স্পাইডারম্যানঃ ফার ফ্রম হোমকে ঘিরে যত প্রশ্ন1 min read
Reading Time: 6 minutesবক্স অফিসকে নিয়ে কি দারুণ খেলাই খেলেছে মারভেলের ‘দ্য এভেঞ্জারসঃ এন্ডগেম’! বক্স অফিসে যাই হোক, অনুরাগীদের ভাঙা মনের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। আয়রন ম্যান অর্থাৎ টনি স্টার্ক, ব্ল্যাক উইডো অর্থাৎ নাতাশা রোমানফকে হারিয়ে যারপরনাই শোককাতর মারভেল ভক্তরা।
সেই শোককে যেন উস্কে দিতেই স্পাইডারম্যানের আগমন। যদিও থানোস পর্ব এবং টনিকে হারাবার শোকে ক্লান্ত–ব্যাকুল পিটার পার্কার (টম হল্যান্ড) নিজেও। সে হিসেবে একটা ছুটি প্রাপ্যই তার। এবারের ‘স্পাইডারম্যানঃ ফার ফ্রম হোম’ নামেই বলে দেয় চিরচেনা পরিবেশ থেকে মুক্তি চায় পিটার। কিন্তু সে চাইলে কী হবে? নিয়তির তো অন্য পরিকল্পনা থাকতেই পারে! এ নিয়েই ফেজ থ্রি এন্ডিংয়ের এই কিস্তি।
গত ২৬ জুন হলিউডে এর প্রিমিয়ার হলেও জাপান,চীনের বিশাল বাজারে মুক্তি পায় ২৮ জুন। তবে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ২ জুলাই; ভারত, বাংলাদেশসহ বিশ্ববাজারের হলে প্রদর্শিত হয় ৫ জুলাই। মুক্তির পরপরই হলগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দর্শকেরা।
এন্ডেগেমের পর অনেকেই বেশ সন্দিহান ছিলেন মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আয়রন ম্যানকে ছাড়া কীভাবে এই সাম্রাজ্য চলবে তা নিয়েও প্রশ্নের অন্ত ছিলনা। তবে মারভেল স্টুডিও এবং পরিচালক জন ওয়াটস হতাশ করেননি। এন্ডেগেমের বিশালতার কাছে স্পাইডারম্যানের এই কিস্তি নস্যি হলেও ‘স্পাইডারম্যানঃ হোমকামিং’ এর তুলনায় এটি অনেক বেশি পরিণত।
ছবির প্রথম ভাগেই দেখা যায় নিক ফিউরি (স্যামুয়েল এল জ্যাকসন) এবং মারিয়া হিল (কোবি স্মলডারস) বিপর্যয়গ্রস্ত এক স্থানে আসেন। সেখানেই তাদের সাথে সাক্ষাত ঘটে কুয়েন্টিন বেকের (জেক গিলেনহাল)। এর পাশাপাশি নতুন হুমকি ‘এলেমেন্টাল’ দানবদের সাথে পরিচয় ঘটে তাঁদের।
ঘর থেকে দূরে একটু হাফ ছাড়ার উদ্দেশ্যেই ‘ইউরো ট্রিপ’ এ গিয়েছিল পিটার পার্কার এবং তার বন্ধুরা। সাথে এমজেকেও(জেনডায়া) নিজের অনুভূতির কথা জানাবার ইচ্ছে ছিল পিটারের। ইতালির ভেনিসে কালো ডালিয়ার লকেট কিনে প্রায় প্রস্তুতও ছিল সে। কিন্তু বাঁধ সাধে জলের এলেমেন্টাল দানব। মুহূর্তেই ধ্বংস করতে থাকে নদী তীরের সব স্থাপনা। এর বিরুদ্ধে প্রাণপণ চেষ্টা করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি ১৬ বছরের এই সুপারহিরো। এখানেও কুয়েন্টিনই সাহায্যকারী হিসেবে আবর্তিত হয়।
ইতালিয়ান মিডিয়া সাদরেই গ্রহণ করে বেককে, নতুন সুপারহিরোর নাম দেয় ‘মিস্টেরিও’। ওদিকে নিক ফিউরিও কিন্তু থেমে নেই। নতুন এই ধ্বংসাত্মক দৈত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার স্বার্থেই পিটারের সাথে মিলিয়ে দেন তিনি মিস্টেরিওকেও। মূল কমিকসে বেকের সাথে স্পাইডারম্যানের দীর্ঘ শত্রুতার কাহিনী থাকলেও ছবিতে তা দেখানো হয়নি।
ইতোমধ্যেই ফিউরির হস্তক্ষেপে বদল আসে পিটার–নেডের ট্রিপে। চেক প্রজাতন্ত্রে যাওয়ার পথেই পিটার আবিষ্কার করে আয়রন ম্যান তাঁর গোটা স্টার্ক সিকিউরিটি ও ডিফেন্স সিস্টেম ‘এডিথ’ এর ষত্ব দেয়া হয়েছে তাকে। এর পরপরই ফায়ার এলেমেন্টালের সাথে লড়ার পরেই মিস্টেরিও পিটারের পূর্ণ আস্থা জয় করে নেয়। তার ফলে পিটার মিস্টেরিওর হাতে তুলে দেয় এডিথকে। তবে এখানেই সবচাইতে বড় ভুল করে স্পাইডারম্যান। কারণ, এর পরেই বেরিয়ে আসে মিস্টেরিও ও এলেমেন্টালের গোটা গল্পই ফাঁদা হয়েছিল টনি স্টার্কের সাম্রাজ্যকে হাত করে নেয়ার উদ্দেশ্যে। আর এলেমেন্টাল? সেটা একরাশ ড্রোনের হলোগ্রাফিক কারসাজি ছাড়া কিছুই নয়।
পিটার পার্কার অবশ্য ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই আবিষ্কার করে ফেলে এই ছলচাতুরি। এরপরের ইতিহাস মিস্টেরিও ও স্পাইডারম্যানের একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার। হ্যাপি হোগানের সহযোগিতায় শেষমেশ ক্লাইম্যাক্সটা আসে লন্ডনের বিখ্যাত টাওয়ার ব্রিজের ভূমিতেই। গোটা পৃথিবীর সামনে ড্রোন, দৃষ্টি বিভ্রমের ভুল কাটিয়ে দিয়ে স্পাইডারম্যান রক্ষা করে লন্ডনকে। আর মিস্টেরিও? নিজের মৃত্যু সে নিজেই ডেকে আনে।
তবে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন থেকেই যায় এই ছবির শেষে। চলুন জেনে নিই সেগুলো কী।
১। ক্যাপ্টেন আমেরিকা কি মারা গেছেন?
সিনেমার দ্বিতীয় দৃশ্য বেশ বেদনাদায়কই বলতে হবে। টনি স্টার্ক, নাতাশা,স্টিভ রজারস, ভিশনের প্রতি ট্রিবিউট জানিয়ে ‘ইন মেমোরিয়াম; ভিডিও দিয়েই শুরু হয় মূল গল্প। তবে এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। আয়রন ম্যান, ব্ল্যাক উইডো, ভিশনের মারা যাওয়ার নিয়ে স্পষ্টতা থাকলেও স্টিভ রজার্স বা ক্যাপ্টেন আমেরিকা যে মারা গেছেন কোথাও দেখা যায়নি।
তার মানে কি এন্ডগেম হওয়ার আট মাসের মাথায় মারা গেছেন ক্যাপ্টেন? সম্ভবত না! এন্ডগেমেই দেখা গেছে ক্যাপ্টেন অতীতে পেগি কার্টারের সাথে জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অতএব, বর্তমানে তার বয়স হবে ১০৯ বছর। আর স্রেফ ফ্যালকন ও বাকি বার্নস ছাড়া সাক্ষীও ছিলনা ক্যাপ্টেনের গল্পের! মিডিয়া বা অন্য কোন মাধ্যমে আসাও সম্ভবত এড়িয়ে চলেছেন তিনি। একারণেই তাঁকে মৃতের খেতাব দিয়ে ফেলেছে বিশ্ব।
২। আয়রন ম্যান কেন পিটারকে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি মনে করলেন?
পিটার পার্কারের প্রতি আয়রন ম্যানের আলাদা একটা ভালোবাসা ছিল। ইনফিনিটি ওয়ারে অর্ধেক জনতার সাথে পিটারও হারিয়ে যায়। এন্ডগেমে পিটারের প্রত্যাবর্তনে সবচাইতে খুশি হয়েছিলেন আয়রন ম্যানই। সম্ভবত প্রথম থেকেই তাকে গড়ে নিতে চেয়েছিলেন যোগ্য এভেঞ্জার হিসেবে।
ফলে মৃত্যুর পর বিশাল স্টার্ক সাম্রাজ্যের চাবিকাঠি এডিথকে পিটারের হাতেই সঁপে দিয়েছেন তিনি। এখানেই থেকে যায় প্রশ্ন, আয়রন ম্যান কি পিটারকে তাঁর জায়গায় বসাতে চাচ্ছেন? এভেঞ্জার দলে যোগ্য উত্তরসুরি কি আর ছিলনা? পুরোটাই কি ভালোবাসার বশে? নাকি পিটারের মাঝে নিজের ছায়া খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি?
৩। কুয়েন্টিন বা মিস্টেরিও কি সত্যিই মারা যায়?
‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ এর উপযুক্ত উদাহরণ বলা যায় পোস্ট ক্রেডিট সিনে মিস্টেরিওর উত্থান। মিস্টেরিও যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে মিথ্যে বলে আসছিল সেক্ষেত্রে তার মৃত্যু নিয়েও ধোঁয়াশা থাকাটাই স্বাভাবিক। ক্লাইমেক্স দৃশ্যে কুয়েন্টিন বেক তারই পরিচালিত এক ড্রোন দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তবে এর পরিণতিও ছিল দৃষ্টিবিভ্রমেরই অংশ।
যদিও এডিথ নিজের পিস্তলের গুলিতেই মিস্টেরিওর মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। কিন্তু প্রযুক্তিবিদ হিসেবে মিস্টেরিও কিন্তু এডিথকেও ফাঁকি দিতে পারে!
৪। মিস্টেরিওর ভিডিও কী বিশ্বাসযোগ্য?
প্রথম পোস্ট ক্রেডিট সিনে পিটার এবং এমজে লন্ডনের টাইম স্কয়ারে এসে দাঁড়ায় ।তখনই বিশাল স্ক্রিনে ভেসে ওঠে বিতর্কিত পত্রিকা কাম ওয়েবসাইট ‘দ্য ডেইলি বিউগল’এর সম্পাদক জোনাহ জেমসনের মুখ। পরিচালক ওয়াটস ‘ দ্য রিলব্লেন্ড পোডকাস্টে’ আগেই জানিয়েছিলেন জে কে সিমনসের ক্যামিওর কথা। এরপরেই দেখা যায় মারা যাওয়ার আগে মিস্টেরিওর জবানির ভিডিও যেখানে স্পাইডারম্যানের আসল পরিচয় প্রকাশ পায়।
এখন কথা হচ্ছে, বিতর্কিত বিউগল কী এই ভিডিওর ভিত্তি নিশ্চিত করেছে? এর ফলাফল কী হবে? স্পাইডারম্যান কি জাতীয় শত্রুতে পরিণত হবে? নাকি ডক্টর স্ট্রেঞ্জের সাহায্যে গোটা ঘটনাকে ভুলিয়ে দেবে স্পাইডারম্যান? আর EDITH মানে Even Dead I’m The Hero যা আয়রন ম্যানের জন্য প্রযোজ্য সেটায় ভাগ বসালো না তো মিস্টেরিও?
৫। মাল্টিভার্সের উপস্থিতি কী আসলেই ছিল?
মিস্টেরিওর দাবি সে আর্থ– ৮৩৩ এর বাসিন্দা, যেখানে পিটার তথা আমরা থাকি আর্থ– ৬১৬ তে। চলচ্চিত্রের মধ্যভাগেই আমরা জেনে যাই, মিস্টেরিওর পুরো গল্পই ডাহা মিথ্যে। কিন্তু এর মানে কি আসলেই মাল্টিভার্স নেই?
