রক্তাক্ত ছাত্ররাজনীতি (প্রথম পর্ব): লাশ ও সন্ত্রাসের ছাত্ররাজনীতি1 min read
Reading Time: 3 minutesদেশ, জাতি ও নেতা গঠনে ছাত্ররাজনীতির গুরুত্ব এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের বোঝানো বেশ কঠিনই বটে। দীর্ঘ কাল ধরে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হওয়া ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের কৃতকর্ম দ্বারা তাদের পক্ষে সাফাই গাওয়া রাজনৈতিক দলের নেতাদের জন্য বেশ দুরূহ করে তুলেছে।
হল দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্য, সাংগঠনিক কমিটির পদ কেনা বেচা, ফাও খাওয়া এমন আরও নানা রকম সন্ত্রাসী কাজের পাশাপাশি সময় সু্যোগ পেলেই প্রতিপক্ষকে খুন করা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র নেতা-কর্মীদের কাছে মামুলি ব্যাপার মাত্র। তারা বই-পুস্তক-কলমের বদলে পিস্তল, রামদা, ছুরি, কিরিচ, হকিস্টিক, রড এসব বালিশ কিংবা তোষকের নিচে নিয়ে ঘুমাতে বেশি ভালোবাসেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরাও আর রাজনীতির বাইরে নেই। দলীয় অনুগত্য বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়াটি এখন দিবালোকের মতোই প্রকাশ্য। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই যোগ্য ব্যক্তি উপযুক্ত পদে বসেন না। নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে, নিয়োগ বাণিজ্য কিংবা নানা রকম অসৎ কাজ করতে এই উপাচার্যরা ভর করেন ছাত্র নেতাদের কাঁধের উপর। উপাচার্যদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি উপাচার্যদের লেলিয়ে দেয়া ছাত্র নেতা-কর্মীদের হাতে মার খাওয়া থেকে বাদ পড়েননি শিক্ষকরাও।
নিজ দলের রাজনৈতিক নেতা এবং উপাচার্যদের ছত্রছায়ায় এক একজন ছাত্র নেতা নিজ ক্যাম্পাসের দানবে পরিণত হয়েছেন। এমনকি পুলিশবাহিনীও এই সব ছাত্র নেতাদের সমঝে চলেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বর্তমানে এমন দঁড়িয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে লাশ না পড়া পর্যন্ত ছাত্র নেতা-কর্মীদের কুকর্মের প্রতিবাদ কেউ জানান না। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নেতাদের টর্চার শেলের কথা আজ পুরো দেশবাসী জানেন। কিন্তু তাদের থামানোর কেউ নেই। পুলিশ বাহিনিকে পাশে রেখে ছাত্র নেতা-কর্মীদের দেশীয় অস্ত্র হাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার মতো বহু ঘটনার সাক্ষী এদেশের মানুষ।
ছাত্ররাজনীতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে এ পর্যন্ত অনেকেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলেছেন। কিন্তু এর বিপরীতে অনেকেই বলেছেন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোন সমাধান নয়, বরং দমন করতে হবে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে। স্বাধীনতা উত্তর প্রথম রাষ্ট্রপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতির সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দেখে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব তুলে বিতর্কিত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৮০ এর দশকে স্বৈরশাসক এরশাদ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের উদ্যোগ নেন। তবে এরশাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। এরশাদ নিজ দল জাতীয় পার্টি সমর্থিত ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দাঁড় করাতে না পেরে সামরিক সরকার বিরোধী আন্দোলন দমন করতে এমন উদ্যোগ নেন। ১৯৮৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সন্ত্রাস বন্ধ করতে জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাব পাস হয়। কিন্তু এরশাদ শেষপর্যন্ত সফল হননি। পরবর্তীতে ২০০২ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ২০০২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় দেয়া এক বক্তৃতায় সেই প্রস্তাব তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেন-
“যাদের ছাত্রত্ব ছিল না তারা ছাত্র রাজনীতির কী বুঝবে। তারা তো ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে চাইবেই। তাদের একজন এইট পাস, আরেকজন আইএ পাস, আর একজন রাজপুত্র আসছেন তিনিও আইএ পাসের ওপর যাননি” [প্রথম আলো- ০৫.০২.২০০২]
ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা-অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে তর্কে যাওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। গত কয়েক দশকে ছাত্ররাজনীতির কি অবস্থানে পৌছেছে তার একটি চিত্র সবার সামনে তুলে করাই বরং এই লেখাটির উদ্দেশ্য। তবে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কতজন শিক্ষার্থী খুন হয়েছে তার সঠিক হিসেব পাওয়া মুশকিল। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন পর্যন্ত এই সংখ্যা ১৫৭ এ কম নয়।
১৯৭৪-২০১৯ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুন হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় | ৭৪ জন |
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় | ২৯ জন |
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় | ১৯ জন |
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | ১৯ জন |
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় | ৭ জন |
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় | ২ জন |
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় | ২ জন |
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় | ১ জন |
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় | ১ জন |
হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় | ৩ জন |
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালগুলোতে খুন হয়েছেন কমপক্ষে ২৪ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ জন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন।
(উপরের তালিকাটি প্রকৃত হিসেব নয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে এখানে একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরে আরও বেশ কিছু খুনের খটনা রয়েছে।)