একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হয়েছে মোট ৪৫ বার। ৩৬ হারের বিপরীতে শ্রীলঙ্কার সাথে বাংলাদেশের জয় মাত্র ৭ ম্যাচে, বাকি ২ ম্যাচ পরিত্যক্ত। সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন অনেক পরিণত। শ্রীলঙ্কার সাথে বাংলাদেশ এখন লড়াই করে চোখে চোখ রেখেই। ২০১৮ তে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার মধ্যে মোট ৪টি একদিনের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলাফল বাংলাদেশ ২, শ্রীলঙ্কা ২।
বিশ্বকাপে আজকের ম্যাচে ব্রিস্টলে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও বৃষ্টির বাঁধায় খেলা হবে কিনা এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এর মাঝে চলুন আমরা স্মৃতির ভেলায় ভেসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়গুলো রোমন্থন করি।
২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৬, বগুড়া
শ্রীলঙ্কা- ২১২
বাংলাদেশ- ২১৩/৬ (৪৭ ওভার)
ফলাফল- বাংলাদেশ ৪ উইকেটে জয়ী
ম্যাচ সেরা- আফতাব আহমেদ
টসে জিতে বাংলাদেশ অধিনায়ক হাবিবুল বাশার প্রথমে শ্রীলঙ্কাকে ব্যাটিং এ পাঠায়। জয়সুরিয়া, সাঙ্গাকারা, দিলশান, জয়বর্ধনেকে নিয়ে শ্রীলঙ্কার শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপ সেদিন বাংলাদেশী বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং এ শুরু থেকেই কোণঠাসা হয়ে পরে। জয়সুরিয়া ১১০ বলে ৯৬ রানের একটি বড় ইনিংস খেললেও বাকি সব ব্যাটসম্যানরা থাকে ক্রিজে যাওয়া আসার মধ্যে। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা সংগ্রহ করে ২১২ রান। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ২ টি করে উইকেট নেন মোহাম্মদ রফিক, সৈয়দ রাসেল ও আলোক কাপালি।
২১২ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ৪৭তম ওভারে ৬ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ পৌঁছে যায় জয়ের বন্দরে। জাভেদ ওমরের ৬৬ বলে ৪০, মোহাম্মদ আশরাফুলের ৭১ বলে ৫১, হাবিবুল বাশারের ৬১ বলে ৩৩, আফতাব আহমেদের ২১ বলে ৩২ রানের ইনিংসের ওপর ভর করে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম বিজয়ের মুখ দেখে।
বল হাতে ৬ ওভারে ২৪ রান ব্যয়ে ১ উইকেট আর ব্যাট হাতে ২১ বলে ৩২ রানের ঝরো ইনিংসের কল্যাণে ম্যাচ সেরার পুরষ্কার আফতাব আহমেদের হাতে ওঠে।
১৪ জানুয়ারি ২০০৯, ঢাকা
শ্রীলঙ্কা- ১৪৯
বাংলাদেশ- ১৫১/৫ (২৩.৫ ওভার)
ফলাফল- বাংলাদেশ ৫ উইকেটে জয়ী
ম্যাচ সেরা- সাকিব আল হাসান
বৃষ্টির কারণে এই ম্যাচ নেমে আসে ৩১ ওভারে। টসে জিতে অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল প্রথমে বোলিং করার সিদ্ধান্ত নেন। বৃষ্টি ভেজা উইকেটের সেদিন সর্বোচ্চ সুবিধা নেন বাংলাদেশের ২ পেসার মাশরাফি এবং রুবেল। ৭ ওভারে ১টি মেডেনসহ ২৫ রান দিয়ে শ্রীলঙ্কা দলের প্রথম ৩ ব্যাটসম্যান থারাঙ্গা, জয়সুরিয়া এবং সাঙ্গাকারার মহামূল্যবান উইকেট তুলে নেন মাশরাফি। শুরুর কাজ মাশরাফি করে দিলে শেষের কাজটা নিজের কাঁধে বুঝে নেন রুবেল। ৫ ওভার ৩ বলে ৩৩ রান খরচে তুলে নেন শ্রীলঙ্কা দলের শেষ ৪ ব্যাটসম্যানকে। জয়সুরিয়ার ৫৪, জয়বর্ধনে ২৮ এবং কাপুগেদারার ২৮ রানের কল্যাণে শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত সংগ্রহ করে ১৪৭ রান।
এই রান চেজ করতে নেমে মাত্র ১১ রানে প্রথম ৩ ব্যাটসম্যান হারায় বাংলাদেশ। কিন্তু সেদিন সাকিব আল হাসান নামের এক তরুণ ছিল দিনটি নিজের করে নেবার জন্য। ৫ নম্বর পজিশনে ব্যাটিং করতে নেমে ৬৯ বলে ১০ টি চার, ২টি ছয়ের সাহায্যে তিনি করেন ৯২ রান। সেদিন সাকিবের যোগ্য সঙ্গী হিসেবে ৪১ বলে ২৬ রানের ছোট কিন্তু কার্যকরী ইনিংস খেলেন মোহাম্মদ আশরাফুল।
অতিমানবীয় ইনিংসের কল্যাণে স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচ সেরার পুরষ্কার নিজের করে নেন সাকিব।
২০ মার্চ ২০১২, ঢাকা
শ্রীলঙ্কা- ২৩২ (৪৯.৫ ওভার)
বাংলাদেশ- ২১২/৫(২৭.১ ওভার), টার্গেট ২১২(৪০ ওভার)
ফলাফল- বাংলাদেশ ৫ উইকেটে জয়ী
ম্যাচ সেরা- সাকিব আল হাসান
এশিয়া কাপের এই ম্যাচে টস জিতে প্রথমে শ্রীলঙ্কাকে ব্যাটিং করতে পাঠায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং এ ৪৯.৫ ওভারে ২৩২ রানে থেমে যায় শ্রীলঙ্কার ইনিংস। পেসার নাজমুল হোসাইন ৩টি, আব্দুর রাজ্জাক ও সাকিব আল হাসান নেন ২টি করে উইকেট। একটি মাত্র উইকেট পেলেও সেদিন মাশরাফি ছিলেন সবচেয়ে কিপটে বোলার। ৯.৫ ওভারে ১টি মেডেনসহ মাত্র ৩০ রান দেন তিনি।
কিন্তু বৃষ্টির বাঁধায় ডি/এল মেথডে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪০ ওভারে ২১২ রান। তামিম ইকবাল উইকেটের এক পাশ আগলে রাখলেও মাত্র ৪০ রানে বাংলাদেশ ৩ উইকেট হারিয়ে বসে। কিন্তু এরপর সাকিব আল হাসানের ৪৬ বলে ৫৬, নাসিরের ৬১ বলে ৩৬ এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ৩৩ বলে ৩২ রানের ইনিংসের কল্যাণে আর পথ হারায়নি বাংলাদেশ। তামিম ইকবাল করেন ৫৭ বলে ৫৯ রান।
ব্যাট-বলে অলরাউন্ড নৈপুণ্যের কারণে ম্যাচ সেরা হোন সাকিব আল হাসান।
২৮ মার্চ ২০১৩, ক্যান্ডি
শ্রীলঙ্কা- ৩০২/৯ (৫০ ওভার)
বাংলাদেশ- ১৮৪/৭ (২৬ ওভার), টার্গেট ১৮৩ (২৭ ওভার)
ফলাফল- বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী
ম্যাচ সেরা- তিল্কারাত্নে দিলশান
টসে জিতে শ্রীলঙ্কা প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয়। শ্রীলঙ্কার ২ ওপেনার দিলশান ও পেরেরা গড়েন ১১৬ রানের উদ্বোধনী জুটি, শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় উইকেটের পতন ঘটে ২০৩ রানে। সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কা যখন বড় স্কোরের দিকে ঠিক তখনই ম্যাচের লাগাম নিজেদের দিকে টেনে ধরে বাংলাদেশী বোলাররা। তাই শ্রীলঙ্কার প্রথম ৩ ব্যাটসম্যানের থেকে ২২৯ রান আসলেও শ্রীলঙ্কার রানের চাকা থেমে যায় ৩০২ রানে। ১০ ওভারে ৬২ রান দিয়ে ৫ উইকেট তুলে নেন বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক।
খেলায় বৃষ্টি বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে বাংলাদেশের লক্ষ্য নেমে আসে ২৭ ওভারে ১৮৩ রানের। এনামুল হকের ৪০, আশরাফুলের ২৯, জহরুল ইসলামের ২৬ এবং নাসিরের ৩৩ রানের ছোট ছোট ইনিংসের কল্যাণে বাংলাদেশ পেয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত জয়।
বাংলাদেশ জিতলেও ১২৫ রানের একটি অনবদ্য ইনিংস খেলার সুবাদে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পান দিলশান।
মার্চ ২৫ ২০১৭, ডাম্বুলা
বাংলাদেশ- ৩২৪/৫ (৫০ ওভার)
শ্রীলঙ্কা- ২৩৪ (৪৫.১ ওভার)
ফলাফল- বাংলাদেশ ৯০ রানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা- তামিম ইকবাল
টসে জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিং এ পাঠায় শ্রীলঙ্কা। এই দিন তামিম ইকবাল খেলেন তার কারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস। ১৫ টি ৪ এবং ১ টি ছয়ের সাহায্যে তামিম করেন ১৪৩ বলে ১২৪ রান। শ্রীলঙ্কা বোলারদের মাটিতে নামিয়ে এনে সাব্বির রহমান করেন ৫৬ অলে ৫৪, সাকিব আল হাসান করেন ৭১ বলে ৭২ রান। শেষের দিকে মোসাদ্দেক হোসেনের ৯ বলে ২৪ রানের একটি ক্যামিও বাংলাদেশকে এনে দেয় ৩২৪ রানের বড় একটি সংগ্রহ।
বাংলাদেশের ৩২৪ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৩১ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে শুরুতেই ম্যাচ থেকে সিটকে পরে শ্রীলঙ্কা। এর পরে বাংলাদেশের বোলাররা শ্রীলঙ্কাকে এর ম্যাচে ফেরার সুযোগ দেন নি। মুস্তাফিজ ৩ টি, মিরাজ এবং মাশরাফি নেন ২ টি করে উইকেট।
বাংলাদেশকে বড় সংগ্রহের ভিত্তি এনে দেওয়া ১২৪ রানের কল্যাণে ম্যাচ সেরা হোন তামিম ইকবাল।
১৯ জানুয়ারি ২০১৮, ঢাকা
বাংলাদেশ- ৩২০/৭ (৫০ ওভার)
শ্রীলঙ্কা- ১৫৭ (৩২.২ ওভার)
ফলাফল- বাংলাদেশ ১৬৩ রানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা- সাকিব আল হাসান
টসে জিতে বাংলাদেশ প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশের ব্যাটিং এর তিন স্তম্ভ তামিম, সাকিব, মুশফিকের ৩ হাফ সেন্তুরিতে বড় রান গড়ার ভিত্তি পায় বাংলাদেশ। তামিম ১০২ বলে ৮৪, সাকিব ৬৩ বলে ৬৭, মুশফিক ৫২ বলে ৬২ রানের ইনিংস খেলেন। শেষের দিকে মাহমুদুল্লাহর ২৩ বলে ২৪ এবং সাব্বিরের ১২ বলে ঝরো ২৪ রানের জন্য বাংলাদেশ ৩২০ রানের বড় সংগ্রহ পায়।
বোলিং এ শুরু থেকেই শ্রীলঙ্কাকে চাপে রাখে বাংলাদেশ। ম্যাচের কোন সময়ই মনে হয়নি যে এই ম্যাচে বাংলাদেশ হারতে পারে। থিসেরা পেরারা শ্রীলঙ্কার পক্ষে করেন সর্বোচ্চ ২৯ রান। সাকিব আল হাসান ৩ টি, মাশরাফি এবং রুবেল নেন ২ টি করে উইকেট।
ব্যাট হাতে দুর্দান্ত ৬৭ রানের ইনিংস এবং বল হাতে ৮ ওভারে ৪৭ দিয়ে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হোন সাকিব আল হাসান।
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, দুবাই
বাংলাদেশ- ২৬১ (৪৯.৩ বল)
শ্রীলঙ্কা- ১২৪ (৩৫.২ ওভার)
ফলাফল- বাংলাদেশ ১৩৭ রানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা- মুশফিকুর রহিম
টসে জিতে বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বাংলাদেশের শুরুটা হয় একদম দুঃস্বপ্নের মতো। ম্যাচের প্রথম ওভারের ৫ ও ৬ নম্বর বলে লাসিথ মালিঙ্গা শুন্য রানে ফিরিয়ে দেন লিটন দাস ও সাকিব আল হাসানকে। এরপর তামিম ইকবাল আহত হয়ে রিটায়ার করার বাংলাদেশ পরে যায় অকূল পাথারে। কিন্তু সেই অবস্থা থেকে মুশফিক তার ক্যারিয়ার সেরা ১৪৪ রানের একটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলে বাংলাদেশ দলকে একাই টেনে তোলেন খাদের কিনারা থেকে। ১৫০ বলে করা ১১ টি চার ও ৪ টি ছয়ে সাজানো ১৪৪ রানের এই ইনিংসটি বাংলাদেশের ক্রিকেট পাগল দর্শক অনেক দিন মনে রাখবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে বাংলাদেশ ২২৯ রানে ৯ম উইকেট হারালে ভাঙ্গা হাত নিয়ে খেলতে নেমে মুশফিককে ছাপিয়ে ম্যাচের নায়ক বনে যান তামিম ইকবাল। শেষ উইকেটে তামিম-মুশফিক জুটি যোগ করে আরও ৩২ রান। পুরো ম্যাচ জুড়ে মুশফিককে সঙ্গ দিয়ে যাওয়া মোহাম্মদ মিঠুনের কথাও অবশ্য না বললেই না। ৬৮ বলে ৫ টি চার ও ২ টি ছয়ে ৬৩ রান করেন মিঠুন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সংগ্রহ করে ২৬১ রান।
তামিমে উজ্জীবিত বাংলাদেশের বোলিং এর সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারে নি শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানরা। ৬০ রানের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়ে শুরুতেই ম্যাচের হিসেব থেকে বের হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে ১২৪ রানে শেষ হয় শ্রীলঙ্কার ইনিংস। বল হাতে বাংলাদেশের পক্ষে ২টি করে উইকেট নেন মাশরাফি, মিরাজ ও মুস্তাফিজ।
ম্যাচ সেরার পুরস্কার অবধারিতভাবেই যায় মুশফিকুর রহিমের ঝুলিতে।