যে নীতি শুধুই এরদোগানের1 min read
Reading Time: 4 minutesঅনেকের মতে তিনি নতুন দিনের ইসলামি নেতৃত্বের প্রবাদপুরুষ, খিলাফতের মুকুটহীন বাহক। কারো কারো মতে তিনি ধর্মান্ধ। আবার অনেকের কাছে সবটাই রাজনীতি। কামাল আতাতুর্কের দীর্ঘদিনের সেক্যুলার নীতি তুরস্কের বুকে কিছুটা হলেও দূর্বল হতে চলেছে। যার ফলাফল ছিল বিখ্যাত হায়া সোফিয়ার সামনে মসজিদ হিসেবে এর পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিক্ষোভ। তাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। প্রেসিডেন্টের সরাসরি নির্দেশ অমান্য করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। হায়া সোফিয়া আবার ফিরেছে মসজিদ হিসেবে। যদিও তাতে পুরাতন জাদুঘর আর গির্জাকালীন অনেক ছবি আজো আছে। তবে মসজিদ হিসেবে হায়া সোফিয়ার প্রত্যাবর্তন বেশ বড় এক বার্তা। যে বার্তা প্রচার করে এরদোগানের একেবারেই অন্য ধারার এক রাজনীতির। এরদোগানের এই নীতিতে রাষ্ট্র নিজেই একটা পক্ষের প্রতিনিধি, এবং তা বৈশ্বিক পর্যায়ে।
নীতির প্রশ্নে এরদোগান
রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানকে নিয়ে বাংলাদেশেও সম্প্রতি বই লেখা হয়েছে। সারাবিশ্বে মুসলিম শাসকদের সাথে জনগণের দূরত্ব যেখানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সেখানে এরদোগান এখনো পর্যন্ত জনতার বেশ কাছাকাছিই বলা চলে। গত ফেব্রুয়ারিতে গ্যালপ ইন্টারন্যাশনালের পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, জনপ্রিয়তার বিচারে বিশ্বের পঞ্চম এবং মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতার নাম রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান।
এরদোগান শুধু তুরস্ক সংক্রান্ত বিষয়েই না, বরং মুসলিম বিশ্বের একজন প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে বারবার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গিয়েছেন। কাশ্মীর ইস্যু, ফিলিস্তিন ইস্যুতে তিনি সব সময়েই ছিলেন অন্য যেকোন মুসলিম নেতার চেয়ে বেশি সোচ্চার। বর্হিবিশ্বের প্রতি তার মনোভাবকে রাজনীতি না বলে “নীতিবান আচরণ” বলাটাই অনেক বেশি যৌক্তিক।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিশরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি নয় যুবককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করলে সরাসরি এর প্রতিবাদ করেন এরদোগান। শুধু প্রতিবাদেই থামেননি। বরং সিসির আনুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রস্তাবও প্রত্যাখান করেন। রাষ্ট্রীয় টিভিতে তিনি সোজাসুজিই বলেছিলেন, সিসির মতো লোকের সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই তার। এমনকি সিসির একনায়কতন্ত্রের বিরোধীতাও তিনি প্রকাশ্যেই করেছেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইসরাইলের সাথে করা চুক্তির ব্যাপারেও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন এরদোগান। এই চুক্তির প্রেক্ষাপটে তুরস্ক আর আরব আমিরাতের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক কার্যত শেষ করে দিয়েছেন তিনি। আরো একবার গণমাধ্যমের সামনে এসে এরদোগান নিজের স্পষ্টভাষী মন্তব্য দিয়েছেন। তিনি জানান, “ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে কোন ধরণের পদক্ষেপই বরদাশত করা হবেনা। আমি তাকে (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বলে দিয়েছি হয় আবুধাবির সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত থাকবে অথবা আমাদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে আনবে।”
রাজনীতির এরদোগান
বহির্বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ আর ঐক্যের ব্যাপারে যতটা সোচ্চার, নিজ দেশের উন্নয়নেও এরদোগান ঠিক ততটাই সফল। পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ ডক্টর আবদুল কাদির খানের গবেষণা অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০১৩ সালে তুরস্কের জিডিপি ছিল প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার। এটি মধ্যপ্রাচের তিনটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক রাষ্ট্র ইরান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোট জিডিপির সমান। এছাড়া এরদোগান ক্ষমতায় আসার পরই তুরস্ক শক্তিশালী বিশ অর্থনৈতিক শক্তি (জি-২০) এর সাথে যুক্ত হতে পেরেছে।
এরদোগানের সময়ে নির্মিত ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর ইউরোপের বৃহত্তম বিমানবন্দর। ক্রমাগত উন্নতির নিদর্শন হিসেবে তুর্কি এয়ারলাইন্স টানা তিন বছর ধরে জিতে নিয়েছে বিশ্বের সেরা এয়ারলাইনের সম্মান। এর বাইরে ১২৫ টি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৮৯ টি স্কুল, ৫১০ টি হাসপাতালের নির্মাণ নিঃসন্দেহে এরদোগানের সফলতার পরিচয় দেয়। ২০০২ সালে তুরস্কের শিক্ষা বাজেট যেখানে ছিল ৭.৫ বিলিয়ন লিরা, সেখানে ২০১১ সালে সেটি দাঁড়ায় ৩৪ বিলিয়নে।
এরদোগানের রাজনৈতিক সফলতার বড় প্রমাণ বিশ্ব পেয়েছিল ২০১২ সালে। ২০০৩ সালে এরদোগান যখন প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি তুরস্কের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপকহারে খরচ করা শুরু করেন। এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে তুরস্কের ঋণ হয়ে যায় ২ হাজার ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু মাত্র ৯ বছরের ব্যবধানে সব ঋণ শোধ করে দিয়ে ২০১২ সালে এরদোগান ঘোষণা দেন, “এবার আইএমএফ চাইলে তুরস্ক থেকে ঋণ নিতে পারে।“ ২০০২ সালে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ ছিল ২৬.৫ বিলিয়ন ডলার আর ২০১১ সালে তা হয় ৯২.২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
উন্নয়ন, সুশাসন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা-সব মিলিয়ে তুরস্কের জনগণের কাছে এরদোগান ব্যাপক জনপ্রিয়। ২০১৫ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সময় তার ভিডিও বার্তায় সায় দিয়ে ট্যাঙ্কের সামনে নিরস্ত্র জনতার বিক্ষোভ প্রমাণ করে তুরস্কের জনগণের উপর তার প্রভাব কতটা বেশি। তুরস্ক সফরকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, “একজন নেতা কিভাবে ইসলামিক, গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু হতে পারে, তার আদর্শ উদাহরণ এরদোগান।“
এরদোগানের উত্থান
১৯৫৪ সালে ইস্তাম্বুলে জন্ম নেয়া এরদোগানের মাঝে পরিণত মনোভাব দেখা গিয়েছিল কিশোর বয়স থেকেই। সংসারের স্বচ্ছলতা বাড়াতে এরদোগান কিশোর বয়সেই ইস্তাম্বুলের রাস্তায় হাজির হতেন তিলের রুটি আর লেবুর শরবত বিক্রেতা হিসেবে। মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় পরিচিত হন নাজিমউদ্দিন আরবাকানের সাথে। কোরআনের হিফজ করা এরদোগান মুগ্ধ হন আরবাকানের ইসলামি রাজনীতির চিন্তাধারায়। যুক্ত হন কমিউনিজম বিরোধী ন্যাশনাল টার্কিশ স্টুডেন্ট ইউনিয়নে।
১৯৮০ সালের এক সামরিক অভ্যুত্থানে নাজিমউদ্দিন আরবাকানের ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টি বিলুপ্ত করা হলে আরবাকানের নতুন দল ওয়েলফেয়ার পার্টির সাথে যুক্ত হন এরদোগান। এই দল থেকেই ১৯৯৪ সালে তুরস্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। এই সুযোগের যথাযথ ব্যবহার করে ইস্তানবুলের চেহারাই পাল্টে দেন তিনি। সেই সাথে সাধারণ জনগণের মাঝেও হয়ে উঠেন ব্যাপক জনপ্রিয়।
১৯৯৮ সালে ওয়েলফেয়ার পার্টিও নিষিদ্ধ করা হয়। এর প্রতিবাদে ১৯৯৮ সালে তুর্কি ভাষায় “মসজিদ আমাদের ক্যান্টনমেন্ট, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনার আমাদের বেয়নেট, বিশ্বাসীরা আমাদের সৈনিক” কবিতা পড়ে সরকারের রোষানলে পড়েন এরদোগান। তখনো তিনি ইস্তাম্বুলের মেয়র। তুরস্কের সেক্যুলার সরকার তার রাজনৈতিক মর্যাদা কেড়ে নিয়ে প্রেরণ করে কারাগারে।
পরবর্তীতে ২০০১ সালে তিনি গড়েন জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। ২ বছর পরেই নতুন এই দল নিয়ে নির্বাচিত হয়ে এরদোগান হয়ে যান তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। ২০০৩, ২০০৭, ২০১১ টানা তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট পদে। ২০১৫ সালে তুরস্কের এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের রেশ ধরে ২০১৭ সালে গণভোট করে তিনি তুরস্কের পার্লামেন্টারি সিস্টেম বদলে প্রেসিডেন্টশিয়াল সিস্টেম জারি করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এরদোগান আবারো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
মুসলিম বিশ্বের নতুন ত্রাতা!
বিভিন্ন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের প্রতি সরাসরি করা বিরোধিতাসমূহ এরদোগানকে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। ইসরাইল প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতিনিয়াহুকে সরাসরি “একটি সন্ত্রাসী দেশের নেতা” কিংবা সংকটপূর্ণ গাজা অঞ্চলকে “উন্মুক্ত কারাগার” হিসেবে উল্লেখ করে ইসরাইলি আগ্রাসনের নিন্দা জানানোর বিষয়গুলো এরদোগানের প্রতি সাধারণ মুসলমান সমাজের ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণ।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মারওয়ান মুয়াশের বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, “এরদোগানকে দেখা হয় এমন এক ব্যক্তি হিসেবে যিনি ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দাঁড়িয়েছেন, সেই সাথে নিজের দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছেন।“
আরব বিশ্বে সমালোচনা
ঐতিহাসিকভাবেই আরব বিশ্ব আর তুরস্কের অবস্থান মুখোমুখি। তুরস্কের অটোমান সম্রাজ্য মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার শাসক ছিল বেশ লম্বা সময় ধরে এবং সেসময় আরবদের প্রতি অটোমানদের আচরণ খুব বেশি সন্তোষজনক ছিল না। এমনকি আরব জাতীয়বাদীদের হত্যার প্রতীক হিসেবে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে শহীদ চত্বর বা মার্টাস স্কয়ার পর্যন্ত স্থাপিত হয়েছে।
অন্যদিকে সৌদি আরবে এরদোগানের জনপ্রিয়তার প্রশ্নে বড় দাগ নেতৃত্ব। সৌদি আরব প্রত্যাশা করে বাদশাহ আবদুল আজিজ বা প্রিন্স সালমানই প্রকৃতপক্ষে মুসলিম বিশ্বের বড় কন্ঠস্বর হয়ে উঠবেন। কিন্তু সেখানে এখন এরদোগানকেই বেশি আপনভাবে দেখছে মুসলিম সমাজ। শিয়া অধ্যুষিত ইরাক এবং ইরান সুন্নিপন্থী হবার কারণেও বেশ অনেকটা নেতিবাচকভাবেই দেখা হয় এরদোগানকে। এছাড়া ইসলামপন্থী হবার কারণে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড এবং মোহাম্মদ মুরসিকে সরাসরি সমর্থন দিয়েছিলেন এরদোগান। সামরিক শাসন জারি করে আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসীন হয়ে এরদোগানকে খুবই নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেন।
আবার এসবের বাইরে গেলে আরব বসন্তের পরে তুরস্ককে ধরা হয়েছিল মডেল রাষ্ট্র। যেখানে সত্যিকার অর্থেই একজন নির্বাচিত নেতা আছেন। আরব বিশ্ব সেইসময় এরদোগানকে বিবেচনা করেছিল এমন একজন নেতা হিসেবে যিনি নীতির প্রশ্নে অবিচল থাকবেন। এরদোগান সেই কঠিন সময়ে আরব দেশগুলোর পাশে ছিলেন। সরে এসেছিলেন তার আগের শাসকদের সামরিক নীতি থেকে। সব মিলিয়ে রাজনীতির মঞ্চে রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান শুরু করেন অন্য এক নীতির। যে নীতি শুধুই এরদোগানের।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ
Md. Mehedi Hasan
ভাই আপনাকে ইউটিউব এ দেখছি না কেন।