“আমার নেতিবাচক খবর মানুষ খায় ভালো, নেয়ও ভালো”1 min read
Reading Time: 5 minutesনিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান। খ্যাতি, অর্থ, যশে তার ধারের কাছে যেমন কেউ নেই, ঠিক তেমনি বিতর্ক তৈরিতেও সাকিব অদ্বিতীয়। ২০১১ বিশ্বকাপের আগে সেসময়ের কোচ জেমি সিডন্সের সাথে সুর মিলিয়ে খোলাখুলিভাবে মাশরাফি বিন মর্তুজার ফিটনেসের ব্যাপারে মন্তব্য করা, সাবেক ক্রিকেটারদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা, বাংলাদেশের ভেজাল ফলমূল নিয়ে মন্তব্য করা দিয়ে বিতর্কের পথে সাকিবের যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকে এখন অবধি কারণে-অকারণে সাকিব বিতর্কিত হয়েছেন। সাকিবের ক্যারিয়ায়ের আলোচিত বিতর্কিত ঘটনাগুলো আজ আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিবো।
তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা
মাঠের বাইরে সাকিবের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন বছর ছিল ২০১৪। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে ড্রেসিং রুমে বসে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে অশোভন অঙ্গভঙ্গি করেন সাকিব। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বিসিবির শৃঙ্খলা কমিটির শুনানিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা না করে সরাসরি নিজের ভুল স্বীকার করে নেন তিনি। বিসিবি সাকিবকে তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি তিন লাখ টাকা জরিমানা করে।
ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগ ও সাকিবের খেলা ছাড়ার হুমকি
২০১৪ সালের জুনে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ চলাকালীন সময়ে স্ত্রীকে উত্যক্ত করা এক দর্শককে পিটিয়ে সংবাদের শিরোনাম হন সাকিব। এই সিরিজের পরপরই সাকিব বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান আকরাম খানের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগ খেলতে রওনা দেন। কিন্তু অভিযোগ ওঠে সাকিব বিসিবির অনাপত্তিপত্র না নিয়েই খেলতে গেছেন। যার ফলাফলে বোর্ডের ডাকে সাকিবকে মাঝ পথেই লন্ডন থেকে দেশে ফিরতে হয়।
এর আগে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগ খেলতে যাওয়া নিয়ে কোচে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সাথেও বাদানুবাদ হয় সাকিবের। কোচ চাচ্ছিলেন সাকিব ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগ পুরোটা না খেলে যেন দেশে এসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের প্রস্তুতি ক্যাম্পে যোগ দেন। আর সাকিব চাচ্ছিলেন ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগ খেলে সরাসরি ওয়েস্ট ইন্ডিজেই দলের সাথে যোগ দিতে।
কোচের সাথে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে সাকিব কোচের সামনে টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার হুমকি দেন। সাকিবের এসব কথা হাথুরুসিংহ ইমেইল করে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কাছে পৌছে দেন।
লন্ডন থেকে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে নেমে সাকিব তাকে ঘিরে চলমান সকল বিতর্ক নিয়ে মন্তব্য করেন। সাকিব জানান, তিনি আকরাম খানের মৌখিক অনুমতি নিয়েই ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগের খেলতে গিয়েছিলেন। এতে সাকিবের চেয়ে বিসিবির দোষটিই তখন দৃষ্টিকটু ভাবে সবার নজরে আসে। আর হাথুরুসিংহ বিতর্ক নিয়ে সাকিব বলেন, এক ঘরে থাকলে কিছু ঝগড়া-বিবাদ ভুল বোঝাবুঝি হবেই। আবেগের বসেই খেলা ছাড়ার কথা বলেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের হয়ে খেলতে চান আরও অন্তত দশটি বছর।
ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা
দর্শককে পিটানো, অনাপত্তিপত্র না নিয়ে খেলতে যাওয়া, ভারত সিরিজ চলাকালীন সময়ে অনুমতি না নিয়ে হোটেল রুম পরিবর্তন করা, কোচের সাথে বাদানুবাদ- এমন সব অভিযোগ মিলিয়ে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই সাকিবকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করে বিসিবি। সেই সাথে দেড় বছর সাকিবকে দেশের বাইরে কোন টুর্নামেন্ট খেলতে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট দেবে না বলে জানায় বিসিবি। সাকিবের এই বহিষ্কারাদেশের বিপক্ষে বঙ্গদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ নিজেদের কলম চালিয়ে সাকিবের পক্ষে পত্র-পত্রিকার উপসম্পাদকীয় কলামে ঝড় তোলেন। পরবর্তীতে সাকিবের আবদনের প্রেক্ষিতে শাস্তি কিছুটা লাগব করে বোর্ড।
বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সাকিবের শাস্তি প্রসঙ্গে সেসময় গণমাধ্যমকে বলেন, “এটি কেবল এ ঘটনার (ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগের খেলতে যাওয়ার) শাস্তি নয়, বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনার ফল। তার এসব কাণ্ড দলের পারফরম্যান্সের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ওর দেখাদেখি অন্যরাও এমনটা করার সাহস পাচ্ছে। সাকিবের মারাত্মক আচরণগত সমস্যা আছে। যেন কাউকে সে পরোয়া করে না। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি”
তিনি আরও যোগ করেন “হঠাত্ সে এমনটা করেনি। সব সময়ই করছে। দেশের মূল খেলোয়াড় বলে আমরা এত দিন বিষয়গুলো উপেক্ষা করেছি। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সে কোচ-অধিনায়ক কারও কথা মানে না।”
আরও পড়ুন- ২০১৯- ক্রিকেটে সাকিবময় একটি বছর
নিদাহাস ট্রফি
২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কা, ভারত আর বাংলাদেশকে নিয়ে নিদাহাস ট্রফি নামে একটি টি-২০ টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। এই টুর্নামেন্টের ষষ্ঠ ম্যাচে শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশকে ১৫৯ রানের টার্গেট দেয়। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের হাত ধরে বাংলাদেশ প্রায় জয়ের কাছাকাছি পৌছে যায়।
ম্যাচের শেষ ওভারে জয়ের জন্য বাংলাদেশের দরকার ছিল ১২ রান। শেষ ওভারের প্রথম বলটি ছিল বাউন্সার। পরের বলটিও একই রকম বাউন্সার। এই বলে রান আউট হন স্ট্রাইকে থাকা মুস্তাফিজুর রহমান। আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী এক ওভারে একটি বাউন্সার বৈধ। কিন্তু মাঠের আম্পায়াররা দ্বিতীয় বলটি নো দেননি। এতে সাকিব ক্ষিপ্ত হয়ে চতুর্থ আম্পায়ারের সাথে বাকযুদ্ধে লিপ্ত হন এবং মাঠে থাকা বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের ফিরে আসতে বলেন। বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজন খেলোয়াড়দের মাঠ থেকে বের হতে না করলে পরিস্থিতি কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়। পরে ৪ বলে ১২ রানের সমীকরণে দাড়িয়ে মাহমুদুল্লাহর ব্যাটে অবিশ্বাস্য এক জয় পায় বাংলাদেশ।
মাঠে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত যেখানে চূড়ান্ত, সেখানে সাকিবের এমন অপরিণত আচরণ তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। ভারত-শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা অনলাইনে মেতেছিলেন কঠিন তর্ক যুদ্ধে।
২০১৯ বিশ্বকাপের দলীয় ফটোসেশনে অনুপস্থিতি
২০১৯ বিশ্বকাপের আগে দলীয় ফটোসেশনে সাকিব ছিলেন অনুপস্থিত। ফটোসেশনের দিন মিরপুরের মাঠে উপস্থিত থাকলেও ফটোসেশনের ঘন্টাখানেক আগে সাকিব সেখান থেকে বেরিয়ে যান। আবারও শুরু হয় বিতর্ক। পরে জানা যায় সাকিব ফটোসেশনের কথা জানতেন না।
বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সংবাদ মাধ্যমকে পরবর্তীতে জানান, “রাতে সে (সাকিব) আমার বাসায় এসেছিল। বলল ‘মেসেজ পেয়েছি কিন্তু পড়িনি। জানতাম না যে ওখানে ফটোসেশন আছে।’ তবে আমি যেটা জেনেছি, ওকে জানানো হয়েছে। ও বলছে না যে জানানো হয় নি। বলছে ‘যে চিঠিটা পাঠানো হয়েছিল সেটি সে পড়ে দেখেনি।’”
কারণ দর্শাও নোটিশ
২০১৯ সালের অক্টোবরে ক্রিকেটারদের দাবি দাওয়ার নেতৃত্ব দিয়ে সাকিব এমনিতেই আলোচনায় ছিলেন। এসব ডামাডোলের মধ্যেই সাকিবের বিরুদ্ধে বিসিবির চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। বিসিবির সঙ্গে ক্রিকেটারদের চুক্তি অনুযায়ী জাতীয় দলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকা কোন ক্রিকেটার টেলিকম কোম্পানিদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে চুক্তি করতে পারবেন না। কিন্তু সাকিব এই চুক্তি ভঙ্গ করে বিসিবিকে না জানিয়ে গ্রামীণ ফোনের সাথে স্পন্সরশিপ চুক্তি করে।
সাকিবকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে তাকে কারণ দর্শাও নোটিশ পাঠায় বিসিবি। কিন্তু পরবর্তীতে আইসিসি কর্তৃক সাকিবের নিষেধাজ্ঞায় ব্যাপারটি চাপা পড়ে যায়।
ফিক্সিং বিতর্ক
২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর এক জুয়াড়ির সাথে যোগাযোগ করার তথ্য গোপন করার দায়ে সাকিবকে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ মোট দুবছরের নিষেধাজ্ঞা দেয় আইসিসি। আইসিসি প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে আগারওয়াল নামের এক ভারতীয় জুয়াড়ি সাকিবের সাথে যোগাযোগ করেন। সাকিব আগে থেকেই জানতেন যে আগারওয়ালের কাছে তার ফোন নম্বর দেয়া আছে। আগারওয়াল সাকিবকে দেখা করার অনুরোধ করেন এবং আরও কিছু ক্রিকেটারের ফোন নম্বর সাকিবের থেকে চান।
এরপর আরও কয়েক দফায় আগারওয়াল সাকিবের সাথে যোগাযোগ করেন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের মধ্যে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজ ও ২০১৮ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ বনাম কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের একটি ম্যাচে দুর্নীতির প্রস্তাব দেয়া হয় সাকিবকে।
সাকিব ফিক্সিং এ অংশ না নিলেও ফিক্সিং এর প্রস্তাব পাওয়ার বিষয়টি আইসিসি কিংবা বিসিবি জানাননি, যেটি আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
দীর্ঘ তদন্ত এবং জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আইসিসিরি অ্যান্টি করাপশন কোড লংঘনের তিনটি অভিযোগ সাকিব আল হাসান স্বীকার করে নেন।
আইসিসির দেয়া বিবৃতিতে সাকিব আল হাসান বলেন, “আমি খুব দুঃখিত, আমার নিষেধাজ্ঞার জন্য। আমি খেলাটি ভালোবাসি, তবে আমার বিরুদ্ধে আনা দায় আমি মেনে নিয়েছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইসিসির যে অবস্থান সেখানে আমি আমার দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পারিনি।”
উপসংহার
সাকিব বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সেরা খেলোয়াড়। ক্লাসের ভালো ছাত্র যেমন শিক্ষক, সমাজ থেকে আলাদা মর্যাদা পায়, সাকিবও দেশের সাধারণ মানুষ, হর্তা-কর্তা এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর থেকে বরাবরই বাড়তি সমাদর পেয়েছেন। মাঠে সাকিবের নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাকিব তার মাঠের “জেদ” কিংবা “না হারার” যোদ্ধা মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রেই বোর্ডের নিয়ম কানুনের বিপক্ষেও দেখান। টেস্ট খেলতে না চাওয়া, বিসিবির চুক্তি ভঙ্গ করে গ্রামীণ ফোনের সাথে চুক্তি এমন আরও অনেক বিষয়ে সাকিবকে নিয়ে বিসিবি বস নাজমুল হাসানের বিভিন্ন সময়ে করা মন্তব্যগুলোর দিকে তাকালে ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে।
আবার অনেক ক্ষেত্রেই সাকিবের সাফল্য, আত্মবিশ্বাস, জীবন যাপনের ধরণ, স্পষ্টভাবে কথা বলা ঈর্ষাকাতর বঙ্গসন্তানদের গাত্রদাহের কারণ হয়। সুযোগ পেলেই তারা সাকিবের ব্যক্তিজীবন, পরিবার নিয়ে আক্রমণ করে বসে।
২০১৮ সালে এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাকিব সতীর্থ ব্যাটসাম্যানদের ব্যর্থতা নিয়ে উপস্থাপককে মজার ছলে বলেন, “বাকি ব্যাটসম্যানদের জিজ্ঞেস করুন কেন তারা ভালো ব্যাট করতে পারলো না। সবার হয়ে তো আর আমি উত্তর দিতে পারবো না।”
যথারীতি সাকিবের এমন মন্তব্য ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। সাকিব এ ঘটনার ব্যাখায় বলেন, “ওখানে ব্যাটসম্যানদের কোন দোষ আসেনি। শুধু তাকে (উপস্থাপককে) বলেছি, ব্যাটসম্যানদের নেতিবাচক কিছু নয়, মজা করেই বলেছি। পুরো উত্তরটা তো আপনারা লিখবেন না, শুধু ওই নেতিবাচক জিনিসটা… কারণ আমার নেতিবাচক খবর মানুষ ভালো খায়, নেয়ও ভালো। আমিও পছন্দ করি। আমার কাছে মনে হয় এটা ভালো খেলতে একটু হলেও অনুপ্রাণিত করে।”
সাকিবের এই কথাটিই হয়তো সত্যি। সাকিবের নেতিবাচক খবর মানুষ পছন্দ করে। আর সাকিবেরও ভালো খেলার বাড়তি অনুপ্রেরণা হিসেবে “বিতর্ক” লাগে।