ডক্টর স্ট্রেঞ্জ থেকে আমরা জানি এনসিয়েন্ট ওয়ান (টিলডা সুইনটন) মাল্টিভার্সের উপস্থিতির সত্যতা স্বীকার করেছেন।এছাড়া মারভেল স্টুডিও বস কেভিন ফেইজও একে সত্যিই ধরেছেন। মিস্টেরিও যদি আসলেই মাল্টিভার্সের উপস্থিতি নিয়ে না জানতো তাহলে সে পৃথিবীর আসল কোডনেম জানলো কীভাবে? সেক্ষেত্রে হয়তো ‘থরঃ দ্য ডার্ক ওয়ার্ল্ডে’র শরণাপন্ন হওয়াই শ্রেয়; যেখানে এরিক সেল্ভিগ অভিসরণ ও মাল্টিভার্সের থিওরি বুঝিয়েছিলেন। ওখানেই কিন্তু আর্থ– ৬১৬ নামটা পাওয়া যায়। এর মানে কি এরিকের তত্ত্বটাকেই কাজে লাগিয়েছে মিস্টেরিও।
৬। নিক ফিউরির পরিকল্পনা আসলে কী ছিল?
সিনেমার পোস্ট ক্রেডিট সিনে দেখা যায় গোটা ছবিতে নিক ফিউরি আসলে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না। ছুটি কাটাতে তিনি ছিলেন স্পেস SWORD (Sentient World Observation and Response Department) এর স্পেসশিপে।তাঁর জায়গায় ছিল তালোস।স্পাইডারম্যান টালোসের স্ক্রিন শেয়ারিং বেশ অনাকাঙ্ক্ষিতই ছিল। এই শেপ শিফটিং এলিয়েনকে প্রথম দেখা গেছে ‘ক্যাপ্টেন মারভেলে’। ফলে এখন প্রশ্ন আসে, কতদিন ধরে নিকের জায়গায় প্রক্সি দিয়েছে সে? এন্ডগেমের পর থেকেই নাকি শুধু স্পাইডারম্যানের এই অংশে?
৭। মারিয়া হিল কোথায়?
গোটা মুভিতে ফিউরির মতো মারিয়া হিলও ছিলেন অনুপস্থিত। তবে সেটা আন্দাজ করা যায় সেকেন্ড পোস্ট ক্রেডিট সিনেই। হিলের স্থান ভরাট করেছিল টালোসের স্ত্রী সোরেন।
নিক ফিউরির অবকাশযাপন স্পষ্টত দেখানো হলেও হিলের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যায়। দর্শকেরা আপাতত ধরেই নিচ্ছেন মারিয়াও হয়তো অবকাশেই আছেন!
৮। মিস্টেরিওর দল কোথায়?
মিস্টেরিওর আকস্মিক মৃত্যুর পর কী হয়েছিল তার দলের? উইলিয়াম রিভা কিংবা গুটারম্যান কারুর পরিণতিই দেখানো হয়নি। তাহলে কি তারা পালিয়ে গেছে? না নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বন্দি? নাকি অন্য কোন ফন্দি আঁটছে স্টার্ক ইন্ডাস্ট্রির বরখাস্ত জিনিয়াসেরা ?
ছবিতে গল্প, টনির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন কিংবা মিস্টেরিওর হিংসাত্মক মনোভাব ছাড়াও প্রচুর কমিক রিলিফও ছিল। যেমন– দ্য ব্লিপ (এন্ডগেমের লড়াইয়ের ফলে ৫ বছর পর অর্ধেক জনতার ফিরে আসার ঘটনা) এর ফলে উদ্বাস্তুদের চ্যারিটি অনুষ্ঠানে পিটারের অপ্রস্তুত অবস্থা,নেড–বেটির প্রেম, আন্ট মে– হ্যাপির ডেটিং কিংবা থর আর ক্যাপ্টেন আমেরিকার সাজে পিটারের শত্রু বধ, প্রত্যেক দৃশ্যই হাসিয়েছে ভক্তদের।
তবে ‘মিস্টেরিও ইজ ট্রুথ।‘ এই দম্ভোক্তিই এক আঁচড়ে নাকচ করে দেয় সকল সত্যকে। হয়তোবা এই ভিলেন চরিত্রই দেখিয়ে দিতে চায়, মানুষ যা দেখে তা ই সত্য বলে মানে, তলিয়ে দেখেনা। এখন যাকে সত্য মনে হচ্ছে দেখার ভুলে মিথ্যে হতেও দেরি নেই। অতএব, খুব সাবধান!