েছি।‘ তবে যে ‘ধাড়াক’ দিয়ে বলিউডে ইশান-জাহ্নবির যাত্রা শুরু সেখানে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি তাকে।
সোনম কাপুর নিজমুখেই নেপোটিজমের অস্তিত্ব স্বীকার করে বলেন, ‘ এক্ষেত্রে আমাদের চেনা জানাটা আগে থেকে হয়। আমরা জানি কোথায় গেলে, কী করতে হবে। তবে এর অসুবিধাও আছে। অনেক পরিচালক আমাদের ছোট থেকে দেখে আসছেন, তারা আমাদের ছোটই ভাবেন।‘ সারা আলী খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘হ্যাঁ, বাবা-মার সুবাদে আমি এসেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি তো তাদের বাছাই করিনি। এন্ট্রি তাদের জন্য হলেও টিকতে হবে নিজের নামেই।‘ এমরান হাশমি সরাসরি স্বীকার করেন বলিউডে আগমনের কথা, ‘ ভাট পরিবারের কেউ না হলে কখনো এই লাইনে আসাই হতো না।‘
উদয় চোপড়ার কথাই ধরা যাক। একের পর এক বাজে অভিনয় করেও ছবি পাচ্ছেন স্রেফ চোপড়ার নামের জোরে। জ্যাকি ভাগনানির বেলাতেও একই কথা খাটে। ‘কাল কিসনে দেখা’, ‘ইয়াঙ্গিস্তান’, ‘মিত্র’ প্রভৃতি ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও বাবা ভাসু ভাগনানি আরও ছবি বানাচ্ছেন। টাইগার শ্রফ নাচ এবং একশনে পারঙ্গম হলেও অভিনয়টা যে তার কম্ম নয়, সেটা বোঝাই যায়। তবুও বিগ বাজেটের ছবিতে তাকে দেখা যাচ্ছে প্রতি বছরই।
জিমি শেরগিল, কে কে মেনন,অতুল কুলকারনি, সঞ্জয় মিশরা, বিনয় পাঠক, সঞ্জয় সুরি, রাহুল বোস, সানিয়া মালহোত্রা, ,অভয় দেওল, স্বরা ভাস্কর, অদিতি রাও, তিলোত্তমা সোমে,আলী ফজল, সুশান্ত সিং, রিচা চাড্ডার মতো মেধাবীদের কাজ পাওয়াটা কঠিন হয়ে যায় স্বজনপ্রীতির দৌরাত্ম্যে। রমরমা ব্যবসার জমানায় বহু কুশীলব থাকা পাপের কিছু নয়। তবে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও স্রেফ পারিবারিক সুবিধার জোরে ছবি পাওয়াটাকে বেশ অন্যায়ই মনে করেন দর্শকেরা।