যে কয়টি মেগা প্রকল্পর মাধ্যমে বিশ্বের দুয়ারে বাংলাদেশের অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে তারমধ্যে অন্যতম একটি প্রকল্প হলো মেট্রোরেল। শুধু বিশ্বের দুয়ারেই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই মেট্রোরেল নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই।ইতোমধ্যেই জ্যামের শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে অনেক পরিসংখ্যানেই ঢাকার নাম চলে এসেছে। আর এই জ্যামের শহর ঢাকায় বসবাসরত কোটি মানুষের দৃষ্টি এখন আপাতত পড়ে আছে এই একটি প্রকল্পের দিকে, সবার বিশ্বাস মেট্রোরেলের মাধ্যমেই হয়তো শেষ হতে যাচ্ছে জ্যামে আক্রান্ত সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ।
উল্লেখ্য যে বর্তমানে রাজধানী শহর ঢাকার এই জ্যামের অন্যান্য আরো কারণের মধ্য অন্যতম একটি কারণ হল মেট্রোরেলের কাজ। এই শহরের প্রধান সড়কের বুক চিড়ে মাটির নীচ থেকে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে একটি একটি করে কলাম আর তার উপরে বসছে মেট্রোরেলের স্প্যান। দৃশ্যটি দেখতে চমৎকার হলেও প্রধান সড়কের উপর দিয়ে এই কাজ চলার কারণে প্রতিনিয়ত জনজীবনে দুর্ভোগের সীমা নেই। তবে এই জ্যাম সহ্য করে হলেও মানুষের মনে এখনো আশার আলো জাগিয়ে রাখতে পেরেছে এই প্রকল্প।
তবে কতদূর পথ পাড়ি দিয়েছে এই মেট্রোরেল? এই প্রশ্নের উত্তরে মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে এই প্রকল্পের লাইন-৬ এর শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালে। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৯ সালের ৩০ জুনের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উড়ালপথ এবং স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ করার কথা ছিল। আর আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়ার কথা ওই বছরের ডিসেম্বরে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ বাস্তবায়নের কথা। ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সিদ্দিক বলেন, উত্তরা-আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটারের ইতোমধ্যেই তিন কিলোমিটার অংশ দৃশ্যমান হয়ে গেছে। এছাড়া প্রকল্পটির কাজ বর্তমানে বেশ দ্রুত গতিতেই চলছে বলে তিনি দাবী করেন। বর্তমানে এই লাইনের প্রায় ৩৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গেছে এবং বর্তমানে উত্তরা-আগারগাঁও লাইনের নয়টি স্টেশনের কাজ চলছে।
জেনারেল ম্যানেজার সিদ্দিক আরো বলেন, দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত লাইন-৬ এর কাজ ২০২০ সালের শেষের দিকে সমাপ্ত হয়ে যাবে। সরকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের লাইন-৬ এর কাজ আটটি প্যাকেজের মাধ্যমে শেষ করার জন্য উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
প্রথম প্যাকেজে ছিল ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের আওতায় যেটা ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে এবং এই কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখে। এই ডিপার্টমেন্টের কাজ প্রায় ৯ মাস দেরীতে শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে।
দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় সিভিল ডিপার্টমেন্ট কাজ করেছে এবং তারা ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ কাজ শেষ করেছে এবং বাকি কাজ এই বছরের শেষের দিকে সমাপ্ত হবে বলে সবাই ধারণা করছে। তৃতীয় ও চতুর্থ প্যাকেজের আওতায় বোরিং করা, প্রাথমিক পাইলিং করা এবং মূল পাইলিং করার কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে এবং এই কাজের ৭৬৬টি পাইল ক্যাপের মধ্যে ৫৮২টি পাইলিং ক্যাপ একদমই শেষ। উল্লেখ্য যে ৪৪৮টি পিয়ার হেডের মধ্যে ৮৮টি পিয়ারহেড সহ ৬১৭টি প্রিক্যাস্ট সেগমেন্টের কাজ ইতোমধ্যেই সমাপ্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ থেকে লাইন-৬ এর বগি বানানোর কাজ শুরু হয়েছে , যেটা প্যাকেজ আট এর মধ্যে অন্তর্গত। এছাড়া পঞ্চম প্যাকেজের আওতায় প্রায় ৩.২ কিলোমিটার ব্রিজের কাজ এবং আগারগাঁও থেকে কাওরান বাজার পর্যন্ত তিনটি স্টেশনের কাজ শেষ হয়ে গেছে। ষষ্ঠ প্যাকেজের মধ্যে অন্তর্গত কাওরান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত স্টেশনের কাজগুলো বর্তমানে নির্মাণাধীন।
মেট্রোরেলের প্রাথমিক ধাপের কাজ ২০২০ সালে শেষ হয়ে গেলে, ২০২০ সাল থেকেই প্রতিদিন ৪ লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী আসা যাওয়া করতে পারবেন। এছাড়া ২০২৬ সালের অন্য পর্যায়ের কাজ শেষ হলে ৫ লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবেন। এই মেট্রোরেলের সর্বশেষ ধাপ এর কাজ পুরোপুরি শেষ করলে প্রতিদিন প্রায় ১৩ লাখ যাত্রী এই প্রকল্পের সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মেট্রোরেলের কাজ খুবই দ্রুত গতির সাথে এগিয়ে চলছে। লাইন-৬ যেটা উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে মিরপুর হয়ে ঘুরে ফার্মগেটের উপর দিয়ে মতিঝিল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে তারমধ্যে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম ভাগের প্রায় সত্তর ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। শ্যাওড়াপাড়া এলাকার সাব-ইঞ্জিনিয়ার আনিসুর রহমান বলেন, অনেক অংশই এখন দৃশ্যমান হয়ে গেছে এবং এই পূর্ণ গতি যদি আমরা ধরে রাখতে পারি তাহলে ২০১৯ সালের মধ্যেই কার্যকরী একটা রূপ আমাদের সামনে প্রকট হয়ে উঠবে বলে আমরা আশা করছি।
অপরদিকে এস-৮ এবং এস-৯ প্যাকেজের দায়িত্বপ্রাপ্ত তানভীর রহমান এ সম্পর্কে বলেন, আমার প্যাকেজের আওতায় আছে বেশ কয়েকটি স্টেশন, যার ফলে এই কাজটি খুব একটা সহজ নয় বরং বেশ জটিল। ২০১৯ সালের মধ্যেই আমার প্যাকেজের কাজ শেষ হবে কি না সেটা এখনো ঠিক বলা যাচ্ছে না তবে আমরা খুব দ্রুত কাজ করছি এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য সচেষ্ট আছি।
পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, ২০২২ সালের মধ্যেই আমরা একটি চলমান মেট্রোরেইল দেখতে পাব বলে আশা করছি। উল্লেখ্য যে পরিকল্পনা মন্ত্রীর সঙ্গে ১১ ফেব্রুয়ারি মেট্রোরেলের দায়িত্ব-রত জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির সাথে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির প্রতিনিধি দল পরিকল্পনা মন্ত্রীকে আশ্বাস দেন যে নির্ধারিত সময় ২০২২ সালের মধ্যেই মেট্রোরেলের কাজ শেষ হয়ে যাবে।
পরিশেষে এটুকু বলা যায়, সাধারণ জনগণ আদতে জ্যামে অতিষ্ঠ হয়ে এখন অপেক্ষারত অবস্থায় দিন যাপন করছে। কবে আসবে সেই মহেন্দ্র ক্ষণ, কবে চালু হবে মেট্রোরেল। যে মেট্রোরেলের স্বপ্ন দেখছে মানুষ, সেই মেট্রোরেলের মাধ্যমে মানুষের ক্লান্তি, সময় ও শ্রম বেঁচে গিয়ে প্রিয় শহর রাজধানী ঢাকা রূপ নিবে এক অন্য ও অনন্য রূপে।