রুয়ান্ডার নৃশংস গণহত্যা1 min read
Reading Time: 3 minutesযদি রুয়ান্ডায় বসবাসরত তুতসি সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর কাছে প্রশ্ন রাখা হয় তাদের কাছে সবচেয়ে বিভিষীকাময় সাল কোনটি। তবে তাদের কন্ঠে বিষাদের সুরের উত্তর আসবে ১৯৯৪ সাল (এপ্রিল ও জুনের মাঝ বরাবর)। কারণ, এই সময়টাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জের ধরে হুতু সম্প্রদায়ের লোকজন ১০০ দিনের ব্যবধানে হত্যা করেছিলো প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ লোককে, যার মধ্যে অধিকাংশ ছিলো তুতসি সম্প্রদায়। এটি ছিলো পুরো পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়গুলোর একটি।
কেন এই গণহত্যা? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ৭৮ বছর আগে। পূর্ব আফ্রিকার রুয়ান্ডা নামক রাষ্ট্রটি বেলজিয়াম সেনাবাহিনী দখল করে নেয়। সে সময় রুয়ান্ডায় তুতসি ও হুতু এই দুই সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করতো। সংখ্যার দিক থেকে হুতু সম্প্রদায় ছিলো সংখ্যাগুরু আর তুতসি সম্প্রদায় ছিলো সংখ্যালঘু।
তুতসি সম্প্রদায়ের লোকজন হুতু সম্প্রদায়ের চেয়ে উচ্চতায় লম্বা ছিলো আর তাদের দৈহিক গড়ন ছিলো চিকন। এছাড়া, দুই সম্প্রদায়ের ভাষা, আচার–ব্যবহার বা অন্য কোন চালচলনে কোন বৈসাদৃশ্য দৃষ্টিগোচর হতোনা। কিন্তু, এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তুতসিদের পূর্বপুরুষদের আদি বাসস্থান নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিলো। ধারণা করা হতো যে, তুতসিরা মূলত ইথিওপিয়ার বাসিন্দা। পরবর্তীতে তারা রুয়ান্ডায় এসে বসবাস শুরু করে।
বেলজিয়াম সেনাবাহিনী কর্তৃক দখল হওয়ার পর রুয়ান্ডার প্রশাসনিক যাবতীয় কাজ চালনার ক্ষমতা চলে যায় বেলজিয়ামের কর্মকর্তাদের হাতে। তারা রুয়ান্ডার বাসিন্দাদের সম্প্রদায়ের নামের উপর ভিত্তি করে পরিচয়পত্র দেওয়া শুরু করে। এটি ছিলো অনেকটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীজ বপনের মতো। এখানেই শেষ নয়। বেলজিয়াম রুয়ান্ডার এই দুই গোষ্ঠীকে বিভক্ত করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা তুতসিদের হুতুদের তুলনায় বেশি প্রাধান্য ও সুযোগ–সুবিধা প্রদান করা শুরু করে। ফলে, দেখা যায় পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে তুতসিরা হুতুদের চেয়ে চাকরি, শিক্ষা সবক্ষেত্রে অনেক গুণ এগিয়ে যায়। বিষয়টি হুতুরা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। তাদের মনে তুতসিদের জন্য ধীরে ধীরে তীব্র ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে।
১৯৫৯ সাল ছিলো তুতসিদের প্রতি হুতুদের জমা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সে সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারাতে হয় প্রায় ২০ হাজার তুতসিকে। অনেকে প্রাণ রক্ষার্থে উগান্ডা, বুরুন্ডি, তানজানিয়া সহ অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে বেলজিয়াম সরকারের পতনের মাধ্যমে রুয়ান্ডা পুনরায় তার স্বাধীনতা ফিরে পেলে তুতসিরা ফিয়ে পায় তাদের ক্ষমতা।
হুতু সম্প্রদায়ের নেতা একনায়ক জুভেনাল হাবিয়ারিমানা রুয়ান্ডার ৩য় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৯৭৩ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন । কিন্তু তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সে দেশের অর্থনৈতিতে ধস নেমে আসে। ফলে, তার উপর সে দেশের জনগণের আস্থা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। সে সময় উগাণ্ডায় পালিয়ে যাওয়া তুতসিরা অন্যান্য তুতসিদের রুয়ান্ডায় ফিরিয়ে আনার জন্য রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (RPF) নামে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী দল গঠন করে। প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সে সংগঠনের সব নেতাদের নিজের ছত্র ছায়ায় নিয়ে আসেন। কিন্তু দ্বন্ধ তখনো থামেনি। ১৯৯৩ সালে RPF ও সরকার বাহিনীর সাথে সংঘর্ষের পর প্রেসিডেন্ট ও RPF এর মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি সই হয়। কিন্তু সেই চুক্তি বাস্তবে শান্তি আনায়নে সফল হয়নি।
১৯৯৪ সালের ৮ এপ্রিল রাতে একটি বিমান লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে সেটিকে ভূপতিত করা হয়। বিমানের সব যাত্রীরা নিহত হয়। সে বিমানে ছিলো হুতু সম্প্রদায়ের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা এবং বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট সাইপ্রিয়েন নটারিয়ামনা। এই ঘটনার জের ধরে হুতু সম্প্রদায় ঠান্ডা মাথায় গণ হত্যার নকশা প্রনয়ণ করতে থাকে কারণ, তাদের ধারণা ছিল এই বিমান হামলাকারীরা RPF এর সদস্য। সে সময় অতি সতর্কতার সাথে বিরোধী পক্ষের যত সরকারি কর্মকর্তা রয়েছে তাদের নামের তালিকা হুতুদের হাতে হস্তান্তর করা হয়। তারপর শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। সর্বপ্রথম হত্যার স্বীকার হয় তালিকায় থাকা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে নৃশংশতা। পরিস্থিতি এক সময় এমন হয়ে দাঁড়ায় যে পরিবারের হুতু স্বামীর হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে তুতসি স্ত্রীর। হুতুরা দাবী করেছিলো তারা এমনটি না করলে তুতসিদের হাতে তাদের প্রাণ হারাতে হতো।
পরিচয়পত্রে তুতসি উল্লেখ থাকলে ধারালো ছুরি দিয়ে তাদের হত্যা, নারীদের ধর্ষণ ও যৌনদাসী বানিয়ে রাখা তখনকার রুয়ান্ডার জন্য দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।
ইন্টেরা হামায়ি ছিলো সরকারি দল এমআরএনডির একটি যুব শাখা যারা পরবর্তীতে চরমপন্থী মিলিশিয়া রূপে আত্মপ্রকাশ করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া, হত্যাকান্ড চালনার মূল হোতা ছিলো এই দলের সদস্যরা। হুতু চরমপন্থী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত “আরটিএলএম” বেতার কেন্দ্র থেকে উস্কানিমূলক তথ্য প্রচার করা হতো। সেসময় তাদের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বলি হতে হয় প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষকে। পরবর্তীতে RPF রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালি দখল করে নিলে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে।