ইতিহাস বিশ্ব

সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ1 min read

নভেম্বর ৩, ২০১৯ 4 min read

author:

সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ1 min read

Reading Time: 4 minutes

সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। প্রায় দশ বছর ধরে চলা এ ধ্বংসলীলা শেষ হয় ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। মতান্তরে এ যুদ্ধে প্রায় ছয় থেকে বিশ লক্ষ আফগান নাগরিক প্রাণ হারায়। এই যুদ্ধে নিহতদের মধ্যে অধিকাংশ নাগরিকই ছিল বেসামরিক।

পটভূমি

১৯৭৮ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নূর মুহম্মদ তারাকী আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। তারাকী ছিলেন অনেকটা আধুনিকমনা আর সংস্কারপন্থী। ক্ষমতা অধিগ্রহণের পর তিনি দেশটিতে চরম আধুনিকায়ন ও নানা সংস্কারমূলক কার্যক্রম শুরু করেন। এর ফলে যারা সনাতনী বা প্রাচীন সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করতেন তাদের সাথে নব্য সরকারের চরম মতবিরোধ তৈরি হয়। তারা তারাকী সরকারের বিরুদ্ধে নানা প্রতিবাদ সমাবেশ করতে থাকে। অপরদিকে তারাকী সরকারও হাজার হাজার বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করে এবং প্রায় ২৭,০০০ রাজনৈতিক বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

এর প্রতিবাদে বেশ কয়েকটি সরকার বিরোধী দল গঠিত হয় এবং তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তাই স্বাভাবিকভাবে সমগ্র আফগানিস্তান জুড়ে সৃষ্টি হয় চরম অরাজকতা। এসব অরাজক পরিস্থিতির মধ্যেই ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে নাটকীয়ভাবে আরেক নেতা হাফিজুল্লাহ আমিনের সমর্থকেরা নূর মহম্মদ তারাকীকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমিনকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসায়।

হাফিজুল্লাহ আমিন ক্ষমতায় আসার পর সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে আফগানিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। মতাদর্শের দিক থেকে হাফিজুল্লাহ ছিলেন অ্যান্টি কমিউনিস্ট। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের নতুন সেই সরকারকে হটানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। তারা আফগানিস্তানের চলমান বিদ্রোহ ঠেকানোর অজুহাত দেখিয়ে ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর লিওনিদ ব্রেজনেভের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে আর্মি মোতায়েন করে।

সোভিয়েত সামরিক সেনারা কাবুলে পৌঁছে প্রথমেই একটা অভ্যুত্থানের নাটক করে হাফিজুল্লাহ আমিনকে হত্যা করে এবং সোভিয়েতপন্থী নেতা বারবাক কারমালকে ক্ষমতায় বসায়। সেই পুতুল সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। মূলত হাফিজুল্লাহ আমিন হত্যার মধ্য দিয়েই শুরু হয় দীর্ঘ দশ বছরব্যাপী ভয়াবহ সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের।

যুদ্ধের ভয়াবহতা

সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ সংঘটিত হয় মূলত আফগানিস্তান-পাকিস্তান এবং ইরান-আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চলসমূহে। আফগানিস্তানের গণতন্ত্রপন্থী দল সুন্নী মুজাহিদিন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের শত্রুপক্ষ।

সোভিয়েত সৈন্যরা আফগানিস্তানের শহর ও যোগাযোগ কেন্দ্রগুলো দখল করে। যাতে করে আফগানিস্তান বহির্বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন থাকে। যেসব অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বারবাক কারমালের হস্তক্ষেপ ছিল না সেসব অঞ্চলে সুন্নী মুজাহিদিনরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। এইসব বিদ্রোহীদের নিঃশেষ করতে সোভিয়েতরা বোমারু বিমান ব্যবহার করা শুরু করে। বিদ্রোহীদের নিরাপদ আশ্রয় হতে পারে এমন সন্দেহে গ্রামের পর গ্রাম ধুলায় মিশিয়ে দেয়। একের পর এক সেচ খালগুলো ধ্বংস করে এবং লক্ষ লক্ষ একর ভূমিতে মাইন ছড়িয়ে দেয়।

সোভিয়েত সেনারা অসংখ্য আফগান নিরপরাধ নারী ও শিশুকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে। রুশ সৈন্যরা যখন মুজাহিদদের খোঁজ করার জন্য গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়াত, তখন তারা গ্রাম থেকে নারীদের ধরে নিয়ে এসে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত।

নামকরা লেখক সিবা শাকিব তাঁর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বই ‘আফগানিস্তান, হোয়্যার গড ওনলি কামস টু উইপ’ এ আফগান নারীদের উপর সোভিয়েত সৈন্যদের অত্যাচারের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “উর্দিধারী রুশ ছেলেরা আদেশ পালন করতে গিয়ে, ভয় কাটিয়ে, তারা গ্রামগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, নারীদের তুলে নিয়ে যায়, ধর্ষণ করে, স্তন কেটে ফেলে, পেট চিরে ফেলে, ভ্রূণগুলোকে চাপড় দিয়ে বালিতে পুঁতে ফেলে। তারা শিশুদের শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে।”

এই যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভিরোস্লাভ ইসমাইলভ ছিলেন একজন রুশ সেনা। তিনি সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা একটা সামরিক কনভয়ে করে যাচ্ছিলাম। পথে দেখলাম, একজন আফগান একটা ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে– তাতে ভর্তি তরমুজ। আমাদের একজন অফিসার ট্রাকটি থামিয়ে সেখান থেকে তরমুজ ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগলেন সৈন্যদের দিকে। অন্তত ২০-৩০টা। আর সেই আফগান ট্রাক চালক, সে বসে বসে কাঁপছিল। আর বলছিল– দয়া করে আর নেবেন না, আর নেবেন না। এগুলো বিক্রি করেই আমার সংসার চলে। আমার মনে আছে, সেই মুহূর্তেই আমার মনে হলো: আমরা এদেশে শান্তি স্থাপন করতে আসি নি। আমরা আসলে দখলদার। কারণ দখলদাররাই এই আচরণ করতে পারে।”

বহির্বিশ্বের সমর্থন

১৯৮০ সালের শুরুর দিকে অর্থাৎ সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক মাসের মধ্যে বিশ্বের ৩৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ জাতিসংঘে “সোভিয়েত সৈন্যদের তাৎক্ষণিক, জরুরি ও নিঃশর্ত প্রত্যাহারের” দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন। সেসময় আফগান বিদ্রোহীরা পাশের দেশ চীন ও পাকিস্তান থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ পায়। পাশাপাশি আফগানিস্তান পারস্য উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা পায়।

কমিউনিজম বিরোধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই সময় ছিল আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী মিত্রপক্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল আফগানিস্তান। বিভিন্ন দেশ থেকে বানের জলের মতো অস্ত্র ঢুকতে থাকে আফগানিস্তানে। উপায়ান্তর না দেখে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে। ১৯৮০’র দশকের মাঝামাঝি আফগানিস্তানে রুশ সৈন্যসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় আনুমানিক ১ লাখ ৮ হাজারে।

ফলাফল

যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় দীর্ঘমেয়াদী এ যুদ্ধে অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর আফগান বিদ্রোহী মুজাহিদরা রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করে। এই যুদ্ধে সোভিয়েত ইয়নিয়নও ব্যাপক সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।

১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে রুশ নেতা মিখাইল গর্বাচেভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সরকার আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। তবে চূড়ান্তভাবে সৈন্য প্রত্যাহার আরম্ভ হয় ১৯৮৮ সালের ১৫ মে। ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সৈন্য প্রত্যাহার সমাপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।

রুশদের পিছু হটার কারণ

আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্যদের স্বেচ্ছায় পিছু হটার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব তো আছেই। তার চেয়েও আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল সোভিয়েত সেনাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব। কারণ সোভিয়েত সৈন্যদেরকে যখন আফগানিস্তানে প্রেরণ করা হয়েছিল তখন তাদেরকে বুঝানো হয়েছিল যে, তারা আফগানদের সহযোগিতা করতে এসেছে। কিন্তু আফগানিস্তানে এসে তাদের বুঝতে পেরেছিল যে তাদের পাঠানো হয়েছে আফগানিস্তান ধ্বংস করতে।

ইসমাইলভ বিবিসিকে বলেছেন, “মনে আছে– আমাদের শুধু বলা হয়েছিল আমরা শুধু আফগানদের সাহায্য করছি, রাস্তা, স্কুল এবং হাসপাতাল পুনর্নির্মাণ করছি। সামরিক অভিযানের কোন উল্লেখ ছিল না।” তিনি আরো বলেছেন, “নিহত সোভিয়েত সেনাদের প্রতি চার জনের একজনই মারা যেত নিজ পক্ষের গুলিতে বা আত্মহত্যা করে।”

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বার্তাসংস্থা তাসে কাজ করতেন আন্দ্রেই অস্টারস্কি। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, “যুদ্ধে নিহত সোভিয়েত সৈন্যদের মৃতদেহ যেভাবে ব্যাগে ভরা অবস্থায় দেশে ফিরে আসছিল তা আর মানুষের কাছে গোপন রাখা যাচ্ছিল না।”

ক্ষয়ক্ষতি

প্রত্যেকটি যুদ্ধই যেন লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত এবং ত্যাগের সাক্ষী হয়ে থাকে। এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটে নি। এ যুদ্ধে প্রায় ১৫ হাজার সোভিয়েত সৈন্য এবং ১০ লাখ আফগান প্রাণ হারায়। প্রায় ৭০ লক্ষ আফগান নাগরিক হয় গৃহহারা।

প্রায় দশ বছর ধরে চলা দীর্ঘ এ যুদ্ধকে পশ্চিমা গণমাধ্যমে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনাম যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করা হয়। যুদ্ধটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেননা এর ঠিক দুই বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়ে যায়।

লেখক- নিশাত সুলতানা 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *