২০০২ সালের নভেম্বর মাস। দক্ষিণ-পূর্ব চীনের গুয়াংজং শহরের ডাক্তাররা প্রথম নতুন একটি ভাইরাসের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হন। পরবর্তীতে যার নাম দেয়া হয় সেভেয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম বা সার্স ভাইরাস। পরের কয়েক মাসে ২৬ টি দেশের ৮ হাজার ৯৬ জন ব্যক্তি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন, যার মাঝে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়। শুরুর দিকে এই ভাইরাস সম্পর্কে জানা না থাকায় এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহায়তায় খুব দ্রুতই এর লাগাম টেনে ধরা সক্ষম হয়।
ঠিক কি কারণে এই ভাইরাস নিয়ে শুরু থেকে জানাশোনা ছিল না সে নিয়ে আসলে নানা রকম মত প্রচলিত আছে। ডাক্তাররা আসলে এই ধরনের ভাইরাল অসুস্থতা নিয়ে আগে থেকে কিছুই জানতেন না। প্রথমদিকে গুয়াংজং শহরের ডাক্তারদের মাঝে ধারণা ছিল এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা সাধারণ কোন নিউমোনিয়ার রোগী।
মিশিগান ইউনিভার্সিটির রোগবিস্তার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক আর্নল্ড মন্টো বলেন, “কেউই এই রোগ নিয়ে কিছুই জানতো না, এমনকি সম্ভবত বেইজিং এর মানুষরাও না।“ কিন্তু যখন তারা বুঝতে পেরেছিলেন এটা সম্পূর্ণ নতুন একটি রোগ তখনো বেশ কদিন তারা বিষয়টি নিজেদের মাঝেই রেখেছিলেন, যা পরবর্তীতে বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এছাড়াও ধারণা করা হয় বেইজিংয়ের প্রশাসনিক কর্তারা আসল রোগ নিয়ে কিছু জানাতে ডাক্তারদের বাঁধা প্রয়োগ করেন। ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে বেইজিং সামরিক হাসপাতালের ডাক্তার জিয়াং ইয়ানইয়ং টাইম ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি পাঠান, যাতে তিনি দাবী করেন, সরকারি হিসেবের তুলনায় মূলত বেইজিং শহরে সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।
চীন থেকে হংকংয়ে সার্স ভাইরাস
২০০৩ এর ফেব্রুয়ারিতে সার্স পৌঁছে যায় চীন থেকে হংকংয়ে। গুয়ানডং-এর মেডিক্যাল প্রফেসর লিউ জিয়ানলুন সার্সের তৎকালীন ব্যাপ্তি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। তাই নির্দ্বিধায় তখন হংকংয়ের মেট্রোপোল হোটেলের রুম নং ৯১১-এ গিয়ে উঠেন। ৬৪ বছর বয়সী সেই প্রৌঢ় প্রফেসর কয়েকদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও দুই সপ্তাহের মাথায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হোটেলে বেশী দিন না থাকলেও ধারণা করা হয় তিনি অন্য হোটেলে অবস্থিত কোন ব্যক্তির মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেই হোটেলে থাকা ব্যক্তিদেরকে সিঙ্গাপুর, টরেন্টো এবং হানোই থেকে শনাক্ত করা হয়। যাদের সবাই সার্স আক্রান্ত ছিলেন।(জনসাধারণের ভীতির কারণে পরবর্তীতে রুমটির নাম পরিবর্তন করে ফেলে হোটেল কর্তৃপক্ষ)
বিজ্ঞানীরা তখনও বুঝতে পারছিলেন না কোন জৈবিক কারণে ভাইরাসটি কাউকে আক্রান্ত করতে পারছে। যার দরুণ একই পরিস্থিতিতে থেকে কেউ আক্রান্ত হচ্ছিলেন, আর কেউ নয়। এটাই সার্স সংক্রমণের অন্যতম রহস্য ছিল।
কোয়ারেন্টিনেই থামলো সার্স
সার্সের মত অসুস্থতা সহজেই জনমনে আতঙ্ক তৈরি করতে পারে কারণ এতে অনেক কিছুই আমাদের অজানা থেকে যায়। শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা জানতেনই না তারা কি এই ভাইরাসকে একেবারেই দমিয়ে ফেলতে পারবেন নাকি এটি অন্যান্য ফ্লুয়ের মত, যা প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে পৃথিবী থেকে। সৌভাগ্যক্রমে ডাক্তার আর বিজ্ঞানীরা সার্স ভাইরাসকে চিরতরে নির্মূল করতে সক্ষম হন ছোট্ট একটি পদক্ষেপ দিয়ে। তারা আক্রান্ত সব রোগীকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলেন। রোগীদের ঠিক ততদিন পর্যন্ত আলাদা করে ফেলা হয়ছিল যতদিন না তারা ভাইরাসটিকে দূরে সরাতে পারছেন। তারা কোয়ারেন্টিনের মাধ্যমে নিশ্চিত করেন যেন আক্রান্ত রোগীদের দ্বারা নতুন কেউ সংক্রমিত না হয়।
তবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এক্ষেত্রে বড় একটি ভূমিকা রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আইসোলেটেড এবং কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের সহায়তায় ২০০৩ সালের জুলাই মাসের মাঝেই সার্স ভাইরাসের লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছিল।
সার্স ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল চীন এবং হংকং। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চীনে ৫ হাজার ৩২৭ জন রোগীর মাঝে ৩৪৯ জনের মৃত্যু হয়। আর হংকংয়ে ১ হাজার ৭৫৫ জনের মাঝে ২৯৯ জনের মৃত্যুর হয়। সার্সের এই ছড়িয়ে পড়া থেকে চীন এই শিক্ষা নিয়েছিল যে ভবিষ্যতে রাজ্যগুলোর সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বচ্ছতা আরো অনেকবেশি বৃদ্ধি করা দরকার।
সার্স ভাইরাস এবং আমাদের শিক্ষণীয় দিক
“সার্স ভাইরাস একটা সংকেত ছিল যে, পরিস্থিতি আসলে কতটা খারাপ হতে পারে।“ মিশিগান ইউনিভার্সিটির রোগবিস্তার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক আর্নল্ড মন্টো বলেন আরো বলেন, “ছোট ছোট এ ধরনের সংক্রমক রোগ নিয়ে চীন আরো বছর পনের আগে থেকেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করছিল। যেমন অ্যাভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা, যা খুব বেশি ছড়িয়ে পড়েনি কিন্তু চীনে বারবার দেখা যেত।“
ইবোলা ভাইরাস এবং মহামারী বিশেষজ্ঞ অ্যানি রিমোইন এর মতে, সার্সের ফলে মহামারি নিয়ে বৈশ্বিক প্রস্তুতির মাত্রা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, “সার্স সংক্রমণের পর থেকে আমরা আরো কিছু সংক্রমক রোগের দেখা পেয়েছি। আমরা মার্স ভাইরাস দেখেছি, সোয়াইন ফ্লু দেখা দিয়েছে, আমরা চিকুনগুনিয়া দেখতে পেয়েছি। আমাদের জিকা সংক্রমণ দেখতে হয়েছে এবং তারপর থেকে আমাদের বেশ কিছু ইবোলা সংক্রমণ দেখতে হয়েছে। তাই আমার মনে হয়, পুরো বিশ্ব সম্মিলিতভাবে আগের চেয়ে ভালভাবে মহামারি নিয়ে সাড়া দিচ্ছে।
বর্তমানে পুরো বিশ্বে চীন থেকেই ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের তাণ্ডব চলছে। সার্স থেকেও অনেক বেশি আকারে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস এরই মাঝে সারা বিশ্বে কেড়ে নিয়েছে ১ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ। সার্স ভাইরাস দমনে ২০০৩ সালে সময় লেগেছিল প্রায় ৯ মাস। কোভিড ১৯ সংক্রমণের ৯ মাস এখনো পূর্ণ হয়নি। কিন্তু এটি এখনই সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। পৃথিবী কি পারবে সার্সের মত একে সরিয়ে ফেলতে? নাকি স্প্যানিশ ফ্লু বা প্লেগের মত আরো একটি কাল দাগ বসবে পৃথিবীর ইতিহাসে? জবাবটা আপাতত সময়ের হাতেই বন্দী।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