মোহাম্মদ আশরাফুল – বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম নক্ষত্র1 min read
Reading Time: 6 minutesএকটা সময় বাংলাদেশীদের প্রাণের খেলা ছিল ফুটবল। এটা নিয়ে দ্বিমত করার মানুষ মনে হয়না খুঁজে পাওয়া যাবে। দুই ফুটবল ক্লাব আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে ঢাকার দর্শকদের উন্মাদনা কোন পর্যায়ের ছিল সেটা কমবেশি আমাদের সবারই জানা। কিন্ত সময়ের সাথে সাথে আজ ফুটবলের জায়গা দখল করে নিয়েছে ক্রিকেট।
১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখলেও জনমানুষের মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে প্রথম আলোড়ন সৃষ্টি হয় ১৯৯৭ সালে। সেই একই বছর বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জেতে এবং এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়।
অনেক চড়াই-উতরাই পার করে ক্রিকেট আজকে দেশের ১৬ কোটি মানুষের আনন্দ উন্মাদনার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থার পেছনে অনেকেরই অবদান আছে। আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, হাবিবুল বাশার, মোহাম্মাদ রফিক এমন আরও বেশ কয়জন তারকা ক্রিকেটারের নাম প্রথমে আসবে। কিন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম মহাতারকার নাম যদি খুঁজতে চান তাহলে অবধারিতভাবেই আপনাকে মোহাম্মাদ আশরাফুল নামটি নিয়ে ভাবতে হবে।
একটা সময় বাংলাদেশ দল যখন পরাজয় অবধারিত জেনেও মাঠে নামতো তখন কিছু অনবদ্য ইনিংস খেলে এবং বড় কিছু জয়ের নায়ক হয়ে মোহাম্মাদ আশরাফুল হয়ে উঠেন দেশের ক্রিকেট পাগল মানুষদের মধ্যমণি। মোহাম্মাদ আশরাফুলের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্ত তিনি পারেননি নিজের সেই মেধার সঠিক মূল্যায়ন করতে।
মোহাম্মাদ আশরাফুল নিজের, সেই সাথে দেশের মানুষদের সাথে চূড়ান্ত অবিচারটা করলেন ২০১৩ সালে। ফিক্সিং এ জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ৮ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন। যদিও পরে শাস্তি কমিয়ে ৫ বছর করা হয়। নিজের ভুল বুঝতে পেরে মিডিয়ার সামনে আশরাফুলের কান্নায় ভেঙ্গে পড়া, নত মস্তকে ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্য আজও হয়তো অনেকের বুকে রক্তক্ষরণ ঘটায়।
সম্প্রতি ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষ করে আবার বিপিএলের মাধ্যমে আলোচনায় এসেছেন আশরাফুল। পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত থাকতে পারে। তবে আমরা তার কালো অধ্যায়টি আর মনে করিয়ে দিতে চাই না। যুক্তি তর্কে কথা হয়তো অনেক দূর গড়াবে কিন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক প্রথমের সাথে যার নাম জড়িয়ে আছে তাকে নিয়ে বাংলাদেশীদের আবেগকে অস্বীকার করারও কোন উপায় নেই।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম মহাতারকার কিছু অনবদ্য কীর্তি এবং তার ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনা এক নজরে দেখে নেয়া যাক-
অভিষেকেই বিশ্ব রেকর্ড
২০০১ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কারই মাঠে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নেমে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি করে নিজের উপস্থিতি জানান দেন মোহাম্মাদ আশরাফুল। যদিও সেই ম্যাচে বাংলাদেশ হেরে যায় ইনিংস এবং ১৩৭ রানের ব্যবধানে। কিন্ত ২ ইনিংসে যথাক্রমে ২৬ এবং ১১৪ রান করে সব আলো নিজের দিকে কেড়ে নেন। শ্রীলঙ্কান গ্রেট স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরন ২ ইনিংসে ৫ করে মোট ১০ উইকেট নিলেও ম্যাচ সেরার পুরস্কার তাকে ভাগাভাগি করে নিতে হয় আশরাফুলের সাথে।
