Site icon Bangla Info Tube

মৃত্যুশয্যাতেও প্রতিবাদী নুসরাত চিরনিদ্রায়

Image Source: prothomalo.com

Reading Time: 3 minutes

ঘটনাটির সূত্রপাত খুব বেশী দিন আগের নয়, গত ২৭ মার্চেই শুরু হয়েছিল এই দুঃসহ যন্ত্রণার। বলছি  ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাত জাহান রাফির জীবনে নেমে আসা দুঃসহ এক কালো অধ্যায়ের কথা। গত ২৭ মার্চ ফেনীর সোনাগাজীর একটি মাদ্রাসা অধ্যক্ষ নিজ কক্ষে ডেকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিলেন। অধ্যক্ষ হয়তো ভেবেছিলেন খুব সহজেই ধামা চাপা দেয়া যাবে এই নোংরামি। তবে আর আট দশটা অবলা নারীর মত ছিলেন না এই নুসরাত। নুসরাত জানতেন কীভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়।

পুলিশের কাছে তাৎক্ষনিকভাবে মামলা করে দেয়া হয় নুসরাতের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং পুলিশ সেই অধ্যক্ষকে মামলার উপর ভিত্তি করে গ্রেফতার করে। তারপর থেকেই মামলা তুলে নেয়ার জন্য শুরু হয় নুসরাতের পরিবারের উপর হুমকি। তবে শুধু হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি দুর্বৃত্তরা,  আরবী পরীক্ষা দিতে গেলে সেখানে কৌশলে ছাদে নিয়ে গিয়ে তারা কেরোসিন তেল ঢেলে নুসরাতের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে তাৎক্ষনিকভাবে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। পরবর্তী চিকিৎসার জন্য নুসরাতকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ফেনী সদর হাসপাতালে। সেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয় নুসরাতের শরীরের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ আগুনে পুড়ে গেছে। সবশেষে তাকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে। প্রধানমন্ত্রী নুসরাতকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে সিঙ্গাপুর নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তবে এই আগুন দিয়েও থামানো যায়নি নুসরাতের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, আগুনে পোড়া নুসরাত মৃত্যু শয্যা থেকেও বলেছিলেন,  ‘আমি এর প্রতিবাদ করে যাব শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত, সারা পৃথিবীর কাছে বলবো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য।”

নুসরাতের স্বজনদের অভিযোগ গত ২৭  মার্চ সেই অধ্যক্ষ- এর বিরুদ্ধে করা মামলাটি তুলে না নেয়ার কারণেই নুসরাতের উপর ভয়ংকর হামলা নেমে আসে। লাইফ সাপোর্টে যাওয়ার আগে নুসরাত রোববার দিন চিকিৎসকদের কাছে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, নেকাব ও হাতমোজা পরা চারজন তাকে কৌশলে ছাদে নিয়ে গিয়ে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। জবানবন্দি মতে তাদের একজনের নাম ছিল শম্পা।

লাইফ সাপোর্টে  জীবন ও মৃত্যুর সাথে লড়তে থাকা নুসরাত জাহান রাফি অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে শেষপর্যন্ত বুধবার রাত ৯টার দিকে ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যক্ষসহ এখন পর্যন্ত মোট নয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বুধবার দুপুরে সোনাগাজী থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয় এবং মামলাটি পিবিআই এর কাছে দেয়া হয়। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও চলছে মামলাটির বিষয়ে তদারকি। হাইকোর্ট থেকেও বলা হয়েছে যে এই মামলার গতি প্রকৃতি সম্পর্কে তীক্ষ্ণ নজর রাখা হবে। এর আগে ঘটে যাওয়া সাগর-রুনি,  তনুসহ অন্যান্য আরো মামলাগুলোর মতই যেন সময়ের সাথে সাথে এই মামলাটিও যেন আড়ালে চলে না যায় সেদিকে ইঙ্গিত করে হাইকোর্ট থেকে এই নজরদারির ব্যাপারে বলা হয়েছে। আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক  আবেদন করার পর হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ এবং রাজিক আল জলিল হাইকোর্ট বেঞ্চে এগুলো বলেন।

আপাতত হাইকোর্ট থেকে অন্য কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি তবে যেকোন ধরনের গাফেলতি হলে আদালতের দরজা সব সময় খোলা আছে এবং হাইকোর্ট থেকে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে নুসরাত হত্যা মামলার প্রধান আসামী সেই মাদ্রাসা অধ্যক্ষের পক্ষে  থাকার জন্য কাজারীবাগ ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ এর সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করা হয় দল থেকে।

প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই হত্যা মামলার দোষীদের শাস্তির বিষয়ে জোর দেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন,  প্রধানমন্ত্রী নিজে এই হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার করে শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া নুসরাতের এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি।

আজ বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) সন্ধ্যা পাঁচটা পঞ্চাশ মিনিটে নুসরাত জাহান রাফির জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাজাটি সরকারি পাইলট হাইস্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এবং হাজার হাজার মানুষ এই জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। এই জানাজার নামাজের ইমামতি করেন নুসরাতের বাবা। একজন বাবার জন্য এটা কতটা মর্মান্তিক হতে পারে,  কতটা হৃদয়বিদারক হতে পারে তা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় কারো।

এর আগেও কয়েকজন বখাটে নুসরাতকে উত্ত্যক্ত করার পর তখনো জোরালোভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন নুসরাত। তখনও বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঘটনাটি উঠে এসেছিল। এখন নিজের শিক্ষকের হাতে যখন লাঞ্ছিত হতে হলো তাকে, তিনি এখনো প্রতিবাদ করলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় ও ঘটনার সঙ্গে ধর্মীয়  বিষয়ের যোগ খুঁজে কিছু মানুষ এই ঘটনায় অধ্যক্ষের পক্ষ নিয়েছে।

লাইফ সা‌পোর্টে নেওয়ার আগে নুসরাত তার মা ও ভাইকে শেষ কথা হিসেবে বলে‌ছিল যে, তার যাই হোক, তার এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী, তা‌দের যেন বিচার হয়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাড়িয়েও নুসরাত তার প্রতিবাদী কণ্ঠ থামিয়ে দেয়নি। নুসরাতের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে পুরোদেশ এখন সোচ্চার এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সবার একটাই দাবী— এমন অন্যায়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।

লেখক- ইকবাল মাহমুদ

Exit mobile version