বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

যেভাবে এলো এন্টিবায়োটিক 1 min read

এপ্রিল ১১, ২০২০ 3 min read

author:

যেভাবে এলো এন্টিবায়োটিক 1 min read

Reading Time: 3 minutes

দেহের কোনো অংশ কেটে গেলে, আঘাতপ্রাপ্ত হলে কিংবা পুড়ে গেলে সে ক্ষতস্থানে আক্রমণ ঘটানো রোগ জীবাণুর জন্য অনেকাংশে সহজ হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থার নাম সংক্রমণ। বর্তমান দুনিয়ায় সংক্রমণের চিকিৎসায় সবচাইতে নির্ভরযোগ্য যে ঔষধ তা হলো এন্টিবায়োটিক। গত শতাব্দীর আগে মানুষ জানতই না এ সকল সংক্রমণের মূল হোতা ব্যাকটেরিয়া। তাই বলে মানুষ সংক্রমণ ঠেকাতে বসে থাকেনি। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ নানান উপায়ে সংক্রমণের চিকিৎসা করত।

প্রাচীনকালে বিভিন্ন ছত্রাক আর গাছের লতা পাতার নির্যাস দিয়েই মূলত বিভিন্ন সংক্রমণের চিকিৎসা করতো মানুষ। প্রাচীন মিশরীয়রা ময়লা ছাতার মত দাগ পড়ে যাওয়া পাউরুটিকে সংক্রমণ স্থলে লাগিয়ে চিকিৎসা করতো। সুমেরীয় সভ্যতায় চিকিৎসকেরা কচ্ছপের খোল ও সাপের চামড়া প্রতিষেধকরূপে ব্যবহার করত। আর ব্যবিলনের মানুষেরা চোখের সংক্রমণে সাহায্য নিত ব্যাঙের পিত্ত ও টক দই দিয়ে বানানো বিশেষ ঔষধের । চীনাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা সয়াবিনের ছত্রাক আক্রান্ত বীজ ফোঁড়ার চিকিৎসায় ব্যবহার করত।  গ্রীক ও ভারতীয়দের ক্ষতস্থানের সংক্রমণ দূর করতে ছত্রাক ও বিভিন্ন উদ্ভিদের ব্যবহারের নজির পাওয়া গেছে। রাশিয়ার লোকজন আঘাতের স্থানে ঈষৎ উষ্ণ মাটি ব্যবহার করত।

 ব্যাকটেরিয়ার রাজত্বে এন্টিবায়োটিকের ধাক্কা

বর্তমানে চিকিৎসা আর ঔষধ আবিষ্কারের অভাবনীয় যুগে মানুষ যে ব্যাকটেরিয়াকে তুচ্ছজ্ঞান করে, বিশ শতকের আগে সে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত অসুখে খোদ উন্নত দেশগুলোতেই লাখ লাখ মানুষ মারা যাওয়ার নজির রয়েছে। ইতিহাস ঘাটলে এমন উদাহরণ অনেক পাওয়া যাবে।

এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের ফলে সংক্রমণ যোগ্য অসুখের নিরাময় অনেকটা চমকপ্রদভাবে সহজ হয়ে আসে। তবে এই এন্টিবায়োটিক একদিনে মানুষের হাতে আসেনি।

তার আগে অবশ্য বলে নিই এন্টিবায়োটিক আসলে কি। এন্টিবায়োটিক হল আদতে বিভিন্ন অণুজীব থেকে প্রাপ্ত জৈব রাসায়নিক উপাদান যা দেহের জন্য ক্ষতিকর  ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে বাধা দেয় কিংবা মেরে ফেলে। সে সাথে যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো, এন্টিবায়োটিক কেবল ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ বালাইয়ের ক্ষেত্রেই মোক্ষম অস্ত্র। ভাইরাস ঘটিত রোগের ক্ষেত্রে এটি মোটেই কার্যকর নয়।

এন্টিবায়োটিক আবিস্কারের ইতিহাস

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিজ্ঞানীরা এন্টিব্যাকটেরিয়াল রায়ায়নিকের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। জার্মানির শরীরতাত্ত্বিক পল এরলিক দেখতে পান কিছু রাসায়নিকের উপস্থিতিতে কতিপয় ব্যাকটেরিয়া টিকতে পারছেনা একদম। আর এ সময়ে শরীরের অন্য কোষের তেমন ক্ষতি হচ্ছে না। সবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে কিছু রাসায়নিক শরীরের কোনো কোষের ধ্বংস না করেই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মারতে সক্ষম। ১৯০৯ সালে শরীরের কোনোরূপ ক্ষতি  না করেই তিনি আর্সফেনামিন নামক রাসায়নিক প্রয়োগে সিফিলিস রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া মারতে সক্ষম  হন। আর এরই মাধ্যমে আধুনিক এন্টিবায়োটিকের যাত্রাপথ শুরু হয়। আর এরলিক নিজেকে আধুনিক কেমোথেরাপির জনক হিসেবে ঘোষণা দেন। কিন্তু এর ত্রিশ বছর পর প্রথমবারের মতন এন্টিবায়োটিক শব্দের ব্যবহার করা হয়। ইউক্রেন-আমেরিকান বংশোদ্ভূত গবেষক ও অণুজীববিজ্ঞানী সেলম্যান ওয়াক্সম্যান তার গোটা জীবনে প্রায় ২০টিরও বেশি এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেন।

