মেয়রের আপাতত ‘না’
সাহেদ আলম,
নিউইয়র্কের পাবলিক স্কুলগুলোতে মুসলিম আর ইহুদী শিক্ষার্থীরা তাদের ধর্মীয় খাবার চেয়ে আসছে অনেকদিন ধরে। প্রথমে শুধু মুসলিম মানবাধিকার সংগঠনগুলি তাদের জন্য শুধুমাত্র হালাল খাবাবের দাবী করে আসলেও, সেটিতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। পরে, নিউইর্য়কের অন্যতম সংখ্যাগরিষ্ট ইহুদি ধমীয় নেতাদেরকে তারা এক কাতারে এনেছেন। এখন মুসলিম দের জন্য হালাল খাবার আর ইহুদীদের জন্য তাদের ধমীয় খাবার ‘খোসা’র সরবারহের দাবী তুলেছেন নানা ভাবে। তার-ই ধারাবাহিকতায় পহেলা ডিসেম্বর জ্যামাইকার ব্রায়ারউডে মেয়র বিল ডি ব্লাজিও’র টাউন হল মিটিং এ একজন ইহুদি এবং একজন মুসলিম শিক্ষার্থী এই দাবী তোলেন মেয়রের কাছে।
আল মামুর স্কুলের ছাত্রী ইকরা মোহাম্মাদ এবং ওয়শিভা বিশ্ববিদ্যালয় হাই স্কুল এর ছাত্র স্যাম ভারস্টানডিগযৌথভাবে দাড়িয়ে যান।এর পর মাইক বদল করে, দুজনেই মেয়রকে জানান, আমরা আমাদের পছন্দের খাবার চাই। পরষ্পর বিরোধী দুই ধর্মীয় পরিবারের দুইজনকে একসাথে দেখে মেয়র তার আসন ছেড়ে চলে আসনে ঐ দুই শিক্ষার্থীর সামনে। বলেন, এটাই নিউইয়র্কের আসল সহনশীলতার চিত্র। তবে, তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, শহর পরিচালনার যে বাজেট তাতে এমনিতেই ফেডারেল সরকার বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে।তবে শিক্ষার্থীদের রুচি এবং পছন্দের বিষয়টি মাথায় রেখে, মুসলিম এবং ইহুদী শিক্ষার্থীদের যেন অন্যদের জন্য প্রস্তুতকৃত (বিফ এবং শুকর) খাবারের সাথে মিশ্রিত কোন খাবার না খেতে হয় সেজন্য শ্রেফ সবজি খবার সরবারহের ব্যবস্থা করেছি আমরা। আপাতত সেটিই চলুক, এর পর দেখা যাবে তোমাদের এই নিদৃষ্ট দাবী কতদুর পূরণ করা যায়।
টাউন হল মিটিং এ এই দুই মুসলিম এবং ইহুদি শিক্ষার্থীকে একত্রিত করে হালাল আর খোসা’ খাবারের দাবী তোলার পেছনে কাজ করছে নিউইয়র্কের ৩৬টি সংগঠন। মুসলিম এবং ইহুদী ধর্মের অনুসারী এসব সংগঠনগুলোর একজন সংগঠক বাংলাদেশী মানবাধিকার কর্মী মাজেদা এ. উদ্দীন প্রথম আলোর সাথে আলাপ কালে জানান, ১৯৮৮ সাল থেকেই আমি এই দাবীতে কাজ করছি।তবে, বড় আকারে এই দাবীকে আন্দোলনে রুপান্তরিত করতে কাজ শুরু হয়েছে ২০০৭ সাল থেকেই। মাজেদা উদ্দীন জানান, নিউইয়র্ক সিটি প্রসাশন চাইলেই, এই সহজ দাবীটি বাস্তবায়ন করতে পারে। কেননা, এর আগে এমন আন্দোলনের কারনেই কিন্তু ঈদের ছুটি সরকারী হয়েছে স্কুল গুলোতে। এখন হালাল আর খোশা খাবারের দাবী বাস্তবায়নও সময়ের পথে।
নিউইয়র্কের স্কুলগুলোতে গড়ে ৩৪ শতাংশ ছেলে মেয়েরা আসে ইহুদি পরিবার থেকে।মসুলিম পরিবার থেকে আসে গড়ে ১১ থেকে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ ছাড়াও, ভারত পাকিস্থান, এবং আরব রাষ্ট্রগুলো থেকে আগত অভিবাসীর সন্তানেরা স্কুলে সরবারহকৃত খাবার খেতে পছন্দ করে না। কেননা, সেগুলি হালাল উপায়ে প্রস্তুতকৃত নয়। একই রকম আপত্তি ইহুদিদেরও। তাদের বেশিরভাগ পারিবারিকভাবে এবং ধর্মীয় অনুশাসনের কারনে হাড়বিহীন এবং কাটা বিহিন প্রোটিন খাদ্য যেটিকে তারা ‘খোসা’ হিসেবে দাবী করেন, সেই খাবার চান। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর খাবার অপচয় হয় বলে একটি জরিপ তথ্য আছে আন্দোলনকারীদের হাতে। সেই অপচয় রোধ করা সম্ভব, কেবলমাত্র মুসলিম এবং ইহুদিদের ধর্মীয় পছন্দের খাবার সরবারহ করা গেলে। সেই দাবীতে আইন প্রনেতাদের দারে দারে ঘুরছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাতে কাজ ও এগিয়েছে অনেক খানি।
নিউইয়র্কের একজন এসেম্বিলিম্যান ডেভিড উইপ্রিন ২০১৭ সালে ১২ নভেম্বর নিউইয়র্ক স্টেট এসেম্বিলিতে এই দাবী তোলেন। সেখানে যুক্তি হিসেবে উইপ্রিন বলেন, ‘যদি জেল খানাগুলোতে হালাল এবং খোসা খবার সরবারহ করার বিধান প্রবর্তন করতে পারে রাষ্ট্র, সেখানে শিক্ষার্থীদের ভাল ভবিষ্যতের প্রয়োজনে তাদের পছন্দের খাবার সরবারহ করার উদ্যোগও নিতে হবে রাষ্ট্রকে’। ডেভিড উইপ্রিন তার যুক্তিতে বলেন, ধর্মীয় এবং সাংষ্কৃতিক বৈচিত্রে আমাদের নিউইয়র্কের মত এত বৈচিত্রপূর্ন বসতি আর নেই, আমাদের বৈচিত্রপূর্ন সমাজকে এগিয়ে নেয়ার পথে আমাদের সন্তানদেরকে শুধুমাত্র পুষ্টিকর খাবার আর ধর্মীয় খাবার ‘এই দুয়ের মধ্যে যে কোন একটিকে বেছে নিতে বলা ঠিক নয়’
এসব দাবী দাওয়া নিয়ে মাঠে ঘাতে দীর্ঘ আন্দোলন করার প্রেক্ষিতে নগর প্রসাশন কিছুটা পদক্ষেপ নিয়ে, মুসলিম এবং হুইদি পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য কেবলমাত্র সবজি খাবার সরবারহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তাতে তারা প্রোটিন থেকে বন্চিত হচ্ছে এবং শারীরিক আর মেধায় পিছিয়ে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মুসলিমদের হালাল খাবারের দাবীকে জনদাবীতে পরিনত করার কাজে নামা মাজেদা উদ্দীন।
‘আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই এই দাবী তুলেছি।আমার ৫ টি সন্তান নিউইয়র্কের পাবলিক স্কুল থেকে পড়াশুনা করিয়েছি। আমার বড় মেয়ে তার পুরো স্কুল জীবনে কোনদিন স্কুলে দেয়া খাবার খেতে পারেনি, অরুচির কারনে। তার ভয়, যে একপাত্রেই হয়তো শুকরের মাংশ অথবা উপাদান দিয়ে খাবার প্রস্তুত হয়েছে। একই কারনে, আমার আরেক ছেলে স্কুলে কেবল ঠান্ডা দুধ পান করতো। সে এই ঠান্ডা দুধ খেতে খেতে এ্যাজমা রোগ বাধিয়েছে।আমার আরেক সন্তানকে স্কুল থেকে বেরিয়ে দোকানের হালাল প্যাকেট খাবার কিনে স্কুলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ার অপরাধে বহি:ষ্কার করতে চেয়েছিল একটি স্কুল। এসব কারনে, আমি আমার কমিউনিটির ছেলে মেয়েদের এই স্কুল খাবারকে হালাল প্রতিষ্ঠানের খাবার সরবারহের দাবী তুলেছি। আমি জানি একদিন এটি বাস্তবায়িত হবেই নিউইয়র্কে।’ প্রথম আলোর সাথে আলাপ কালে বলছিলেন মাজেদা উদ্দীন।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লস এন্জেলস এর মুসলিম প্রধান কয়েকটি স্কুলে আর মিশিগানেও অনেক স্কুলে এরই মধ্যে দাবী অনুযায়ী হালাল খাবার পরিবেশন করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়েছে। সেই সাফল্যকেই অনুপ্রেরনা ধরে এবার নিউইয়র্কের স্কুল গুলোতে এই দাবী বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছে মুসলিম এবং ইহুদি অভিবাসীরা।