Site icon Bangla Info Tube

ক্ষমতার পদতলে পিষ্ট যখন সাংবাদিকতা

Reading Time: 3 minutes

তাদের কাজই সংবাদ সংগ্রহ করা। খবরের পিছনে নিরলস ছুটতে থাকা মানুষগুলো প্রতিনিয়ত সাধারণ জনগণকে জানাচ্ছেন নিত্যকার সব ঘটনা। কিন্তু সেই খবরের মানুষগুলোর খবর আসলে কজন রাখছে? সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তারিখ ৭০ বারের মত পিছিয়ে দেয়ার পর একসময় আদালতের কার্যতালিকা থেকেই বাদ পড়ে যায়। মধ্যরাতে জেলা প্রশাসকের আদেশে নির্যাতিত হন সাংবাদিক। কখনোবা মামলার আসামী বনে গিয়ে হতে হয় নিঁখোজ। সারাদেশে যখন করোনা বিস্তৃতি ছড়িয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, তখনও এই সাংবাদিকরা এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে যাচ্ছেন আতঙ্কটাকে একপাশে রেখে। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন জাগে, খবরের মানুষের খবর কে রাখে?

ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া হোক কিংবা অনলাইন পোর্টাল, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা দেখার জন্য যেন কেউই নেই। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত মফস্বল এলাকার সংবাদকর্মীরা। সম্প্রতি অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামের উপর করা নির্যাতনের পর শিউরে উঠেছেন অনেকেই। নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছেন সব স্তরের সাংবাদিক। কোন প্রকার পুলিশী উপস্থিতি ছাড়াই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ৭/৮ জনের দল নিয়ে করা হামলা হয় সাংবাদিক আরিফুলের উপর। স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে সেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দাবী করেন অভিযান চলাকালে তারা ঘটনাস্থল থেকে আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজার সন্ধান পেয়েছেন। এবং সাংবাদিক অপরাধ স্বীকার করায় তার জেল জরিমানাও নিশ্চিত করা হয়েছে।

কিন্তু সাংবাদিক পরিবারের দাবী ছিল ভিন্ন। সাংবাদিক আরিফুলের স্ত্রী মোস্তারিমা দাবি করেন, বাসায় কোন প্রকার তল্লাশীই সে রাতে হয়নি। কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানের সূত্রে জানা যায়, কুড়িগ্রাম ডিসি সুলতানা পারভীনের একটি পুকুর সংস্কার করে সেটি নিজের নামে করে নেয়ার চেষ্টায় ছিলেন। আরিফুল এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করার পর থেকেই পরেন ডিসির রোষানলে।

আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে মধ্যরাতে মোবাইল কোর্টের নামে সরাসরি সাংবাদিকের প্রতি হামলা কোনভাবেই সংবিধানের রক্ষা করেনা বলে মত দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট বিশিষ্ট আইনজীবী শাহেদীন মালিক। সারা দেশের গণমাধ্যম গুরুত্বের সাথে এই সংবাদ প্রকাশ করায় ডিসি নিজ উদ্যোগে আরিফুলের জামিনের ব্যবস্থা করেন। এরপর বেসরকারি এক টেলিভিশন চ্যানেল জামিন পাওয়া আরিফুলের সাথে ডিসির মোবাইল ফোনের কথোপকোথন প্রচার করে। সেই ফোনালাপ থেকে দেশবাসী পরিষ্কার বুঝতে পারে যে এই অপকর্ম ডিসির সরাসরি মদদেই হয়েছিল।

সাংবাদিক নির্যাতন এবং বিচারিক কার্যে গাফেলতি এবারই প্রথম নয়। ২০১০ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিম রাজাবাজারে নৃশংসভাবে খুন হন দেশের দুই জনপ্রিয় সংবাদকর্মী মেহেরুন রুনি এবং সাগর সরোয়ার। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘন্টার মাঝে দোষীদের খুঁজে বের করার ঘোষণা দিলেও আদতে তা বাস্তবায়ন হয়নি। এর মাঝে ২য় মেয়াদে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। মন্ত্রিসভায় হয়েছে একাধিক রদবদল। কিন্তু সেই হত্যামামলার অগ্রগতি তো হয়নি, বরং ধীরে ধীরে আদালতের কার্যতালিকা থেকি বাদ পড়েছে মামলাটি। অজস্র বিক্ষোভ আর প্রতিবাদের পরেও ফেরেনি সাংবাদিকদের অধিকার।

তেমনই আরেক শঙ্কা জেগেছে পাক্ষিক মহাকালের ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে ঘিরে। বিগত ১০ মার্চ নিজ অফিস থেকে বের হবার পর থেকেই নিখোঁজ রয়েছেন এই সাংবাদিক। পরিবারের দাবী তাকে গুম করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মহিলা যুবলীগ নেত্রী পাপিয়া কান্ডে যখন রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থির ঠিক সে সময়েই কাজলের অপহরণ ইঙ্গিত দিচ্ছে অনেক কিছু। কারণ অপহরণের ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ৯ মার্চ সাংবাদিক কাজল, দৈনিক মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান সহ মোট ৩২ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর শেরে বাংলা নগর থানায় একটি মানহানি মামলা করেন মাগুরা ১ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর।

এতকিছু ঘটে যাবার পরেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান, এ বিষয়ে তিনি মোটেই অবহিত নন। এখন পর্যন্ত কাজলের কোন হদিস পাওয়া যায় নি। তাকে খুঁজে বের করার আহ্বান জানানো হয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মোট ২২ বছরে দেশে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে সাংবাদিকদের প্রতি হুমকি এবং নির্যাতনের ঘটনাও কোনভাবেই বিরল নয়। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দাবী, সাংবাদিক নির্যাতনের বিচার হয়না বলেই মূলত ব্যাপক হারে সাংবাদিক নির্যাতন বেড়ে চলেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনকালীন সহিংসতার এক বড় টার্গেট হয়ে পড়েছেন বিভিন্ন সংবাদকর্মী। এছাড়া ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবীতে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময়েও প্রায় ৪০ জন সাংবাদিক আহত হবার খবর উঠে এসেছে। এছাড়া ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ এর কারণে ক্রমশ প্রতিকূল হয়ে উঠছে সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলছেন তারা। কিন্তু এত কিছু স্বত্তেও সরকারীভাবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিষয়ে উদাসীনতা রয়েছে সেই আগের মতোই।

সারাবিশ্বে যখন সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার পরিবেশ নিয়ে সুস্থ চর্চা চলছে তখন বাংলাদেশে বইছে উলটো হাওয়া। বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ সাংবাদিকই দিন কাটাচ্ছেন আতঙ্কে। যেকোন সময়ে যেকোন প্রকার হুমকি কিংবা হামলার ভয় তাড়া করছে তাদের। সত্যান্বেষী এই পেশার একটি বিরাট অংশ তাই ঝুঁকে পড়ছেন দলীয় এবং ব্যক্তিগত চাটুকারিতা ও হলুদ সাংবাদিকতার মত কাজে। যেখান থেকে মুক্তির পথটাও আপাতদৃষ্টিতে খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য।

বহুবছর আগে সুকান্ত ভট্টাচার্য গ্রামের রানারদের খবর না নেয়ার আক্ষেপে লিখেছিলেন,

“এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনদিনও

এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ।“

চলতি সময়ে এসে রানারের সেই পরিণতি যেন বরণ করতে হচ্ছে সাংবাদিক সমাজকে। খবরের মানুষদের খবর থেমে গিয়েছে কালি আর কম্পিউটারে। তাদের খবর রাখছেনা অন্য কেউই।

লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ

Exit mobile version