মৃত্যু প্রকৃতির অতি স্বাভাবিক একটি ঘটনা। জন্ম নিলে মরতে হবেই। মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু সব মৃত্যু আবার স্বাভাবিক নয়। মৃত্যুর পিছনে থাকে নানাবিধ কারণ। নানা কারণে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ বিশ্বজুড়ে মারা যাচ্ছে। পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী এমন প্রধান ১০টি কারণ চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
যক্ষ্মা
যক্ষ্মা (Tuberculosis) বা টিবি একটি সংক্রামক রোগ। মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস (Mycobacterium tuberculosis) নামক একটি জীবাণু এই রোগের জন্য দায়ী। এই রোগে আক্রান্ত হওয়া মানেই একসময়ে নিশ্চিত মৃত্যু ধরে নেওয়া হতো। মুখে মুখে প্রচলিত ছিল “যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই”। কিন্তু বর্তমানে যক্ষ্মা রোগের কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়ায় যক্ষ্মা রোগ সহজেই নিরাময় করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে বর্তমানে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তারপরও এটি বৈশ্বিকভাবে মৃত্যুর জন্য দায়ী এমন ১০টি কারণের মধ্যে দশম স্থানে অবস্থান করছে।
ডায়রিয়া
ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়ের মতো উদরাময় জাতীয় রোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী জুড়ে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর মারা যায়। সাধারণভাবে দিনে তিন বা তার অধিকবারের বেশি স্বাভাবিকের চেয়ে পাতলা পায়খানা হওয়াকে ডায়রিয়া বলা হয়। বারবার পাতলা পায়খানা করার কারণে শরীর থেকে পানি ও লবণ জাতীয় পদার্থ বের হয়ে যায়। সময়মতো রোগীর শরীরের পানিস্বল্পতা ও লবণের ঘাটতি পূরণ না হলে তখনই মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দেয়। সাধারণত দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে ডায়রিয়ার জীবাণু মানুষের পেটে গিয়ে সংক্রমণ ঘটায়। তাই ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে দূষিত খাদ্য ও পানি পরিহার করার বিকল্প নেই। খাবার স্যালাইনের আবিষ্কার ডায়রিয়ায় মৃত্যুর হার অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা
পৃথিবী জুড়ে মানবসৃষ্ট কারণে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর হার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একটা বড় অংশ মৃত্যুবরণ না করলেও অঙ্গহানীর শিকার হয়। এতে তাদেরকে অনেক বেশি মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। উন্নতি বিশ্বের তুলনায় অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও ট্রাফিক নিয়ম-নীতির যথাযথ পালনের মাধ্যমে এই সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেকাংশেই কমে আনা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ডায়াবেটিস
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটায় এরকম প্রধান ১০টি কারণের মধ্যে ডায়াবেটিস সপ্তম। মানুষের শরীরে ইনসুলিন নামক হরমোন রয়েছে; কোনো কারণে শরীরে ইনসুলিনের উৎপাদন কমে গেলে কিংবা বাঁধাগ্রস্ত হলে তখন গ্লুকোজের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়- এমন পরিস্থিতিকেই ডায়াবেটিস বলা হয়ে থাকে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, পৃথিবীতে প্রতি ১০ সেকেন্ডে দুইজন ডায়াবেটিস রোগী সনাক্ত করা হয় এবং প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষ মারা যায়। ডায়াবেটিস রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময় করা যায় না। তবে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে এটি নিয়ন্ত্রণে যেমন রাখা যায় তেমনি সুস্থভাবেও জীবনযাপন করা যায়। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ৪০ কোটিরও বেশি মানুষ ডায়বেটিসে আক্রান্ত। আর এই আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ প্রতি বছর প্রাণ হারায়।
ফুসফুস ক্যান্সার
ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর অন্যতম একটি হলো ফুসফুসের ক্যান্সার। মধ্য বয়স্ক ও বয়স্কদের এই রোগে আক্রান্ত হতে বেশি লক্ষ্য করা যায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১৬ লাখেরও বেশি মানুষ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। মূলত ধূমপায়ীরাই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ১৫% রয়েছে অধূমপায়ী। চিকিৎসকেরা সার্জারী, রেডিয়েশন, থেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্তদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে ক্যান্সার নিরাময়ের কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি; ফলে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্তদের অধিকাংশই মৃত্যুবরণ করে থাকে।
অ্যালজেইমার ডিজিজ
অ্যালজেইমার্স হচ্ছে মস্তিষ্কের এমন এক ধরনের রোগ যার কারণে রোগী কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না। এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো উপসর্গ না থাকায় এবং কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার না হওয়ায় এই রোগে আক্রান্ত মানুষের হারও বেশি। এই রোগের প্রথম লক্ষণ হিসেবে ধরা হয় স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া। সাধারণত এই রোগের কারণে স্মৃতি লোপ পাওয়া থেকে শুরু করে কখনো কখনো রোগীর ভারসাম্যহীনতাও দেখা দিয়ে থাকে। এই রোগটি রয়েছে তালিকার পঞ্চম স্থানে।
লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন
শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ যেমন ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া, ল্যারিনজাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি এসব রোগগুলোকে বলা হয়ে থাকে লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা এলআরটিআই। এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ৪০ লক্ষের কাছাকাছি মানুষ মারা যাচ্ছে। লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনে আক্রান্তের তালিকায় শিশুর সংখ্যা বেশি হলেও বয়স্করাও এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা এইসব রোগ সংক্রমিত হয়ে ফুসফুস ও শ্বাসনালীকে আক্রান্ত করে থাকে। গবেষণা বলছে, প্রতিদিনই আমাদের শ্বাসনালী দিয়ে প্রায় ৭ হাজার লিটার বাইরের বাতাস ফুসফুসে ঢুকে ও বের হয়। সাধারণত এই বাতাসের সঙ্গেই এইসব রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে থাকে। কিন্তু কোনো মানুষের শ্বাসতন্ত্রের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি ভাল হয় তাহলে এসব রোগ জীবাণু সংক্রমণ ঘটাতে পারে না। তবে কোনো কারণে যখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তখনই এসব জীবাণু দ্বারা শ্বাসতন্ত্র সংক্রমিত হয়।
ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ
শ্বাসকষ্টের অন্যতম একটি কারণ হলো ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ; যাকে সংক্ষেপে বলা হয় সিওপিডি। এটি ফুসফুসের একটি দীর্ঘমেয়াদি তীব্র প্রদাহজনক রোগ। কেনো মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হলে বায়ু ঠিকমত তার ফুসফুসের মধ্যে পরিবাহিত হতে পারে না। এই রোগে আক্রান্ত হলে শ্বাসনালির দেওয়াল পুরু হয়ে যায় এবং ফুসফুসের ভিতরকার ক্ষুদ্র বায়ুথলিতে বাতাস আটকে থাকে। ফলে ফুসফুসের ভিতরে বায়ু ঢুকতে পারে না।
এই রোগে আক্রান্ত হয় প্রতিবছরই বিশ্বজুড়ে ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এই রোগের প্রধান লক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী কাশি, বুকে চাপ অনুভব, ক্লান্তি, বুকের ভিতর শো শো শব্দ হওয়া, শ্বাসকষ্ট, কাশির সঙ্গে শ্লেষ্মা ক্ষরণ ইত্যাদি। সাধারণত ধূমপায়ীরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তবে দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে আসলেও যে কোনো মানুষ ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
স্ট্রোক
যখন কোনো কারণে মানুষের মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয় তখনই সাধারণত মানুষের স্ট্রোক ঘটে থাকে। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, মাদক সেবন, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমল পানীয় গ্রহণ, অধিক পরিমাণে লবণ খাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, রক্তে বেশি পরিমাণ চর্বি, স্থূলতা, অতিরিক্ত টেনশন, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি কারণে প্রতিবছর স্ট্রোকে আক্রান্তের হার দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। অনেকেই স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হলেও তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর জন্য প্রধানতম দায়ী হলো ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ; যাকে করনারি আর্টারি ডিজিজ হিসেবেও অবহিত করা হয়ে থাকে। এই মহাঘাতকের কারণে প্রতি বছর ৯০ লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। ডায়েবেটিস, ধূমপান, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার খাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি কারণে এই জটিল হৃদরোগ হয়ে থাকে। এছাড়াও পারিবারিক ইতিহাস ও বয়সও এই হৃদরোগ তৈরির পিছনে অনেকাংশেই দায়ী।
বুকে ব্যথা হলো ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। এই ব্যথার সাথে অনেক সময় খুব বেশি ঘাম, শ্বাসকষ্ট, বুক ধরফর করা ইত্যাদি সমস্যা থাকতে পারে। যদি হার্ট অ্যাটাক হয় তাহলে তীব্র ব্যথা হবে। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক না হলে ব্যথার ধরনটা অনেকটাই এমন হবে যে, কাজ করার সময় ব্যথা অনুভব হচ্ছে, আবার বিশ্রাম নিলে ব্যথাটা চলে যাচ্ছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, হার্ট অ্যাটাকে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের তুলনায় ইউরোপের মানুষ বেশি মৃত্যুবরণ করে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের খাদ্যাভাস অনেকাংশেই দায়ী।
সময়ের পরিক্রমায় মৃত্যুর জন্য দায়ী কারণগুলোর পর্যায় ক্রমিক অবস্থানের রদবদল হয়। এছাড়াও পৃথিবীর স্থানভেদে মৃত্যুর কারণের ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হয়। তবে সার্বিক দিক বিবেচনা করে ২০১৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই কারণগুলোর পর্যায় ক্রমিক অবস্থান চিহ্নিত করে; যা ২০১৮ সালে এসে সংশোধিত আকারে পুনরায় প্রকাশ করে।
লেখক- আমিনুল ইসলাম