সাহেদ আলম
জ্যাকসান হাইটস এর ৭৪ স্ট্রিটে একটি কাপড়ের দোকান চালান ফারুক ইসলাম। প্রায় ৫০ হাজার ডলারের পোষাক ও দ্রবাদি পড়ে আছে দোকানে, নিজে পাহারা দিচ্ছেন ২৪ ঘন্টা।সন্ধা নাগাদ তার দোকানের মোট বেচা-বিক্রি ১০০ ডলারের নিচে।অথচ, একদিন আগে দোকানের মাসিক ভাড়া বাবদ তাকে পরিশোধ করতে হয়েছে চার হাজার পাচ শত ডলার। তাও আগের মাসের ভাড়া এখনও পরিশোধ করতে পারেননি পুজির সংকটে। পাশের ভবনে, একটি ইলেক্ট্রনিক্স দোকার চালান নেপালি এক ভদ্রলোক।সুরেন পান্ডব নামের ঐ ব্যবসারী শুকনো মুখে হেসে দিয়ে, জানালেন, তাও ভাল যে ১০০ ডলার বিক্রি করেছেন, আমার তো সেটাও নেই। এই অবস্থা এখন নিউইয়র্কের প্রায় সর্বত্রই। কারণ, শীতের মন্দা যেটাকে মেনে নিয়েই ব্যবসা বানিজ্য করতে হয় নিউইয়র্কের মানুষের।
জ্যাকসান হাইটস, মূলত কমিউনিটির বাসিন্দাদের আনা গোনাকেন্দ্রিক ব্যবসা বানিজ্যের এই শ্লথ গতি শুরু হয় মুলত ডিসেম্বর মাস থেকেই। জানুয়ারী,ফেব্রুয়ারী এবং মার্চ -এই তিন মাস কিভাবে এবং কত দ্রুত পার হবে সেই আশায় দিন গুনতে থাকেন ব্যবসারীরা। অন্যন্যবার শুধু শীতের মন্দাতেই কাতর থাকেন ব্যাবসায়ীরা, এবার তার সাথে শুরু হয়েছে অভিবাসন বিরোধী ইমিগ্রেশন পুলিশের বাড়তি তল্লাশির ভয়।
‘জ্যাকসান হাইটস এ যারা মুলত আসেন, আড্ডা দেন তাদের সিংহভাগের কাগজপত্রে সমস্যা আছে। তারা নানান কাজ করে আ্য় করেন বেশি, খরচও করেন বেশি বেশি। গত মাসে কয়েক দফা এখানে ইমিগ্রেশন পুলিশের তল্লাসী হয়েছে, অনেককে ধরে নিয়ে গেছেন।সেসব খবর চাউর হয়েছে অনেক দ্রুত গতিতে। এখন মানুষ এসব খোলা জায়গায় আসতে ভয় পান অনেক বেশি।সে কারনে, শীতের মন্দার সাথে, অভিবাসন বিরোধী অভিযান-এক কথায় মড়া’র উপরে খাড়ার ঘা’-বলছিলেন ফারুখ ইসলাম।
জ্যাকসান হাইটস শুধু নয় দর্শনার্থীদের পদভারে উপচে পড়া ম্যানহাটানের চিত্রও একই রকম। এমনিতেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন আর ট্রাভেল ব্যান নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটকের সংখ্যা ৫০ শতাংশ কমে গেছে বলে কিছু দিন আগে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল নিউইয়র্ক টাইমস। সেই দাবীর সত্যতা মেলে ম্যানহাটানে গেলেও। ম্যানহাটানের ৮ এভিনিউ এর ৪৭ স্ট্রিটে ‘গিফট এন্ড ব্যাগেজ’ নামক একটি বড় দোকান পরিচালনা করেন খোশবু নামের এক বাংলাদেশী উদ্যোক্ত। মাসে দোকান ভাড়াই দেন, ৩৫ হাজার ডলারের উপরে। গত সপ্তাহে যখন তার দোকানে ঢুকি তখন, হাতে গোন ২/৩ জন কাস্টমারের যাতায়াত দেখেছি ১ ঘন্টায়। খোশবু বলছিলেন, ‘এখন সময় পরিকল্পনা করার, খরচ করার, আগামি দিন নিয়ে ভাবার, পরিবারের সাথে টেলিফোনে কথা বলার-সব কিছুর জন্য ভাল সময়, শুধু ব্যবসার জন্যে নয়’।
অবস্য সব ব্যবসায় যে মন্দা ভাব এমনটা নয়। শনি রবিবারের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাঙালী পাড়ার রেস্টুরেন্ট গুলিতে গরমের চেয়ে অনেক খানি বেশি মানুষের দেখে মেলে।কেননা, বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডার কারনে রেস্টুরেন্টের ভিতরেই বসে সময় কাটাতে পছন্দ করেন বেরিয়ে পড়া মানুষগুলো। তাই ভারী বেচা বিক্রি না হলেও অন্তত চা সিঙ্গাড়ার বানিজ্য ভাল।এস্টোরিয়ার বৈশাখী রেস্টুরেন্ট এর এক কর্মী বলছিলেন, আমাদের বেচা বিক্রি শীতে খুব বেশি তফাৎ হয় না।
বাঙালী ব্যবসা বানিজ্য নয় শুধু পুরো আমেরিকার অনন্য কর্মকান্ড সীমিত হয়ে পড়ে এই সময়টাতে। ট্রাভেল ডেস্টিনেশন বা ভ্রমনের জায়গাগুলি এখন প্রায় জনমানব শুণ্য। এটা শুরু হয়েছে অনেক জায়গায় নভেম্বর থেকেই।আবার কোন কোনটি তার আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তরের লেক জর্জ এলাকার সর্বশেষ পর্যটন স্পট গুলি বন্ধ হয়ে গেছে নভেম্বরের ২০ তারিখ থেকেই।ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই দক্ষিনের রাজ্য ডালোয়ারের আটলান্টিক সুমুদ্র তীরতীরে পর্যটন শহর গুলি পরিনত হয়েছে জনমানব শুন্য নগরীতে। নিউইয়র্কে এলেই যারা বাফেলো এবং নায়াগ্রার পানিপতন দেখতে যান, সেই সুযোগও এখন নেই। এ কারণে, এই সব পর্যটন নির্ভর ব্যাবসা যারা পরিচালনা করতেন তাদের ব্যবসাও নেই।
তবে এয়ারলাইন্স এর ব্যবসা যারা করেন বিশেষত ঢাকা নিউইয়র্ক ঢাকার টিকেট কাটতি এখন বেশ খানিকটা বেশি। কেননা, দারুন শীতের নিউইয়র্ক ছেড়ে খানিকটা উষ্ন শীতে পরিবার পরিজনের সাথে দেখা করতে অনেকেই এখন বাংলাদেশে। আবার অনেকেই যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নিউইয়র্কে পড়ে থাকা বাড়ী গুলোতে ৩ মাসের জন্য ‘সাবলেট’ ভাড়ার বিজ্ঞাপন তাই অহরহই চোখে পড়ে পত্রিকার পাতায় পাতায়।