সাহেদ করিম- টকশো মাতিয়ে রাখা বুদ্ধিজীবী, হাসপাতালের পরিচালক, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে এক নিমিষে বনে গেলেন খলনায়ক। একে একে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। দুদিন আগেও দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে যার ছবি তোলা ছিল নিয়মিত ঘটনা, আর এখন তিনিই আছেন র্যাবের অনুসন্ধানে।
প্রতারণা আর চাপাবাজি দিয়েই যার উত্থান। একসময় মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়েছিলেন। প্রতারণা মামলায় জেলের মুখ দেখেছেন। তবে বেশিদিনের জন্য নয়। মোট মামলা ত্রিশের বেশি। কিন্তু তাকে ধরার সাহস হয়নি কারো। কারণ কখনো সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনো গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংশ্লিষ্ট পরিচয় দিয়ে নিজের চারপাশে মিথ্যের এক বড় জগত গড়েছিলেন সাতক্ষীরা থেকে উঠে আসা সাহেদ করিম। এতেই শেষ না টাকার বিনিময়ে টক শো’তে অংশ নিয়ে নিজেকে করেছেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
তবে সবকিছুরই শেষ আছে। রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমেরও শেষ এসে গেছে। করোনাভাইরাসের পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার (৭ জুলাই) রিজেন্ট হাসপাতাল ও প্রধান কার্যালয় সিলগালা করে দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে করা হয়েছে মামলাও।
সাহেদের উত্থান!
সাল ২০১০। সাহেদ ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস কিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ হাতিয়ে নেন প্রায় শত কোটি টাকা। বিষ্ময়কর হলেও সত্য, এটাই তার প্রথম চেষ্টা এবং তাতেই বিপুল অর্থ চলে আসে। এরপর প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে গা ঢাকা দিলে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী জনসাধারণ। এই কারণে ২০১১ সালে তাকে প্রতারণা মামলায় একবার গ্রেফতারও করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে দ্রুতই তিনি জামিন নিয়ে ফেলেন। তার এলাকার এক আইনজীবীর ভাষায়, তিনি সেসময় ছিলেন ভারতে।
কথায় বলে, টাকায় টাকা আনে। সাহেদ করিম ছিলেন এর আদর্শ উদাহরণ। জেল থেকে ফিরেই প্রতারণার অর্থ দিয়ে তিনি রিজেন্ট গ্রুপ নামে ব্যবসা শুরু করেন। চালু করেন রিজেন্ট হাসপাতাল। আশ্চর্যের কথা হল, হাসপাতাল খোলার আগেই হাসপাতালের নামে অনুমোদন করিয়ে নেন তিনি!
এবার সাহেদ ভিন্ন কৌশলে চলা শুরু করেন। শুরুতেই নিজের পরিচয় গড়ে তোলেন অন্যভাবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তিনি নিজেকে কখনো অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত এমন নানা পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সখ্যতা করতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের স্পন্সর হয়ে সহযোগিতাও করেছেন। আর এসবের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তার পরিচিতি। অফিস, হাসপাতাল বা বাসা সবখানেই সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তোলা ছবি বাঁধাই করে টাঙিয়ে রাখতেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবিকে পুঁজি করেইসাহেদ নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অন্য উচ্চতায়।
এরপরের যাত্রা আরো চমকপ্রদ। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ বা রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠানও খুলে ফেলেছেন। এবার এক লাফেই ব্যবসায়ী থেকে হয়ে যান বুদ্ধিজীবী। এজন্য গাঁটের টাকা খরচ করে বিভিন্ন টক শো’তে অংশ নিতেন বলেও জানা গেছে। একসময় বিএনপির সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকলেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে টিভি পর্দায় নিয়মিত তাদেরকেই সমালোচনার মুখে ফেলতেন তিনি। পরের যাত্রায় সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সুবিধা আদায়ের জন্য ‘নতুন কাগজ’ নামে একটি পত্রিকাও করেছেন। তিনিই সেই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক।
র্যাবের ভাষ্য
র্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তারা প্রায় ৩২টি মামলা খুঁজে পেয়েছেন। যার বেশির ভাগই প্রতারণা মামলা। কারণ প্রতারণা করে অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলাই ছিল তার মূল কাজ।
র্যাবের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রিজেন্ট এ পর্যন্ত সাড়ে চার হাজারের বেশি ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে। অবাক করা ব্যাপার হলেও সত্য যে, ২০১৪ সালে লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পর আর নবায়ন না করেই তারা হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা সাহেদের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস কারো ছিল না।
রিজেন্টের বিপক্ষে যত ব্যবস্থা
অভিযুক্ত রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখা ও অফিস সিলগালা করেছে র্যাব। স্বাস্থ্য অধিদফতরও রিজেন্টের সকল প্রকার স্বাস্থ্য কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। বুধবার হাসপাতালটির মিরপুর শাখা সিলগালা করে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে সাহেদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট)। বলে রাখা ভালো, অফিস সিলগালা করার সময় সেখানে হাজির হন ভবনটির মূল মালিক। জানা যায়, দুই বছর আগে ভাড়া নিলেও কখনোই বাড়িভাড়া দেননি সাহেদ করিম। কখনো কখনো চেক লিখে দিলেও সেসব চেক ফেরত এসেছে। মামলা করলে জুটেছে হুমকি।
করোনা টেস্টের নামে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া ও ভুতুড়ে বিল ধরিয়ে দিয়ে রোগীদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায়সহ নানা অভিযোগে গত মঙ্গলবার রাতে হাসপাতালটির চেয়ারম্যান সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সোমবার গ্রেফতার হয়েছে ৮ জন। সাহেদসহ ৯ জন এখনো পলাতক রয়েছেন।
গ্রেফতার হওয়া আট আসামিকে বুধবার আদালতে আনা হয়। এর মধ্যে এক কিশোরকে সংশোধনাগারে পাঠানোর নির্দেশ এবং অপর সাত আসামির ৫ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দেন বিচারক। রিমান্ড শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ বলেন, আসামিরা করোনাকালীন মহাদুর্যোগের সময় অসহায় রোগীদের অসহায়ত্ব ও দুর্বলতাকে পুঁজি করে প্রতারণা করেছে। রিজেন্ট হাসপাতাল সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিনিময়ে জনগণকে বিনামূল্যে সেবা দেবে বলে চুক্তি করলেও তা করেনি।
উল্টো জনগণের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এমনকি করোনা টেস্টের কথা বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরে দুই কোটি টাকার বিল দাখিল করেছে। তারা করোনার ভুয়া রিপোর্ট দিত। ফাঁদে ফেলে রোগী ভর্তি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিত।
এছাড়াও বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা যায়, রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান তার হাসপাতালের কর্মচারীদের বেতনও আটকে রেখেছেন দীর্ঘদিন ধরে।
সুর বদলালো ক্ষমতাসীন দল
বিপদ যখন আসে, সবদিক থেকেই আসে। সেই নিয়ম মেনেই চাপায় আটকে পড়া সাহেদ করিমকে অস্বীকার করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ। সাহেদ বর্তমানে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য নয় বলে দাবি করেছেন দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ।
বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মো. সাহেদ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য নয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত কোনো উপকমিটির অনুমোদন দেননি।
তবে সত্য কথা হলো, বিগত মেয়াদে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য ছিলেন সাহেদ। ডিসেম্বরে সেই কমিটি বিলুপ্ত হলেও সাহেদ সব জায়গায় নিজেকে এর সদস্য হিসেবেই পরিচয় দিত। তার ফেসবুক পেজ এবং ভিজিটিং কার্ডেও আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য হিসেবেই নিজের পরিচয় উল্লেখ করেছেন। তবে সাহেদের কুকর্ম ফাঁস হয়ে যাওয়ায় এখন তাকে অস্বীকার করছে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ছায়া দেয়া ব্যক্তিরা।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