এক নুসরাতের প্রতিপক্ষ পুলিশ, প্রশাসন, স্থানীয় নেতারা !1 min read
Reading Time: 3 minutesবাংলাদেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাতে ন্যায্য বিচার পাওয়ার আশা করাটা এখন দুঃস্বপ্নের মতো। তারপরও মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা দেখে শুনে বুঝে চুপ করে থাকাটা অসম্ভব হয়ে যায়। বাংলাদেশে জন্ম নেয়া হতভাগ্যদের তালিকায় সর্বশেষ নাম লিখিয়েছে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। বিবেকের ছিটেফোঁটা হলেও যাদের মধ্যে বিদ্যমান, এই ঘটনার বিস্তারিত জানলে তারা সবাই হতভম্ব হতে বাধ্য।
ঘটনার সূত্রপাত গত ২৭ মার্চ। নুসরাতের মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নিজ কক্ষে ডেকে তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিলো। এর প্রেক্ষিতে নুসরাতের পরিবার মামলা করলে গ্রেপ্তার করা হয় সেই অধ্যক্ষকে। গত ৩ এপ্রিল সেই অধ্যক্ষের সাথে কারাগারে দেখা করতে যায় তার কিছু অনুচর। তিনি আলাদাভাবে কয়েকজনের সাথে কথা বলেন। এদের মধ্যে ছিল মাদ্রাসা ছাত্র ও “সিরাজ উদ দৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ” কমিটির আহ্বায়ক নুর উদ্দিন (২০), যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন শামীম। তিনি মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে বলেন। এমনকি চাপে কাজ না হলে প্রয়োজনে নুসরাতকে হত্যা করার নির্দেশ দেন তিনি।
কারাগার থেকে ফেরার পর ওই দিন রাতেই মাদ্রাসার পশ্চিম হোস্টেলে শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের প্রধান আবদুল কাদের সহ পাঁচজন সভা করেন, আর সেখানেই নির্ধারণ করা হয় কখন কোথায় কীভাবে নুসরাতকে হত্যা করা হবে। কেরোসিন, বোরখা কে নিয়ে আসবে, কার ভূমিকা কি হবে সেটিও সেখানে ঠিক করে তারা। আন্দোলন ও বোরকা কেনার জন্য সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও আওয়ামীলীগ নেতা মাকসুদ আলম তাদের ১০ হাজার টাকা দেন এবং আরেক শিক্ষক দেন ৫ হাজার টাকা। থানা পুলিশের বিষয়টি ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন দেখবেন বলে ঠিক করা হয়।
পরিকল্পনামতো ৬ এপ্রিল আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষার আগে কাদের (মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের প্রধান), নুর উদ্দিন, রানা, আবদুর রহিম শরীফ সহ কয়েকজন মাদ্রাসার ফটকে পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল। নুসরাতকে ছাদে ডেকে নেওয়া ও কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন দেওয়ার ঘটনায় মোট পাঁচজন অংশ নেয়। তাঁদের মধ্যে ছিল তিনজন পুরুষ ও দুজন নারী। শাহাদাত হোসেন, শামীম, জোবায়ের আহমেদ, জাবেদ হোসেনসহ তিনজন পুরুষ বোরকা পরা অবস্থায় ছিল। নারীর মধ্যে ছিল উম্মে সুলতানা পপি (ছদ্মনাম শম্পা) ও কামরুন্নাহার ওরফে মণি। এদের মধ্যে উম্মে সুলতানা পপি মিথ্যে বলে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে যায়।
নুসরাতকে নিয়ে পপি ছাদে উঠলে বাকি চারজনও ছাদে চলে যায়। এরপর মণি ও পপি ধরে ফেলে নুসরাতকে। জোবায়ের নুসরাতের ওড়না ছিঁড়ে হাত–পা বেঁধে ফেলে। শামীম নুসরাতের মুখ চেপে মাথা ধরে রাখে, মণি তাঁর বুক ধরে রাখে আর পপি পা ধরে রাখে। জাবেদ পলিব্যাগে থাকা কেরোসিন নুসরাতের পা থেকে বুক পর্যন্ত ঢেলে দেয় আর জোবায়ের ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়।
গুরুতর অবস্থায় ওই দিন রাতেই নুসরাত জাহান রাফিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নুসরাত মারা যান।
এখন পর্যন্ত মামলার এজাহারভুক্ত ৪ আসামী- আবদুল কাদের, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম ও আবদুর রহিম শরিফ জবানবন্দী দিয়েছেন। তাদের সবার জবাবন্দীতে একই রকম তথ্য উঠে এসেছে। এ হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে। মামলার এজাহারভুক্ত ৮ জন আসামির সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর এই মামলার অগ্রগতি চোখে পরার মতো। কিন্ত তারপরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ হত্যা চেষ্টার পর প্রথমে ফেনীর সোনাগাজী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এমনকি কিছু সাংবাদিকও ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে শুরুর দিকে প্রচার করতে থাকে। এমনকি পুলিশ নানা তথ্য গোপন করে পুরো ঘটনাকে অন্য দিকে নেবার চেষ্টা করে। আবার ওসি মোয়াজ্জেমকে রক্ষার জন্য এসপি জাহাঙ্গীর আলম পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি পাঠায়।
পুলিশের কাজে গাফিলতির জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত দল গঠিত হলেও তারা কতটুকু ন্যায্য বিচার করবেন এই নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ইতিমধ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতি ও যোগসাজশের যে অভিযোগ উঠেছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন কতটা ঠুনকো হতে পারে সেটি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দিলো নুসরাতের ওপর ঘটে যাওয়া এই বর্বর ঘটনাটি। প্রভাবশালী খুনির পক্ষে পুলিশ, প্রশাসন , সাংবাদিক, স্থানীয় নেতাদের জড়িত থাকা প্রমাণ করে যে কাগজে কলমে আমরা উন্নত হলেও আমাদের দেশের প্রকৃত অবস্থা কতটা খারাপ। এক প্রতিবাদী নুসরাত নিজের জীবন দিয়ে হয়তো আমাদের ভবিষ্যতের সতর্কবার্তা দিয়ে গেল।