শিনজো আবে: পররাষ্ট্রনীতিতে জাপানকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়1 min read
Reading Time: 5 minutes‘নীতিগত সমস্যাগুলো আমি আমার হৃদয় ও আত্মা দিয়ে মোকাবিলা করতে চাই। পাতলা বরফের ওপর পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে চলার মতো অনুভূতি দিয়ে। আমি যে মন নিয়ে শুরু করেছিলাম তা ভুলে যাব না।’
পাতলা বরফের উপর দিয়ে তার হাঁটার দিনগুলো অবশেষে শেষ হয়েছে। কথা ছিল হাঁটবেন আরো বেশ কিছুদিন। অন্তত ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু নিজের স্বাস্থ্যের উপর আস্থা রাখতে পারেননি। বাধ্য হয়েই ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন জাপান প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে।
২০০৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত যেখানে জাপানে ৭ জন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেখানে ২০১২ থেকে টানা ক্ষমতায় ছিলেন শিনজো আবে। জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লেও ২০১৭ সালের নির্বাচনেও আবার বিপুলসংখ্যক ভোটে জয় পেয়েছিলেন আবে। ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর, জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাটসুরা টারোর (Katsua Taro) ২,৮৮৩ দিনের রেকর্ড ভেঙ্গে জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নাম লেখান আবে।
যেভাবে ক্ষমতায় আবে
শিনজো আবে খুব চমক দিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হননি। তার রক্তেই ছিল রাজনীতির নেশা। ১৯৫৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া আবে বড় হয়েছেন রাজনৈতিক পরিবেশে। তার নানা ছিলেন জাপানের রাজনীতির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নোবুসুকে কিশি (Nobusuku Kishi)। ২য় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অত্যন্ত সক্রিয় একজন নেতা হিসেবে কাজ করেছিলেন নোবুসুকে কিশি। বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মার্কিন ট্রায়ালে তিনি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হন। যার কারণে ৩ বছর জেলে কাটাতে হয় তাকে। তবে ফিরে এসেই তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত টালমাটাল পরিস্থিতি সামলে জাপানকে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলার কাজ করেন নোবুসুকে কিশি। এছাড়া তার চাচা সাটো এইসাকো (Sato Eisaku) জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত।
তুখোড় রাজনীতিবিদ নোবুসুকে কিশি নিজের জামাতা হিসেবে বেছে নেন আরেক উদীয়মান নেতা শিনতারো আবেকে। শিনতারো আবেও নিজের অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় মুখ ছিলেন। সক্রিয় ছিলেন কেন্দ্রীয় রাজনীতির সাথেও। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শিনজো আবের বাবা শিনতারো আবে।
১৯৭৭ সালে টোকিও সেইকেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিকাল সায়েন্সে স্নাতক শেষ করে তরুণ শিনজো পাড়ি জমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে পড়া শেষ করে দেশে ফেরেন ১৯৭৯ সালে। এরপর কোবে স্টিল লিমিটেডে চাকরির পাশাপাশি যোগ দেন রাজনীতিতে। ১৯৮২ সাল থেকে বাবা শিনতারো আবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন মেয়াদের পুরোটা সময়ে শিনজো আবে ছিলেন তার সেক্রেটারি হিসেবে।
১৯৯১ সালে শিনতারো আবের মৃত্যুর ২ বছর পরেই সক্রিয় রাজনীতির মঞ্চে পা রাখেন শিনজো আবে। ১৯৯৩ সালে জাপানের হাউজ অফ রিপ্রেজেনটেটিভে নিজ প্রদেশ ইয়ামাগুচির (Yamaguchi) প্রতিনিধি হন শিনজো আবে। নানা নোবুসুকে কিশির প্রতিষ্ঠা করা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) এর নেতা হিসেবেই সব সময় কাজ করেছেন শিনজো আবে। এলডিপি জাপানের ডানপন্থী রাজনীতির মূল ধারক ও বাহক। ১৯৯৫ সালের আগে পর্যন্ত এলডিপি ছিল জাপানের সবচেয়ে বেশিবার ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল।
মূল রাজনীতিতে প্রবেশ এবং বিতর্কিত প্রথম মেয়াদ
শিনজো আবের খুব শক্ত পারিবারিক ইতিহাস থাকলেও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ধীরে ধীরে ক্ষমতার দিকে এগুতে হয়েছে তাকে। রক্তে রাজনীতি মিশে ছিল, তাই দলে নিজের বুদ্ধিমত্তা আর বিচক্ষণতা দেখাতে সময় লাগেনি। ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রী জিনোচিরো কিওজুমির (Junichiro Koizumi) চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারির পদে উন্নীত হন আবে। ২০০৬ সালের ২৩ এপ্রিল এলডিপির সভাপতির দায়িত্ব পান। একই বছর কিওজুমি পদত্যাগ করলে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি। ৫২ বছরের আবে সেই সময় ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সবচেয়ে তরুণ প্রধানমন্ত্রী। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জন্ম নেওয়া জাপানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন তিনি।
তবে মাত্র ৩৬৬ দিনের সেই প্রধানমন্ত্রীত্বকালীন সময়ের পুরোটাই তাকে কাটাতে হয়েছে বিভিন্ন বিতর্কের মাঝ দিয়ে। তার প্রথম মেয়াদের প্রধানমন্ত্রীত্বকে আধুনিক জাপানের সবচেয়ে অস্থিতিশীল কাল বললে অত্যুক্তি হয়না। ক্যাবিনেট পর্যায়ে একের পর এক কলঙ্কিত ঘটনায় পদত্যাগের সাথে যুক্ত হয় কৃষিমন্ত্রী তোশিকাৎসু মাৎসুকার আত্মহত্যার ঘটনা। সব মিলিয়ে মাত্র ১ বছরেই স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করেন শিনজো আবে।
২য় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী এবং আবেনোমিকস
তুমুল অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মাঝে ২০১২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিনজো আবে। ক্ষমতায় আসার পরেই জাপানের অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। আর এই লক্ষ্যে তিনি তিনটি মূল লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অদ্ভুত এক পদ্ধতি গ্রহণ করেন। সারাবিশ্বে যা ‘আবেনোমিকস’ বা আবে অর্থনীতি নামে পরিচিত হতে শুরু করে।
১৯৯০-এর দশক থেকেই জাপানের অর্থনীতিকে মন্দাভাব তাড়া করে আসছিল। শিনজো আবের প্রথম লক্ষ্য ছিল এই মন্দাভাব দূর করা। আর সেজন্য প্রণীত হয় নতুন আর্থিক নীতি। যার আলোকে প্রথমেই আবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ব্যাংক অব জাপান’ এর সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি শিথিলের অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নেয়। মুদ্রানীতি শিথিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সুদহার কমানোর মধ্য দিয়ে ব্যবসা কার্যক্রম ও ভোক্তাব্যয় দুই ক্ষেত্রেই নতুন গতি আনার জন্যে। এ পদক্ষেপের প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশের মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশে নিয়ে যাওয়া।
ব্যাংক অব জাপান ও শিনজো আবের যৌথ এই নীতির ফলে ইয়েনের মান দুর্বল হয়ে যায়। যার ফলাফল হিসেবে দেশটির রফতানিকারকদের অবস্থান শক্ত হয়। কিন্তু মূল লক্ষ্য তখনো অর্জিত হয়নি। অর্থাৎ, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নাগালের বাইরেই থেকে যায়। যদিও দ্রব্যমূল্য ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি একপর্যায়ে দেশটির অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
আবেনোমিকস বা আবে অর্থনীতির দ্বিতীয় মূলনীতি ছিলো – ব্যাপক সরকারি ব্যয়। অর্থাৎ সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। এ ব্যয়ের মধ্য দিয়ে দেশটির অবকাঠামোগত পুনর্গঠনে পদক্ষেপ নেয়া হয়। ২০১৩ সাল থেকে দেশব্যাপী অবকাঠামোর আধুনিকায়নে কোটি কোটি ডলার খরচ করেন শিনজো আবে। এর মধ্যে কিছু অবকাঠামো নির্মাণে হাত দেয়া হয় শুধুমাত্র ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিক গেমস সামনে রেখে। যদিও এই অলিম্পিক এক বছর পিছিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন।
আবে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় রাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশজুড়ে ব্যবসা বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে। আর্থিক ও রিয়েল এস্টেট বাজারে উর্ধ্বমুখী এক প্রবণতা দেখা যায়, যা কয়েক বছরের জন্য দেশটির প্রবৃদ্ধি উন্নয়নে বেশ ভাল দিক ছিল। কিন্তু তাতেও পুরো সফলতা পায়নি জাপানের জাতীয় অর্থনীতি। ২০১৪-১৫ সালের মধ্যে দেশটির জিডিপি আরো একবার সংকুচিত হয়। আর ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত আঘাতের আগেই আবারো মন্দার মুখে পড়ে জাপানের অর্থনীতি।
এতকিছুর পরেও জাপানে ভোক্তাব্যয় বরাবরই নিম্মুমুখী। পরিসংখ্যান বলছে, শতকরা হিসেবে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক জনসংখ্যা আছে জাপানে। আর এই বয়স্কদের মধ্যে খরচের থেকে বেশি দেখা যাচ্ছে সঞ্চয়ের প্রবণতা, যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো নিম্নমুখী ভোক্তাব্যয়। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে ভোক্তা কর বৃদ্ধির কারণে এ ব্যয় আরো কমে যায়।
ভোক্তা কর বৃদ্ধির বিষয়ে দুবারই অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছিলেন প্রশাসনকে। তাদের সবারই মত ছিল, এ কর বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিকে উল্টো পথে চালিত করবে। যদিও শিনজো আবে তার নীতিতে কোন পরিবর্তন আনেননি।
‘মরার উপর খরার ঘা’ হিসেবে যুক্ত হয় চলতি বছর করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাস নতুন করে জাপানের অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। স্থগিত করতে হয়েছে অলিম্পিক আয়োজন, কমে গেছে পর্যটন থেকে আয়। অথচ অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য এই দুই খাত সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারতো জাপানের জন্য। ২০২১ সালে অলিম্পিক আয়োজন হলেও ঠিক কতটা দর্শক সমাগম হবে তা বেশ অনিশ্চিত। ফলে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির পুরো সিদ্ধান্তই ফিরতে পারে বুমেরাং হয়ে। এছাড়াও অর্থনীতি রক্ষায় সরকারকে গ্রহণ করতে হয়েছে বিপুলাকার নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ।
আবেনোমিকস এর তৃতীয় ও শেষ লক্ষ্য ছিল, অবকাঠামোগত সংস্কার। এক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল জাপানের শ্রমবাজার। যুদ্ধ-পরবর্তী মডেল অনুযায়ী জাপানের শ্রমিকরা দেশটির কোনো বৃহৎ কোম্পানিতে আজীবন কর্মসংস্থান ও সুযোগ-সুবিধা পেতে পারতেন। কিন্তু এর বিপরীতে সরকার অধিকতর নমনীয় মডেল প্রচারে যে উদ্যোগ নেয়, তা প্রয়োজনীয় মাত্রায় গতিশীল ছিল না।
সব মিলিয়ে কদিন আগে শিনজো আবে পদত্যাগ করেও পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর জন্য আবেনোমিকসের বড় একটি চাপ রেখেই গিয়েছেন তিনি।
আত্মনির্ভরশীল জাপানের রূপকার
শিনজো আবে অর্থনৈতিক দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও আত্মনির্ভরশীল জাপানের রূপকার হিসেবে নিজেকে দাবি করতেই পারেন। আবের প্রশাসনই ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মত চীন, উত্তর কোরিয়ার মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহায্য করেছে দেশকে। আবের পুরো সরকার ব্যবস্থাই উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে বেশ সক্রিয় ছিল। আবার বিভিন্ন সময় চীনের অর্থনৈতিক নীতি ও সামরিক নীতিরও কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি।
যদিও সবচেয়ে বড় যে কারণে আবেকে দীর্ঘদিন মনে রাখবে জাপানের জনগণ, সেটা সংবিধান সংস্কার। ১৯৪৭ সালে, বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিতে করা প্যাসিফিক সংবিধান বদলে ফেলতে শিনজো আবের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতোই। বিশেষ করে সংবিধানের নবম অনুচ্ছেদ সংস্কার করে আবে জাপানের সামরিক বাহিনীকে দেশের স্বার্থে মিত্রদের সাথে অন্যদেশে আক্রমণ এবং প্রতিরক্ষার স্বাধীনতা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে বেইজিং এবং সিউল ব্যাপক আপত্তি জানালেও নিজের উপর অটল ছিলেন নোবুসুকে কিশি এবং শিনতারো আবের উত্তরাধিকারী।
ব্যক্তিগত জীবন
১৯৮৭ সালে রেডিও জকি আকেই মাৎসুজাকিকে বিয়ে করেন শিনজো আবে। দাম্পত্য জীবনে তিনি নিঃসন্তান।
পরবর্তী কে?
এইমুহুর্তে জাপানের ক্ষমতায় আছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কিংবা পার্টির সভাপতির দৌড়ে আপাতত সবচেয়ে এগিয়ে আছেন এলডিপির সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শেইগেরু ইশিবা।
লেখক- জুবায়ের আহাম্মেদ