লিবিয়ায় ক্ষমতার দখল এখন কার হাতে?1 min read
Reading Time: 4 minutesঅনেকেই ইদানীং নতুন করে শুরু হওয়া লিবিয়া যুদ্ধ ফলো করছেন। কিন্ত লিবিয়া ব্যাপারটা এতো জটিল, কনটেক্সট জানা না থাকলে কিছু ভুল বোঝাবোঝির সৃষ্টি হতে পারে। পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হলো:
১। “আর্মি” শব্দটাকে সিরিয়াসলি নিবেন না। সত্যিকার আর্মি বলতে লিবিয়াতে কিছু নাই। “লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি” বা এলএনএ বলতে মূলত জেনারেল হাফতারের বাহিনীকে বোঝানো হয়। কিন্ত সেটা ঠিক ট্রেডেশনাল আর্মি না, আর চরিত্রগত ভাবে ন্যাশনাল তো না-ই।
হাফতারের বাহিনীর দুইটা অংশ। একটা অংশ অর্থাৎ কিছু ব্রিগেড সত্যি সত্যিই প্রফেশনাল আর্মির স্ট্রাকচার ফলো করে। এদের সদস্যরা এবং কমান্ডাররা অনেকেই গাদ্দাফীর আমলের সেনাবাহিনী থেকে আসা। এছাড়াও হাফতার নিজেও গত সাড়ে চার বছরে অনেক নতুন সেনাসদস্যকে ট্রেনিং দিয়ে নিজের বাহিনীকে মোটামুটি একটা অর্গানাইজড স্ট্রাকচারে রূপ দিয়েছেন।
কিন্ত এর বাইরে তার বাহিনীতে অনেকগুলো ব্রিগেড আছে, যেগুলোর কমান্ডাররা আর্মির র্যাঙ্কের হলেও সেগুলো মূলত ট্রাইবাল মিলিশিয়া। এ ছাড়াও সম্পূর্ণ মাদখালি সালাফিদেরকে নিয়েও কিছু ব্রিগেড আছে, যারা জিহাদী চরিত্রের এবং যাদের বিরুদ্ধে প্রচুর যুদ্ধাপরাধ, মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রমাণ আছে।
এর বিপরীতে ত্রিপলীর জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের যে সেনাবাহিনী আছে, সেটা পুরাই শো। সেখানে শুধু উপরের দিকেই আর্মির র্যাঙ্কের অফিসার, নিচের দিকে পুরাই মিলিশিয়া। এমনকি এই সরকার নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যাদের উপর নির্ভরশীল, তারাও মিলিশিয়া এবং অনেক সময় নিজেরা নিজেরাই টার্ফ ওয়ারে জড়িয়ে পড়ে।
২। কোন এলাকা কার দখলে, এই ম্যাপকে খুব বেশি সিরিয়াসলি নিবেন না।
ম্যাপগুলোর দিকে তাকালে আপনার কাছে মনে হবে লিবিয়ার ৮০-৯০ ভাগই হাফতারের দখলে। এটা একদিক থেকে সত্য, কোনো সন্দেহ নাই। কিন্ত ম্যাপগুলো দেখতে যেরকম ড্রামাটিক মনে হয়, বাস্তবতা সেরকম না। ব্যাপারটা হচ্ছে, লিবিয়ার ৮০-৯০ ভাগই ডেজার্ট। অধিকাংশ মানুষই বাস করে শুধুমাত্র কোস্টাল স্ট্রিপে।
শুধুমাত্র বৃহত্তর ত্রিপলীতেই বাস করে প্রায় আড়াই মিলিয়ন মানুষ, যা লিবিয়ার জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। ম্যাপে ত্রিপলী মাত্র ৫-১০ শতাংশ জায়গা দখল করলেও জনসংখ্যার ৪০ শতাংশসহ লিবিয়ার সবগুলো প্রধান প্রধান ইনস্টিটিউশন তার দখলেই থাকবে, যে ত্রিপলী নিয়ন্ত্রণ করবে।
এছাড়াও, কোনো একটা শহর থেকে সাউথের দিকে অন্য একটা শহরের দূরত ৪০০ কিলোমিটার। ঐ শহরে যাওয়ার উপায় শুধুমাত্র একটা হাইওয়ে। এই লম্বা হাইওয়েতে কিন্তু কোনো যুদ্ধ হবে না। এই ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঐ শহরে গিয়ে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেখানে অবস্থিত কয়েকশো যোদ্ধাকে পরাজিত করে শহরটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া সম্ভব।
এটা এমন কোনো কঠিন কাজ না, বা স্ট্র্যাটেজিকালি হয়তো গুরুত্বপূর্ণও না। কিন্ত এর ফলে বিশাল ডেজার্টসহ ১ লাখ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত এলাকার দখলের হাত বদল প্রদর্শিত হতে পারে।
৩। ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দখল মিডিয়াতে খুব গুরুত্বের সাথে আসে। কিন্ত বাস্তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।
গত কয়েকদিনের যুদ্ধে অনেকেই শুনে থাকবেন ত্রিপলীর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দখল বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়েছে। এই এয়ারপোর্টটা লোকেশনের দিক থেকে স্ট্র্যাটেজিকাল অবস্থানে আছে (সাউথ থেকে ত্রিপলীতে প্রবেশের মুখে), কিন্ত এর বাইরে স্থাপনা হিসেবে এর কোনো গুরুত্ব নাই। কারণ এটা পরিত্যাক্ত এয়ারপোর্ট।
বর্তমানে ত্রিপলীর একমাত্র সক্রিয় এয়ারপোর্ট হচ্ছে মিতিগা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। ওটা শহরের ভেতরে অবস্থিত, এবং ওটার দখল এখনও কেউ নিতে পারেনি। গত পরশুদিন হাফতার অবশ্য এই মিতিগা এয়ারপোর্টেই বিমান হামলা করেছিল। তবে কোনো প্লেন বা রানওয়ে লক্ষ্য করে না, এমনিই খোলা জায়গায় করেছে ভয় দেখানোর জন্য। কারণ এই এয়ারপোর্ট থেকেই হাফতারের উপর বম্বিং করা ফাইটার গুলো উড়ছিল।
পরিত্যাক্ত যে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টটির দখল বারবার হাতবদল হচ্ছে, ২০১৪ সালের যুদ্ধের সময় ইসলামপন্থী মিলিশিয়ারা ১১টা যাত্রীবাহী প্লেনসহ সেই এয়ারপোর্ট পুড়িয়ে দিয়েছিল। তার পর থেকেই ওটা অকার্যকর। হাস্যকর ভাবে, বর্তমানে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ফাতহি বাশাগা, যিনি মিতিগাতে হাফতারের বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছেন, তিনি ছিলেন ঐ বাহিনীর একজন নেতা।
৪। জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার বৈধ, হাফতার অবৈধ – ব্যাপারটা এতো সরল না
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই, হাফতারের ত্রিপলী আক্রমণ যেকোনো বিচারেই অগ্রহণযোগ্য। তার পক্ষে কয়েকটা ওয়েস্টার্ন কান্ট্রির সাপোর্ট (এবং আমেরিকাসহ বাকিদের তার প্রতি কিছুটা গোপন আশা) না থাকলে হয়তো তার বিরুদ্ধে অবরোধ এসে পড়ত এতোদিনে। কিন্ত গণমাধ্যমে যেভাবে উঠে আসে যে, একদিকে জাতিসংঘ সমর্থিত বৈধ সরকার, আর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসছে রৌগ জেনারেল খালিফা হাফতার, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম সিম্পলও না।
জাতিসংঘ সমর্থিত এই সরকার যে ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই একই ফ্রেমওয়ার্কে ২০১৪ সালের নির্বাচিত সংসদকে লিবিয়ার বৈধ সংসদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং ঐ হাফতার ঐ সংসদ কর্তৃক স্বীকৃত “সেনাবাহিনী প্রধান”। তার ত্রিপলী অভিযানের প্রতিও ঐ সংসদ সমর্থন দিয়েছে।