একদিনের ম্যাচে প্রথম ম্যাচ সেরার পুরষ্কার
১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপের পর থেকে বাংলাদেশ টানা ৪ বছর কোনো জয়ের দেখা পায়নি। জয়ের জন্য মরিয়া বাংলাদেশ দল অবশেষে ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ের সাথে ৮ রানে জয় পায়। বাংলাদেশের ২৩৮ রানের জবাবে খেলতে নেমে ২৩০ রানেই অল আউট হয়ে যায় জিম্বাবুয়ে। হাবিবুল বাশারের ৮০ বলে ৬১, রাজিন সালেহর ১০৭ বলে ৫৭ রানের পাশাপাশি মোহাম্মাদ আশরাফুল ৩২ বলে ৫১ রানের টর্নেডো ইনিংস খেলেন। আজকের টি-২০র যুগে এটি ডাল-ভাত ইনিংস মনে হতে পারে। কিন্ত ২০০৪ সালের প্রেক্ষিতে এই ইনিংসটিকে আপনার বাড়তি মূল্য দিতে হবেই।
স্বাভাবিক ভাবেই ম্যাচ সেরার পুরস্কার উঠে মোহাম্মাদ আশরাফুলের হাতে। এই ছিল মোহাম্মাদ আশরাফুলের ২৪তম একদিনের ম্যাচ।
ভারতের বিপক্ষে আবারও আশরাফুল ঝলক
অভিষেক টেস্টের রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরির পর ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রামে ১৯৪ বলে অপরাজিত ১৫৮ রানের অসাধারণ একটি ইনিংস খেলেন। ১৫৮ রান করার পথে আশরাফুল ২৪ চার এবং ৩ টি ছয় মেরেছিলেন। যেকোনো বিচারে এই ইনিংসটি এখনো বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের সেরা টেস্ট ইনিংস গুলোর একটির মধ্যেই পরবে।
অস্ট্রেলিয়া বধের নায়ক
১৮ জুন, ২০০৫ সাল। ইংল্যান্ডের কার্ডিফে সেই সময়ের ক্রিকেট সাম্রাজ্য শাসন করা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামে বাংলাদেশ। তখন শুধু বাংলাদেশ কেন, যেকোনো বড় দলই হোক না কেনো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলা মানেই নিশ্চিত পরাজয়। এই ম্যাচে প্রথমে ব্যাটিং করে অস্ট্রেলিয়া ২৪৯ রান সংগ্রহ করে। কিন্ত কে জানতো মোহাম্মাদ আশরাফুল তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস খেলার জন্য বেঁচে নিয়েছেন এই দিন। ১১টি চারে সাজানো ১০০ রানের ইনিংসটি গড়তে আশরাফুল খেলেন ১০১ টি বল।
আশরাফুলে ইনিংসটির ওপর ভর করে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ। যেটি এখনো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একদিনের ম্যাচের একমাত্র জয়। অনেকেই এই জয়কে ২১ শতকের প্রথম দশকের ক্রিকেটের সেরা আপসেট বলে থাকেন।
ক্যারিয়ারের সেরা বছর ২০০৭
২০০৭ সাল বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রেমীদের মনে থাকবে অনেক দিন। বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে তাদের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় করে দেওয়া থেকে যাত্রা শুরু। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে প্রথম জয়। ওই বছরেই সেপ্টেম্বরে টি-২০ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হেসে খেলে হারানো সব মিলিয়ে পরাজয়ের বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া বাংলাদেশ দল নতুন আশার আলো দেখতে পায়। ততদিনে বাংলাদেশ দলে তত দিনে সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুসফিকুর রহিমরা চলে এসেছে। বছরের বড় ২ জয়ের নায়ক কিন্ত সেই মোহাম্মাদ আশরাফুলই।
দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ৮৩ বলে খেলা ৮৭ রানের একটি অনবদ্য ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে লড়াই করার মতো একটি পুজি এনে দেন আশরাফুল। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের মাটিতে নামিয়ে এনে ১২ টি চারের সাহায্যে এই রান করেন তিনি। ইনিংসটি আজও হয়তো অনেকের মনে আছে।
ওই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর টি-২০ বিশ্বকাপে আবার নিজের সেরা অবস্থায় ধরা দেন আশরাফুল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৬৪ রানের জবাবে খেলতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদের কচুকাটা করে ২৭ বলে ৬১ রানের একটি ইনিংস খেলে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন।
অধিনায়কত্বের ভার এবং চড়াই উতরাই
২০০৭ সালের জুন মাসে প্রথমবারের মতো অধিনায়কত্বের ভার মোহাম্মদ আশরাফুলের কাঁধে এসে পড়ে। কিন্তু তার অধীনে বাংলাদেশ দলের বলার মতো কোন অর্জন পায়নি। বাংলাদেশ দলে নতুন এক ঝাঁক মেধাবী ক্রিকেটার এসে যোগ দেয়। তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহ্মুদুল্লাহর মতো তরুণরা যখন নিয়মিতভাবে ভালো খেলা শুরু করেন সেখানে ঠিক উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেন আশরাফুল। তার ক্যারিয়ারের গ্রাফ নিচে নামতে থাকে। এমনকি বাদ পড়ে যান দল থেকেই।
১৫ মাসের বিরতি দিয়ে ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবার ফেরেন আশরাফুল। শ্রীলঙ্কার মাটিতে ৪১৭ বলে খেলেন ১৯০ রানের ক্যারিয়ার সেরা টেস্ট ইনিংস। আশরাফুলের সামনে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ২০০ রান ছোঁওয়ার একটা সুযোগ ছিল। কিন্ত পারেননি তিনি। ওই ম্যাচেই মুশফিক প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ২০০ রান করার গৌরব নিজের করে নেয়।
আশরাফুলের এই ইনিংসের পর সবাই যখন আবার আশরাফুলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আসে ফিক্সিং এর সাথে মোহাম্মাদ আশরাফুলের জড়িত থাকার খবর।
অসমাপ্ত উপসংহার
৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষ। এখন মোহাম্মাদ আশরাফুলের বয়স ৩৪। ফিটনেস ধরে রাখতে পারলে আরও অন্তত ২-৩ বছর খেলা চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্ত জাতীয় দলে জায়গা করা যে সহজ ব্যাপার না এটা আশরাফুল নিজেও জানেন।
বাংলাদেশের বর্তমান দলে “পঞ্চপাণ্ডব” মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহকে বাদ দিলে তরুণ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কারোরই জায়গা দলে পাকা নয়। সৌম্য, ইম্রুল, সাব্বির, লিটন কেউই এখন দলে নিয়মিত পারফর্ম করেন না। এই সুযোগটা আশরাফুল কাজে লাগাতে পারবেন কিনা সেটার জন্য হয়তো আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
শুরু থেকেই মোহাম্মাদ আশরাফুল যেন এক ধাঁধার নাম। বারবার ব্যর্থ হওয়ার ফাঁকে ফাঁকে অসাধারণ সব ইনিংস খেলে তাক লাগিয়ে দিতেন পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে। বাংলাদেশের অনেক প্রথমের সাথে আশরাফুলের নাম জড়িত জন্যই কিনা আশরাফুলের প্রতি দেশবাসীর ভালবাসাটা অনেকটা কিশোর বয়সের প্রেমের মতোই। আশরাফুলের নাম আসলে যুক্তি-তর্ক সরিয়ে আবেগের ভেলায় এখনো ভেসে যায় অনেক ক্রিকেট ভক্ত।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হামাগুড়ি দিতে থাকা বাংলাদেশকে ২০০১ থেকে ২০০৯-১০ পর্যন্ত যতবার আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছেন আশরাফুল তাতে তাকে নিয়ে ভক্তদের আবেগকে বাড়াবাড়ি বলার কি সুযোগ আছে?