রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনা সমালোচনা থাকলেও মিয়ানমারের ওপর দৃশ্যমান চাপ একদমই অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু নভেম্বর মাসের কিছু ঘটনা সে অবস্থা পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত মাসের ১১ তারিখ নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনের পক্ষে গাম্বিয়া রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও তাদের বাড়িঘর ধ্বংসের দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে।
আগামীকাল ১০ ডিসেম্বর আইসিজেতে এই মামলার শুনানি শুরু হবে। মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে মিয়ানমার ইতিমধ্যেই প্রখ্যাত সব আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের নিয়ে একটি দল গঠন করেছে। এই দলের নেতৃত্বে আছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর ও কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সুচি।
১৯৫৬ সালে জাতিসংঘের গণহত্যা সনদে সই করে মিয়ানমার। তাই আইসিজের নির্দেশনা মিয়ানমার মেনে চলতে বাধ্য। কোন কারণে মিয়ানমার আইসিজের নির্দেশনা না মানলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাখে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার এই মামলার বিচার শেষ হতে বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। তবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে মিয়ানমারকে অন্তর্বর্তীকালীন কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিতে পারে আইসিজে।
ইসালামি কোঅপারেশনের ৫৭টি দেশের পক্ষে করা এই মামলায় গাম্বিয়াকে তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা দেবে বাংলাদেশ, কানাডা ও নেদারল্যান্ড। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করতে বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধি দল শুনানিতে উপস্থিত থাকবেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কানাডা বরাবরই সোচ্চার থেকেছে। রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করতে কোন কার্যকর ভূমিকা না রাখায় এর আগে অং সান সুচিকে দেয়া সন্মানজনক নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল কানাডা।
এছাড়া জাম্বিয়ার এই মামলার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে কিনা সেটি তদন্তের অনুমোদন দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। তবে মিয়ানমার আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র না হওয়ায় সরাসরি মিয়ানমারে সংগঠিত রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার করার এখতিয়ার আইসিসির নেই। এসবের বাইরে নভেম্বরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো আর্জেন্টিনার আদালতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে অং সান সুচি, সেনা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং সহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তবে এই সব কিছুর মধ্যে আইজিসিতে দায়ের করা মামলায় মিয়ানমারের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
রোহিঙ্গাদের ওপর এর আগে ১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সেসময় অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে এক সময় ফিরেও গেছে। কিন্তু ২০১৭ সালে নতুন করে রোহিঙ্গা নির্মূলে তারা যে তাণ্ডব চালিয়ে সেটি ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব ইতিহাসকে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কারো কাছে জবাবদিহি করতে না হওয়ায় তারা সব সময়ই রয়ে গেছে ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। এছাড়া চীন, রাশিয়া, ভারত নিজ স্বার্থের খাতিরে এই ব্যাপারে কখনোই মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করেনি। কিছু ক্ষেত্রে চীন উল্টো মিয়ানমারকে দিয়েছে প্রত্যক্ষ সমর্থন। এমন পরিস্থিতে জাম্বিয়ার এই মামলা নিঃসন্দেহে চাপে ফেলেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকারকে। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে নিজেদের অপরাধ ধামাচাপা দেয়া মিয়ানমারের যে কঠিন হবে তা এখনই স্পষ্ট। ফলে আইসিজের মামলাটি রোহিঙ্গা সমস্যার একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের সুযোগ হতে পারে বলে আশা করা যায়।