আমেরিকার প্রতিটি সংকট সমস্যায় হাস্য কৌতুক করে, ভারী পরিস্থিতিকে তারা হালকা করার চেষ্টা করে। ভয়াল সেপ্টেম্বর ইলেভেনের ঘটনা থেকে শুরু করে স্কুল কলেজে বন্দুকের গুলীতে হতাহত হলেও এসব চৌকস হাস্য কৌতুক বন্ধ হয়না ।
আমেরিকার বিমানবন্দরে জুতার মধ্যে বোমা পাওয়ার পর থেকেই আইন বদলে গেলো। বিমান বন্দরে এখন জুতা খুলে নিরাপত্তা পাড়ি দিতে হয়। আমেরিকার স্কুলগুলোতে আর কতো হত্যাকাণ্ডের পর অগ্ন্যেয়াস্ত্র আইনের পরিবর্তন ঘটবে? স্কুল কলেজে অগ্নেয়াস্ত্রধারীর হামলা ঠেকাতে কলেজ শিক্ষার্থীদের সংগে বন্দুক রাখা, স্কুল কলেজের শিক্ষকদের কাছে বন্ধুক রাখার আজগুবি সব প্রস্তাব উঠেছে। শিক্ষার্থীদের হাতে বন্দুক রাখার অনুমতি দিলে, বন্দুক বিষয়ক পরীক্ষায় সবাই যে “এ” পাবে এ নিয়ে আমেরিকার কমেডিয়ানরা একমত।
অবশ্য আমেরিকায় থাকা আমাদের প্রবাসীরা একমত নন দেশের সমস্যা সবংকট নিয়ে করা কৌতুকে । ডাঃ জাফর ইকবালের উপর হামলা হয়েছে। বাংলাদেশের মতো প্রবাসেও মুক্তবুদ্ধির লোকজন দ্রুত প্রতিবাদ করেছেন। নারকীয় এ হামলার মাধ্যমে দেশের মুক্তবুদ্ধির লোকজনের স্বাভাবিক চলাচল নিয়ে উৎকণ্ঠিত প্রবাসীরা। এরমধ্যেও আমেরিকার ঢেউ দেখা গেলো এ সংক্রান্ত কথাবার্তায় । কেউ বলেছেন , নিজের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা হালকা করতে। কেউ মন্তব্য করছেন, স্বভাবসুলভতায় ।
হুজুর টাইপের এক প্রবাসী। আমেরিকায় মত প্রকাশের স্বাধীনাতা নিয়ে তার টানটান সচেতনতা। শাহাজাল ইউনিভার্সিটিতে ডঃ জাফর ইকবালের উপর হামলার খবর পেয়ে তাঁর মন্তব্য, নাস্তিক লোক হামলার শিকার হতেই পারে আস্তিকদের হাতে। সব ঘটে আল্লাহর ইচ্ছায়। তাঁর ইচ্ছা আর হুকম ছাড়া গাছের পাতাটিও নড়ে না। আল্লাহ আমাদের বিশ্বাসীদের হেফাজত করবেন।
সিলেটী এক প্রবাসী বলছেন, বেঙ্গলিনতে সিলট ভরি গেছে । ইউনিভার্সিটি করছো । সিলটি মাস্টর পাওনানি রে বাবা। সেলটি মাস্টর অইলেতো এমন ওইলোনা অনে ।
সরকার সমর্থক এক প্রবাসীঃ বলার অপেক্ষা রাখেনা- এ ঘটনার পেছনে বি এন পি জামাতের চাল রয়েছে। পাকিস্তানেরও হাত আছে । এরাই দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করতে ষড়যন্ত্র করছে। এদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবী ডঃ জাফর ইকবাল। স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকে নির্মূল করতে হবে।
বি এন পি সমর্থক প্রবাসীর মন্তব্য , বর্তমান সরকারের আমলে দেশমাতা, দেশভ্রাতা- কেউ নিরাপদ নয়। এমনকি একজন নিরাপরাদ শিক্ষকও নিরাপদ নয়। আগামী ঈদের পর দেশ জুড়ে সরকার উৎখাতের আন্দোলনে নামতে হবে।
প্রবাসী’র এক আরব সহকর্মি ঘটনা শুনে মন্তব্য করলেন, ব্রাদার- এ সব ইহুদীদের ষড়যন্ত্র। আমাদের মুসলমান ভাইদের মধ্যে মারামারি লাগানোর জন্যই ইহুদীদের ষড়যন্ত্রে এমন আক্রমণ হয়েছে।
আমেরিকা প্রবাসীর এক কৃষ্ণাঙ্গ সহকর্মী ঘটনা শুনে মন্তব্য করলেন, ঘটনা ঘটলেই ভিড়ের মধ্যে কালো চামড়ার লোকটিকে অভিযুক্ত করতে হবে কেন? হামলার ভিডিও কই ? ফয়জুলের চামড়া কালো বলেই অভিযুক্ত সে- মন্তব্য কৃষ্ণাঙ্গ লোকটির ।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থক এক প্রবাসীর মন্তব্য , আমাদের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ফর্মূলা বোঝার ক্ষমতা অন্যদের নাই। ট্রাম্পের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষকদের হাতে বন্দুক থাকলে এমন ঘটনা ঘটতই না । ডঃ জাফর ইকবাল ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটির উপর বন্দুক চালাতে পারতেন। তা ছাড়া , বন্দুকধারী জাফর ইকবালকে ভোঁতা ছুরি দিয়ে হামলার সাহসই পেতোনা লোকটি।
সব শুনে প্রবাসীর অষ্টম গ্রেডের ছেলের মন্তব্য, শিক্ষকের উপর হামলার পর স্কুল তাহলে বন্ধ? স্টুডেন্টস আর সো লাকি !
এসবই হাস্য কৌতুক । সমস্যা হলো দেশের একজন বিদগ্ধ নাগরিক হামলার শিকার হওয়ার পর দেশের মতো প্রবাসেও দেখা গেছে স্বদেশীদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। ডঃ জাফর ইকবালের প্রতি ভালোবাসা জানাতে , তাঁর পরিবারে প্রতি সহমর্মীতা জানাতে প্রবাসের লোকজন কাজ কর্ম ফেলে নাগরিক শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েছেন। প্রতিটি শোভাযাত্রা আর মানববন্ধন থেকে হামলাকারীর প্রতি ধিক্কার ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে। এর পেছনে সঙ্ঘবদ্ধ গোষ্টির হাত রয়েছে, এমন আশংকার কথা উচ্চারিত হয়েছে প্রবাসের সমাবেশ গুলো থেকে। মুক্তবুদ্ধির লোকজনের উপর হামলাকারীদের সমূলে নির্মূল করার জন্য সরকারের প্রতি দাবী উঠেছে।
যদিও কিছু প্রবাসীকে ইনিয়ে বিনিয়ে মন্তব্য করতে দেখা গেছে। নিন্দা জানালেও, যদি- কিন্তু দিয়ে এসব লোকজন তাদের আত্মপরিচয় লুকিয়ে রাখতে পারেনি। এসব ইনিইয়ে, বিনিয়ে, যদি- কিন্তুর মন্তব্য শুনলে, দেখলে, আমাদের ভাবিত হওয়ার বহু কারণ আছে । চিন্তায় ও সংস্কৃতিতে আমাদের দেশের লোকজন আজ বহুভাগে বিভক্তির চিত্রই ফুটে উঠে। একজন শিক্ষকের উপর হামলার পর, চরম শঙ্কট আর নারকীয় ঘটনার পর অনেকের কদর্য বা অনুদার মন্তব্য আমাদের পশ্চদপদতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের এক শ্রেনীর স্বদেশীর এ নির্লজ্জ্ব পশ্চাদপদতা আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দেয়। আমাদের সামনে চলাকে ব্যাহত করে । জাটি হিসেবে আমাদের আলোর অভিযাত্রায় এক শক্ত কৃষ্ণপক্ষ আমাদের যে তাড়া করছে- তা স্মরণ করে দেয়। আমাদের আরো সাবধান হতে হবে, আরও হিসেব করে এগুতে হবে। সামনে আরো কঠিন সময় আমাদের।
-ইব্রাহীম চৌধুরী
সাংবাদিক ও লেখক।