বাস্তবে ঐ সংসদ অবশ্য অকার্যকর এবং হাফতারের সমর্থক সদস্যদের হাতে জিম্মি এবং মেয়াদোত্তীর্ণ। কিন্ত সে হিসেব করলে লিবিয়াতে সবগুলো প্রতিষ্ঠানই মেয়াদোর্ত্তীণ এবং অবৈধ। এমনকি জাতিসংঘ সমর্থিত যে সরকার, তাদের দায়িত্ব ছিল ত্রিপলীতে এসে মিলিশিয়াদেরকে উচ্ছেদ করে সেনাবাহিনী গঠন করা, এবং সংসদের সমর্থন নিয়ে বৈধভাবে কাজ শুরু করা।
কিন্ত তারা মিলিশিয়াদেরকে উচ্ছেদ করতে তো পারেইনি, বরং নিজেদের নিরাপত্তার জন্য মিলিশিয়াদের উপরই নির্ভরশীল হয়ে বসে আছে। এই অযুহাতে (বাস্তবে ক্ষমতার লোভে) সংসদ তাদেরকে এখন পর্যন্ত বৈধতাই দেয়নি। ফলে জাতিসংঘ সমর্থিত যে সরকার, তারাও একপ্রকার অবৈধ। তারা টিকে আছে কেবল আমেরিকাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে এবং মিলিশিয়াদের কৃপায়।
৫। হাফতার যুদ্ধ করছে আল-কায়েদা/আইসিস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে – এটা একসময় সত্য ছিল, এই মুহূর্তে সত্য না।
২০১৪ সালে হাফতার যখন প্রথম বেনগাজিতে অপারেশন শুরু করে, তখন বেনগাজি ছিল পুরোপুরি আনসার আশ্শারিয়ার (আল-কায়েদা অ্যাফিলিয়েট) নিয়ন্ত্রণে এবং তাদেরকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে যাচ্ছিল ত্রিপলীর তৎকালীন ইসলামিস্ট ডমিনেটেড সংদের বেশকিছু নেতা। পরবর্তীতে আনসারের সাথে আইএসও হাফতারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। সে হিসেবে হাফতারের তখন ওয়ার অন টেররের গ্রহণযোগ্যতা (এবং বিপুল জনপ্রিয়তা) ছিল।
হাফতারের দারনা অপারেশন তুলনামূলকভাবে বিতর্কিত ছিল, কারণ সেখানে লোকাল ইসলামিস্টরা নিজেরাই আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহরকে মুক্ত করেছিল। কিন্ত এই লোকালদের সাথে বেশ কিছু হাই প্রোফাইল আল-কায়েদা নেতাও ছিল, এবং সেই অযুহাতে হাফতার সেখানেও অভিযান চালায়।
কিন্ত বর্তমানে ত্রিপলীতে আল-কায়েদা বা আইসিস বিতর্ক নাই। ত্রিপলীতেও আফগান ফেরত এবং আল-কায়েদা লিংকড জিহাদী নেতারা একসময় সক্রিয় ছিল। কিন্ত জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের পক্ষের মিলিশিয়ারা গত আড়াই বছরে অনেকগুলো ছোট ছোট যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তাদেরকে ত্রিপলী থেকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করেছে।
ফলে এই মুহূর্তে হাফতারের ত্রিপলীতে যে অপারেশন, সেটা নিছকই পুরো লিবিয়া নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য তার যে সুদীর্ঘ পরিকল্পনা, তার চূড়ান্ত ধাপ। সন্ত্রাস দমনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নাই। বরং তার এই অপারেশনের কারণেই এখন ত্রিপলী থেকে উচ্ছেদ হওয়া জিহাদী নেতারা তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অযুহাতে আবার ত্রিপলীতে প্রবেশ করার উপলক্ষ খুঁজে পেয়েছে।
লেখক- Mozammel Hossain Toha
আরও দেখুন Bangla InfoTube Knowledge Share পর্বে লিবিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা-