Site icon Bangla Info Tube

গত ১০ মাসে সৌদি থেকে দেশে ফিরেছেন ২১ হাজার বাংলাদেশি কর্মী

গত ১০ মাসে সৌদি থেকে ফেরত এসেছেন ২১ হাজার বাংলাদেশি, Photo Source: jugantor.com

Reading Time: 3 minutes

পঞ্চগড়ের মেয়ে সুমি জীবনের তাগিদে পাড়ি জমিয়েছিলেন সৌদি আরবে। কিন্তু বাস্তবতার নির্মম মারপ্যাঁচে সুখের দেখা পান নি। সৌদিতে শিকার হয়েছেন নির্মম শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের। কিছু দিন আগে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে চেয়ে সুমির আর্তনাদের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে নড়েচড়ে বসেন ফেসবুকবাসী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। পরে সরকারের চেষ্টায় সুমি শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে আসতে পেরেছেন। কিন্তু সবার ভাগ্য সুমির মতো নয়। হাতেগোনা কিছু নারীর ঘটনা চোখের সামনে আসছে। অনেক নারী কেমন আছেন, কীভাবে আছেন সে নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই।

দেশে ফেরত আসা নারী কর্মীরা যেখানে দেশে এসে তাদের ওপর চালানো অমানুষিক নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছে সেখানে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দোষ দেখছেন আমাদের নারী শ্রমিকদেরই। তিনি বলেছেন, “কিছু কিছু নারী নিজেদের কারণে নির্যাতিত হয়। প্রথমে যাওয়ার পর ভাষাগত সমস্যায় পড়েন। মালিক উনাকে যে আদেশ করেন উনি বুঝতে পারেন না। আর চাহিদা মোতাবেক রান্না করতে না পারায় নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এ ধরণের বহু সমস্যা আছে।”

মন্ত্রী সাহেবের কথা সাথে পুরোপুরি দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া কেন নারী শ্রমিকদের সৌদি পাঠানো হচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাব কে দেবেন? এই দায় কাদের? সৌদি আরব নারী গৃহকর্মী পাঠানোর পূর্বশর্ত হিসেবে বলেছিল, নারীদের বিদেশে কাজ করার মতো শারীরিক, মানসিক সামর্থ্য থাকতে হবে। সেই সাথে সৌদির ভাষা, রীতিনীতি ও জীবনাচার সম্পর্কেও ধারণা হবে। কিন্তু এই সব দেখার সময় কারো নেই।

২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত থেকে সৌদি আরবের শ্রম বাজার বাংলাদেশের জন্য বন্ধ ছিল। ২০১৫ সালে সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী নিয়োগের ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ১২ লাখ ৭৮ হাজার ৯২০ জন কর্মী বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে গেছেন। এর মধ্যে নারী কর্মীর সংখ্যা ২ লাখ ৯৩ হাজার ৫৮৮।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “চলতি বছরের নয় মাসে সৌদি আরব থেকে ৪৮ নারীর লাশ বাংলাদেশে এসেছে। গত চার বছরে সৌদি থেকে ১৫২ নারীর মরদেহ দেশে ফিরেছে। তাদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৩১ জন নারী।”

আরও পড়ুন- গত ৫ বছরে দেশে ফিরেছে ১৭ হাজার ৩০৩ জন প্রবাসী শ্রমিকের লাশ

নির্যাতনের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে যেখানে সৌদি প্রবাসী আমাদের মা-বোনেরা আত্মহত্যা করছেন সেখানে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলছেন, “সৌদি আরবে ২ লাখ ৭০ হাজার নারী কাজের জন্য গেছেন। এদের মধ্যে ৫৩ জনের লাশ ফিরে এসেছে। এর মধ্যে ৮ হাজারের মতো ওখানে কাজ থেকে ফিরে এসেছেন। শতকরা হিসেবে সংখ্যাটা খুবই সামান্য। ৯৯ শতাংশ নারী “ম্যানেজ” করে নিয়েছেন, দেশে তারা টাকাও পাঠাচ্ছেন।”

মন্ত্রী সাহেব পাটিগণিতের শতকরা হিসেব জনগণকে জানিয়েছেন। কিন্তু সেই সাথে তিনি যদি যে ৫৩ জনের লাশ দেশে এসেছে তাদের সবার মৃত্যুর কারণ তদন্ত করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতেন তাহলে হয়ত ব্যাপারটা শোভন হতো। কারণ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এখন গড়ে প্রতিদিন ১১ জন শ্রমিকের লাশ দেশে আসছে। ২০১৯ সালের প্রথম ৯ মাসেই দেশে এসেছে প্রায় ৩ হাজার কর্মীর লাশ এসেছে। এর মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। বাকি শ্রমিকেরা স্ট্রোক. হৃদরোগ, দুর্ঘটনা, হত্যা বা আত্মহত্যায় মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন।

ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপালের মতো দেশ নারী শ্রমিক অত্যাচারের অভিযোগে সৌদিতে কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের কর্মীদের স্বার্থ রক্ষার গুরু দায়িত্ব যাদের হাতে তাদের একজন সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সুর মিলিয়ে বলেছেন, “গত চার বছরে বাংলাদেশ থেকে তিন লাখ নারী শ্রমিক গেছেন সৌদি আরবে। তাদের মধ্যে ১৩ হাজার দেশে ফিরে এসেছেন। ফিরে যাওয়া নারী শ্রমিকদের হার শতকরা হিসেবে অনেক কম। সবাই যে, নির্যাতনের কারণে ফিরে গেছেন তাও নয়।”

মসিহ আরও বলেছেন, “এখানে নারীদের যতটা নির্যাতনের কথা বলা হয় বাস্তবে ততটা নয়। নারীরা দেশে ফিরে যাওয়ার একটি বড় কারণ তারা হোমসিক। তবে কিছু কিছু ঘটনা যে ঘটছে না তা নয়।”

একজন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে এমন মন্তব্য করা কতটুকু সমীচীন সেটার বিচার ভার পাঠকদের ওপরই ছেড়ে দিলাম। তবে শুধু নারীরাই নয়, ভালো নেই আমাদের সৌদি প্রবাসী পুরুষ ভাইয়েরাও। চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে মোট ২ হাজার ৬১৫ জন বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। আর প্রবাসী কল্যান ডেস্ক ও ব্র্যাক আমাদের জানাচ্ছে, চলতি বছরের ১০ মাসে এখন পর্যন্ত সৌদি থেকে দেশে ফিরেছেন ২১ হাজার বাংলাদেশি। বলা বাহুল্য যে বেশির ভাগ শ্রমিকই ফিরছেন শুন্য হাতে।

ফিরে আসা কর্মীদের তথ্যানুযায়ী তারা সৌদিতে নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়ছিলেন। মূলত কাজের বৈধ অনুমতিপত্রর (ইকামা) মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া এবং নিয়োগকর্তা (কফিল) পরিবর্তনের অভিযোগে বাংলাদেশী কর্মীদের সৌদি পুলিশ আটক করে দেশে ফিরিয়ে দিচ্ছে। সৌদিতে কাজ করা কর্মীদের কফিল বা কাজ পরিবর্তনের আইনগত কোন সুযোগ নেই। অর্থাৎ যে কাজ নিয়ে তারা আসেন তার বাইরে কিছু করার অধিকার তাদের থাকে না। এই আইনের মারপ্যাঁচে তাই শুধুমাত্র কাজ পরিবর্তনের কারণে বৈধভাবে আসা শ্রমিক অবৈধ হয়ে পড়ছেন।

তবে এক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশ নয়, ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ আরও অন্তত সাতটি দেশের ১০ লাখ কর্মীকে সৌদি কর্তৃপক্ষ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছেন।

বাংলাদেশ সরকার প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে একদমই যে অনান্তরিক সেটা বলাও ঠিক হবে না। ইতিমধ্যে সৌদিতে কর্মী নিয়োগের ভুঁইফোড় অনেক এজেন্সির লাইসেন্স সরকার বাতিল করেছে। কিন্তু এতটুকু পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা যাদের ওপর ভর করে ছুটছে তাদের প্রতি সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

২০১৪ সালের জুন থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৭৪টি দেশে আট লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৩জন নারী কর্মী গেছেন। আমাদের মা-বোনদের কর্মসংস্থান আমরা করতে পারছি না। অনেক দুঃখ-কষ্ট বুকে নিয়ে অভাবের তাড়নায় তারা ভিনদেশের অচেনা অজানা জায়গায় পরিবার পরিজন ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন। এমন অবস্থায় যদি একজন নারী কর্মীও মানসিক-শারীরিক কিংবা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান বা আত্মহত্যা করেন তবে সেই দায় কি পুরো রাষ্ট্রর নয়?

লেখক- হাসান উজ জামান 

আরও পড়ুন-  চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশ?

আরও পড়ুন- ১০ জনের মধ্যে ৯ জন পোশাক শ্রমিকেরই তিন বেলা খাওয়ার সামর্থ্য নেই 

Exit mobile version