‘বাবা বলে ছেলে নাম করবে,
সারা পৃথিবী তাকে মনে রাখবে।
শুধু এই কথা কেউ জানে না
আগামী দিনের ঠিকানা।’
সাদা শার্ট– কালো কোটি পরা গিটার হাতে সুদর্শন এক যুবক লিপসিং করেছিল এই গানে। সেটাই তাঁর প্রথম ছবি, নাম ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। তখন কে জানতো গানের এই কথাগুলোর সাথে মিলে যাবে তাঁর গোটা জীবন!
এরপর গুনে গুনে ২৭ বার পর্দায় এসেছেন তিনি। প্রতিবারই সাফল্যের স্পর্শ পেয়েছে তাঁর কাজ। তাই দুই দশকের বেশি সময় পরেও বাংলাদেশি সিনেমা অনুরাগীদের কাছে নায়ক একজনই– সালমান শাহ্।
নতুন আলোর দিশা
সময়টা ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। সিলেটের কমর উদ্দিন চৌধুরী ও নীলা চৌধুরীর ঘরে মহান মুক্তিযুদ্ধের বছরই জন্ম হয় শাহরিয়ার চৌধুরী ইমনের। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে বেশ আদরেই বেড়ে ওঠেন তিনি জকিগঞ্জে। তখন অবশ্য কেউ ভাবতেও পারেনি বড় হয়ে কি এলাহি কাণ্ডটাই না ঘটাবে এই ‘ইমন’!
অভিনয় নিয়ে আগ্রহটা ছিল শৈশব থেকেই।১৯৮৫ সালে সুযোগও মিলে যায় নন্দিত অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র একটি মিউজিক ভিডিওতে কাজ করার। এরপর টানা চার পাঁচটি নাটকে দেখা যায় তাঁকে। এর মধ্যে আছে বিটিভির ‘আকাশ ছোঁয়া’(১৯৮৫), ‘দেয়াল’ (১৯৮৫), ‘সব পাখি ঘরে ফিরে’ (১৯৮৫), ‘সৈকতে সারস’ (১৯৮৮), ‘নয়ন’ (১৯৯৫), স্বপ্নের পৃথিবী’ (১৯৯৬) । এর বাইরেও ১৯৯০ সালে ‘পাথর সময়’ এবং ধারাবাহিক নাটক ‘ইতিকথা’(১৯৯৪) এ অভিনয় করেন।
এতকিছুর মাঝেও পড়াশোনাটা ঠিক চালিয়ে নিতে হচ্ছিলো। খুলনার ‘বয়রা হাইস্কুলে’ প্রথম পাঠ হলেও থেকে ঢাকার ‘আরব মিশন স্কুল’ থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করেন। কলেজ পর্ব সমাপ্ত হয় ‘আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ’ থেকে। তবে এতেই শেষ না। মালেকা সায়েন্স কলেজ থেকে বি.কম দিয়েই পড়ালেখায় ইস্তফা দেন ইমন।
বাজিমাত শুরুতেই
নাটকে পরিচিত মুখ হলেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠার আগে অনেকটা কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। মডেলিং, নাটক সবকিছুর পরেও লাইমলাইটটা ঠিক পাচ্ছিলেন না।
আমির খান– জুহি চাওলা অভিনীত সুপারহিট ছবি ‘কায়ামাত সে কায়ামাত তাক’ এর রিমেক দিয়েই চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু ইমনের। তবে এর পেছনের গল্পটাও বেশ নাটকীয়। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দমেলা সিদ্ধান্ত নেয় তিনটি বলিউডি ছবি রিমেকের। এর মাঝে ‘সনম বেওয়াফা’ ছিল তালিকার উপরে। পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের কাছে আসে নির্মাণের প্রস্তাব। প্রস্তুতি শুরু করলেও সালমান– রুকসার চরিত্রের জন্য যুতসই কাউকে পাচ্ছিলেন না। মৌসুমিকে শেষমেশ নির্বাচিত করলেও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সুদর্শন কোন নবীনের খোঁজ পাওয়া। খোশনূর আলমগিরের (নায়ক আলমগিরের প্রথমা স্ত্রী) মাধ্যমেই সোহান সন্ধান পান চটপটে, দ্যুতিময় তরুণ ইমনের।
তবে তখনই সব গুছিয়ে নেয়া হয়নি। ইমন এসে জানালো ‘সনম বেওয়াফা’র সালমানের চাইতে ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তাক’ এর রাজেই নিজেকে মানানসই মনে হয় তাঁর। পরিচালকসহ গোটা ইউনিটেরই তখন বেশ পছন্দের পাত্র হয়ে গিয়েছিল নতুন মুখের ছেলেটা। তাই তালিকার বাকি দুই ছবিকে হটিয়ে পরিচালক বেছে নিলেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ –কেই। আর তাতেই ইতিহাস!
রূপালি পর্দায় এসে ইমনের নাম বদলে রাখা হয় ‘সালমান শাহ্’। ১৯৯৩ সালে নতুন এক জুটির রসায়নে দর্শক এতটাই বুঁদ হয়ে থাকে যে পুরো এক মাস হাউস্ফুল বোর্ড টানাতে হয় হলে। ছবির ‘এখন তো সময়’, ‘বাবা বলে’, ‘ও আমার বন্ধু গো’, ‘এখানে দুজনে’ গানগুলো আজও জনপ্রিয়। বলিউডের তুলনায় অপ্রতুল সরঞ্জাম, বাজেট থাকা সত্ত্বেও সজীব প্রেমের নিটোল রসায়নে সবকিছুই ম্লান হয়ে যায়। ফলাফল? সুপারহিট ব্যবসা!
স্টাইলের অন্য নাম সালমান
মুক্তোঝরা হাসি আর নির্মল চলনের নায়ককে প্রথম ছবিতেই দর্শকেরা ভালোবেসে ফেলেন। তবে এরপরের ছবিগুলো অর্থাৎ শাবনুরের সাথে ‘তুমি আমার’ ও ‘সুজন সখী’ (১৯৯৪) , মৌসুমির বিপরীতে ‘অন্তরে অন্তরে’ (১৯৯৪) দিয়ে ঢালিউডে রোমান্টিক নায়ক হিসেবে পাকাপাকি অবস্থান গড়ে তোলেন সালমান। ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার সুপুরুষ সালমান শাহ্ হার্টথ্রবের তকমাও পেয়ে যান দ্রুত। তবে এর আগেই কিন্তু বিয়েটা সেরে ফেলেন ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট, সামিরার সাথে। তবে প্রথম ছবি মুক্তির আগে বিয়ে নিয়ে বেশ আপত্তি ছিল পরিচালক সোহানুর রহমানের।
সালমানের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা ছিল তাঁর স্বাতন্ত্র্য। অভিনয়ে বা স্টাইলে কাউকে অনুকরণ না করে নিজেকেই পরিণত করেন স্টাইল আইকনে। ব্যাক ব্রাশ চুল কিংবা টুকরো ঝুঁটি –সব চুলের স্টাইলই ছিল সালমানের স্বকীয়তার প্রমাণ। হাফ হাতা পোলো টি শার্ট, রঙিন টুপি, স্কার্ফ, গোল সানগ্লাস, কানে দুল, গলায় চেন সব মিলিয়ে ভিন্ন রকম কিন্তু নিজস্ব ধারার সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। সমসাময়িক নায়কদের তুলনায় বেশ এগিয়ে ছিলেন সজ্জার দিক থেকে। সেজন্যই বোধয় এখনো বাংলা চলচ্চিত্রে সবচেয়ে স্টাইলিশ নায়ক হিসেবে মানা হয় সালমানকেই ।
মুখরিত জীবন
চলচ্চিত্রে মৌসুমির বিপরীতে যাত্রা শুরু হলেও মাত্র চারটি ছবিতে তাদের দেখা গেছে জুটিবদ্ধভাবে। অন্য ছবি তিনটি হল অন্তরে অন্তরে (১৯৯৪), স্নেহ (১৯৯৪) ও দেনমোহর (১৯৯৫)। শিবলী সাদিক পরিচালনা করেন ‘অন্তরে অন্তরে ‘, ‘স্নেহ ‘পরিচালনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও ‘দেনমোহর ‘এর পরিচালক শফি বিক্রমপুরী । জুটি ভাঙার কারণ ছিল একটাই, দর্শকেরা যেন এক জুটিতে বড্ড অভ্যস্ত হয়ে না পড়ে। সে জায়গায় সালমান একটা বড় মুশকিলে পড়েন। তবে এর সমাধান আসে আরেক নতুন মুখ ‘শাবনুরে’র হাত ধরেই। এই যুগলকেও সাদরে নেয় দর্শক। এর বাইরেও শাবনাজ, লিমা,কাঞ্চি, সোনিয়া, শিল্পী, শামা প্রমুখের বিপরীতেও কাজ করেন তিনি।
মোটে চার বছর! চার বছর সময়টা কম মনে হলেও এই অল্প সময়েই কোটি জনতার হৃদয়ে আসীন হতে পেরেছিলেন এই ক্ষণজন্মা অভিনেতা। মাত্র ২৭ টি ছবি আর গুটিকয় নাটক, বিজ্ঞাপনে কাজ করেই ব্যাপক সাড়া জাগান সালমান। সর্বাধিক ১৪ টি ছবিতে শাবনুরের সাথে জুটি বেঁধে কাজ করেন তিনি।
সালমান অভিনীত ছবিগুলো হলো– কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩),তুমি আমার (১৯৯৪), অন্তরে অন্তরে (১৯৯৪),সুজন সখী (১৯৯৪),বিক্ষোভ (১৯৯৪) ,স্নেহ (১৯৯৪), প্রেমযুদ্ধ (১৯৯৫) কন্যাদান (১৯৯৫)দেনমোহর (১৯৯৫),স্বপ্নের ঠিকানা (১৯৯৫), আঞ্জুমান (১৯৯৫), মহামিলন (১৯৯৫), আশা ভালোবাসা (১৯৯৫),বিচার হবে(১৯৯৬),এই ঘর এই সংসার (১৯৯৬), প্রিয়জন (১৯৯৬),তোমাকে চাই (১৯৯৬),স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬),সত্যের মৃত্যু নেই (১৯৯৬),জীবন সংসার (১৯৯৬),মায়ের অধিকার (১৯৯৬), চাওয়া থেকে পাওয়া (১৯৯৬) প্রেম পিয়াসী (১৯৯৭), স্বপ্নের নায়ক(১৯৯৭), শুধু তুমি (১৯৯৭),আনন্দ অশ্রু (১৯৯৭),বুকের ভেতর আগুন (১৯৯৭)।
এছাড়াও কোকাকোলা, ফান্টা, জাগুয়ার, কেডস, গোল্ড স্টার টি, মিল্ক ভিটা প্রভৃতির বিজ্ঞাপনে দেখা যায় তাঁকে।
ভালোবাসার সালমান
নবাগতা আরিফা পারভিন মৌসুমির সাথে প্রথম স্ক্রিন শেয়ার করেই তরুণদের রোমান্টিক আইকনে পরিণত হন প্রচ্ছন্ন সাবলীল এই অভিনেতা। এর সাথে যোগ হয় অসাধারণ কিছু প্রেমের গান। এখন তো সময়, ও আমার বন্ধু গো, তুমি মোর জীবনের ভাবনা, এ জীবনে যারে চেয়েছি, তুমি আমায় করতে সুখী জীবনে, কিছু কিছু মানুষের জীবনে, ভালো আছি ভালো থেকো, পৃথিবীতে সুখ বলে, ও সাথীরে, বৃষ্টিরে বৃষ্টি প্রভৃতি গান এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামতে’র সুবাদে প্রথম দিকে সালমানের বেশিরভাগ গানই গাইতেন আগুন। পরে অবশ্য এন্ড্রু কিশোর, অমিত কুমারের কণ্ঠেও ঠোঁট মেলান।
বিষাদের ঢেউ
বাংলা চলচ্চিত্র তখন ক্রমশ হিন্দি ছবির সাথে পাল্লা দিয়ে ক্লান্ত। নতুন– প্রতিশ্রুতিশীল অভিনেতা পাওয়াও ছিল দুষ্কর। এর মাঝে সালমানের আগমন এক পশলা বৃষ্টির মতোই ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এক ট্র্যাজেডিতে বদলে যায় পুরো গল্প।
১৯৯৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘প্রেমপিয়াসী’ ছবির ডাবিং করতে যান সালমান শাহ। সেখানে তাঁর সহশিল্পী ছিলেন নায়িকা শাবনূর। সেদিন রাতেই স্ত্রী সামিরার সাথে দ্বন্দ্ব তুমুলে ওঠে। তৃতীয় ব্যক্তির সাহায্যে সাময়িক মীমাংসা হলেও পরদিনই ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ৬ সেপ্টেম্বর সকালে ‘তুমি শুধু তুমি’ ছবির শুটিংয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সালমান ঘুমাতে থাকেন। এর মাঝে প্রযোজক সিদ্দিক ও বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী এসে দেখা না পেয়ে ফিরে যান। সকাল ১১ টায় সালমান চা এবং পানি খেয়ে ড্রেসিং রুমে ঢোকেন। ১১:৪৫ অব্দি সাড়া না পেয়ে স্ত্রী সামিরা, কাজের লোক আবদুল দরজা খুলে ঢোকার পর তাঁকে সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান। এরপর সালমানের পরিবারের সদস্যগণ তাঁকে প্রথমে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
মৃত্যু নিয়ে প্রথম থেকেই বেশ জল ঘোলা ছিল। আত্মহত্যা হিসেবে বলা হলেও অধিকাংশেরই ধারণা এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। অনেকের মতে, প্রযোজকদের সাথে মতের মিল না থাকাই কাল হয়েছিল সালমানের। বেশ কবার এই জগত ছেড়ে দেবার কোথাও ভেবেছিলেন তিনি। তবে সবচেয়ে বড় বিতর্ক জন্ম দেয় তাঁর স্ত্রী সামিরা। ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই, পরিচালক বাদল খন্দকার, অভিনেতা ডনকে বিভিন্ন সময়ে সামিরার ঘনিষ্ঠতা থাকার ইঙ্গিত উস্কে দিয়েছে রহস্যকে। শাবনুরের সাথে সালমানের গভীর সম্পর্ক নিয়েও আছে বিতর্ক। তৎকালীন সময়ে রিজভি নামক এক ব্যক্তি হত্যার সাথে সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারে সাক্ষাতকারও দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে রুবি সুলতানা ,যিনি এককালে সামিরার বিউটি পার্লারে কাজ করতেন, ফেসবুক লাইভে সালমানের মৃত্যু নিয়ে আরও ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেন। শেষকালে অবশ্য আমলে নেয়া হয়নি তাঁর জবানি। সালমানের পরিবার এবং স্ত্রী সামিরার পরিবার একে অপরকে দোষারোপ করলেও আজ পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তে আসেনি আদালত।
অফ দ্য রেকর্ড
রোমান্টিক নায়ক হিসেবে পরিচিত হলেও ‘বিক্ষোভে’ সাহসী যুবক, ‘এই ঘর এই সংসারে’ দুরন্ত ভাই, ‘আনন্দ অশ্রু’র মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণ, ‘প্রেমযুদ্ধে’র স্নেহময় পিতা সব চরিত্রেই সমান পারদর্শী ছিলেন সালমান।
প্রতি ৭৬ বছর পরপর হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাব হয়। সালমান শাহ্ও ছিলেন সেই আকস্মিক ধূমকেতু। অল্প সময়ে, অল্প কাজের মধ্য দিয়ে দর্শকদের মন জয় করে নেয়ার রেকর্ড বোধহয় আর কারো নেই! নব্বইয়ের দশকে তরুণ– যুবার স্টাইল আইকন হয়ে ওঠা মানুষটার আপাদমস্তক মোড়ানো ছিল তুখোড় ব্যক্তিত্বে। মৃত্যুর রহস্য এতদিন পরেও আঁধারে মোড়া থাকলেও দর্শক হৃদয়ে তাঁর স্মৃতি আজও অম্লান।