তবে এন্টিবায়োটিকের কথা বললে যে মানুষটির প্রসঙ্গ আনতেই হয় তিনি হলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। “আমি পেনিসিলিন উদ্ভাবন করিনি বরং প্রকৃতিই তা করেছে। এটা আমার দূর্ঘটনাপ্রসূত আবিষ্কাত মাত্র” এই ছিল আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর সরল স্বীকারোক্তি।

১৯২৮ সালের কোনো এক বিকেলে সাফ্লক শহরে ছুটি কাটিয়ে ফ্লেমিং তার ল্যাবে ফিরে দেখতে পান এক বিস্ময়কর জিনিস। ল্যাবে ফেলে রাখা স্ট্যাফিলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া তিনি ভুল করে খোলা একটি প্লেটে রেখে গেছেন। আর তার উপর অজানা এক ছত্রাক বাসা বেঁধেছে যার কারণে আর ব্যাকটেরিয়ার কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। ফ্লেমিং এর নাম দেন পেনিসিলিন। পরে জানা গেছে এটি ছিল পেনিসিলিন নটাটাম নামক ছত্রাক। এরপর সম্পুর্ণ আলাদা এক স্থানে ফ্লেমিং আবারো পেনিসিলিন ছত্রাক চাষ করেন এবং সাফল্য পান।

এরপর স্বেচ্ছাসেবকদের উপর প্রয়োগ করে তার ফলাফল দেখে ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি নিশ্চিত হয় প্রচুর পরিমাণে পেনিসিলিন উৎপাদন ও ব্যবহার করার ফলে দেহে কোনোরূপ ক্ষতি হয়না।

পেনিসিলিনের আবিষ্কার সেসময়ের দুরারোগ্য ব্যাকটেরিয়া বাহিত রোগসমূহ থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারবে বুঝেও এর উৎপাদনের স্বল্পতার কারণে বিজ্ঞানী মহল ফ্লেমিংয়ের আবিষ্কার নিয়ে পরবর্তী একযুগেও তেমন একটা পাত্তা দেননি।

১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ফ্লোরি ও আর্নেস্ট চেইন এক পরীক্ষার মাধ্যমে পেনিসিলিন বিশুদ্ধকরণ ও ঘনীভবন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করে পেনিসিলিনের বাণিজ্যিক উৎপাদনের পথ সুগম করে।

এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বোস্টনের অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৫০০ লোক নিহত হয় ও প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটে। সে সময়ে আহতদের চামড়ায় স্ট্যাফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঘটনায় প্রথমবারের মতন পেনিসিলিন প্রয়োগ করা হয় এবং তা আশাতীত সাফল্য লাভ করে।

১৯৪৪ সাল নাগাদ গোটা বিশ্বেই জনপ্রিয়তা লাভ করে পেনিসিলিন। একই সাথে ইউরোপের দেশগুলো যুদ্ধের ময়দান আর হাসপাতালে ব্যাপকভাবে পেনিসিলিন ব্যবহার শুরু করে। ১৯৪৫ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর সাথে যৌথভাবে হাওয়ার্ড ফ্লোরি ও আর্নেস্ট চেইন চিকিৎসা শাস্ত্রের এই অসাধারণ আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরষ্কার জিতে নেন।

এরই মাঝে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই রকম ভয়াবহ যুদ্ধে আহতদের জীবাণু সংক্রমণের ফলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা। সে অবস্থার অবসানে তাই সাহায্য নেওয়া হয় পেনিসিলিনের। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপুল ব্যয়ের কারণে ব্রিটেনের জন্য এন্টিবায়োটিক গবেষণা ও উৎপাদন  খরচ বহন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

এ অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কতৃক এর উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ ঘোষণা পেনিসিলিনেরর উৎকর্ষে দারুণ সহায়ক ভূমিকা রাখে।  তারা ব্রিটেনের ‘ফ্লাস্ক’ পদ্ধতির বদলে নিজেদের কারখানাগুলোতে ভারী যন্ত্রপাতির সাহায্যে উৎপাদন বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।

ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রচুর সৈনিক হতাহতের ঘটনা ঘটে। সে সময়টায় বহু মানুষের জীবন বাচাতে সহায়ক হয়ে পেনিসিলিন ‘দ্য ওন্ডার ড্রাগ’ খেতাব পেয়ে যায়।

কোনোকিছুরই অতিরিক্ত ব্যবহার ভাল না। বর্তমানে চিকিৎসকদের অনুমোদন ও পরামর্শ ব্যাতীত এন্টিবায়োটিকের বহুল ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মানবদেহে গড়ে উঠেছে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। অর্থাৎ সঠিকমাত্রায়  পুরো সময় জুড়ে ঔষধ না সেবন করায় বেচে যায় অতি অল্প সংখ্যক রোগ জীবাণু। সে রোগ জীবাণু শিখে ফেলে কি করে এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। ফলে পরবর্তীতে দেহে সংক্রমণের ফলে দেহে উক্ত এন্টিবায়োটিক আর কার্যকর থাকেনা। এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে আজকাল। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিবায়োটিক সেবন করার বিষয়টি আমাদের খেয়াল রাখা জরুরী। তাতে আখেরে আমাদেরই কল্যাণ।

লেখক- মাহের রাহাত

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *