পুরান ঢাকা থেকে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের যোগ্য পুত্র ইরফান সেলিম গত দু’দিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এমপি পুত্র আলোচনায় এসেছেন ‘সামান্য’ মারধরের ঘটনায়। কিন্তু ‘সামান্য’ এই ব্যাপার ‘অসামান্য’ হয়ে উঠার কারণ হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তিটি ছিলেন একজন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা।
মূল ঘটনাটি ছিল এমন-গত রবিবার রাতে স্ত্রীকে নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে কোথাও যাচ্ছিলেন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহম্মেদ খান। ধানমন্ডিতে কলাবাগান ক্রসিংয়ের কাছে সংসদ সদস্যের স্টিকারযুক্ত হাজী সেলিমের একটি গাড়ি ওয়াসিফের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এর প্রেক্ষিতে দু’পক্ষের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয় এবং এক পর্যায়ে ইরফান সেলিম ও তার সঙ্গীরা ওয়াসিফকে মেরে রক্তাক্ত করেন। উল্লেখ্য, গাড়িতে হাজী সেলিম উপস্থিত ছিলেন না। সোমবার সকালে লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ ইরফান সেলিম ও তার তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে ধানমণ্ডি থাকায় মামলা করেন। এরপর শুরু হয় পুলিশ ও র্যাবের অভিযান।
হাজী সেলিমের সোয়ারিঘাটের দেবদাস লেনে অবস্থিত বাসার তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় অভিযান চালিয়ে দুটি অবৈধ পিস্তল, গুলি, একটি এয়ারগান, ৩৭টি ওয়াকিটকি, একটি হাতকড়া সহ বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করে র্যাব। এর পাশাপাশি চকবাজারের আশিক টাওয়ারেও অভিযান চালানো হয়। সেখানে ইরফান সেলিমের একটি “নির্যাতন কেন্দ্র” এর সন্ধান পাওয়া যায়। হকিস্টিক, হাতকড়া, চাকু, মোটা রশি, ইলেক্ট্রিক শক দেওয়ার তার সহ ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয় সেখান থেকে।
অভিযান শেষে ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী জাহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ইরফানকে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে এক বছর ও অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার দায়ে ছয় মাসের কারাদন্ডাদেশ দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেই সাথে দেহরক্ষী জাহিদুলকে অবৈধ ওয়াকিটকি বহনের দায়ে ছয় মাসের কারাদন্ডাদেশ দেয়া হয়। র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মঙ্গলবার পৃথক মামলা করা হবে।
এমপি পুত্র নিজেও একজন জনপ্রতিনিধি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩০ নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর তিনি। আইন অনুযায়ী কোন জনপ্রতিনিধির সাজা হলে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার নিয়ম। অভিযোগ প্রমাণিত হলে পরে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়। সে হিসেবে ইরফান সেলিমের বরখাস্ত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এমপির পুত্র কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের নিজ এলাকায় সাম্রাজ্য গড়ে তোলার একমাত্র উদাহরণ এটি নয়। পুরো বাংলাদেশই এখন চলছে এমন ছোট ছোট সাম্রাজ্যে বিভক্ত হয়ে। বিরল ব্যতিক্রম না হলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সেই সাম্রাজ্যে হানা দেয় না। কোন কারণে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার সুযোগ না থাকলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও সাংবাদিকদের মধ্যে তৎপরতা দেখা যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তির অতীত থেকে বর্তমান জীবনের কাটাছেঁড়া চলতে থাকে কয়েকদিন। সব কিছু ঠাণ্ডা হলে আবার সবাই চুপ হয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন-সংবাদ কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা কীভাবে এতদিন তাদের কুকর্ম চালিয়ে আসছিল এই প্রশ্নকে সামনে আনা হয় না কখনোই।
গেল কয়েক বছরে এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ দেখা গেছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে রিজেন্টের শাহেদ আলম, ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন, যুব মহিলালীগের নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়া, ঠিকাদার জিকে শামিম রীতিমতো তারকা খ্যাতিই পেয়ে গিয়েছিলেন। তবে গ্রেপ্তারের পর মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কিংবা নতুন কোন বড় ঘটনা সব কিছু আড়াল করে দেয়। ক্ষমতাসীন দল থেকে আসে গতানুগতিক বিবৃতি। অপরাধীদের “হাইব্রিড”, “অনুপ্রবেশকারী” তকমা দিয়ে বড় বড় নেতারা নিজেদের দায়িত্বের বোঝা ঝেড়ে ফেলেন। কোন কোন নেতা সব কিছুতেই বিএনপি’র যোগ খুঁজে বিবৃতি দেন। বড় ঘটনার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই আমরা জানতে পারি “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ” অনুযায়ী আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিয়েছেন। আমাদের কপালই বলতে হয়। সব কিছুতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না থাকলে দুর্নীতি কোথায় গিয়ে ঠেকতো তা কে জানে?
“সব কিছুতে যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তাহলে পুলিশ-প্রশাসনের কাজ কি?”- এমন সাংঘাতিক (!) প্রশ্ন যদি আপনার মনে উদয় হয় তবে তার উত্তর আমার জানা নাই।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও পুলিশ-প্রশাসনের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার রীতি পুরনো। কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে একদল ক্ষমতা ও অর্থলোভী মানুষ কুলষিত করছে দেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলকে। ক্ষমতাসীন দলের থানা পর্যায়ের নেতাদেরও কোটি কোটি মালিক হওয়ার সংবাদ দেশবাসী পত্রিকা মারফত জেনেছে। সুশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়া নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যে কোন বিরোধ থাকার কথা নয়। সেই হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং আমরা একই পথের পথিক। কিন্তু “সূর্যের চেয়ে বালি গরম” নীতিতে দেশ চলতে থাকলে সে পথে আমরা এগোতে পারবো কি?
লেখক- হাসান উজ জামান