১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালীদের উপরে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হামলার পর পূর্ব পাকিস্তানীদের জন্য চূড়ান্তভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া অনিবার্য হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়ন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত ও নির্যাতিত সকল পেশা ও শ্রেণীর মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই দেশ শত্রু মুক্ত করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। শুরু হয় চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধ।
কেন গঠন করা হয় মুজিবনগর সরকার?
এমন একটি মুক্তির সংগ্রাম পরিচালনার জন্য আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় যোগ্য ও সুসংগঠিত নেতৃবৃন্দের, যারা তাদের নেতৃত্বের গুণাবলী ও দক্ষতা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উত্তোলন করতে পারবে। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার; যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। এটি অস্থায়ী সরকার ও প্রবাসী সরকার নামেও পরিচিতি লাভ পায়।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল আওয়ামী লীগের প্রধান নেতৃবৃন্দদের নিয়ে মুজিবনগর সরকার ঘোষণা করা হয়। ২৫মার্চ রাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। তাজউদ্দিন আহমেদ কোনোরকমে নিজ বাসভবন ছেড়ে পালিয়ে যান এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেন। এজন্য ৩ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমেদ তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পরামর্শ ও বৈঠক করেন।
৮ এপ্রিল তাজউদ্দীন কলকাতায় আওয়ামী ও যুব নেতৃবৃন্দকে নতুন সরকার গঠনের কথা জানান। এরপর ১০ এপ্রিল, ১৯৭১, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় শিলিগুড়ির জঙ্গলের গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে তাজউদ্দীন আহমদের দিকনির্দেশনাপূর্ণ ঐতিহাসিক এক ভাষণ প্রচার করা হয়। এই ভাষণের মাধ্যমে তাজউদ্দীন বিশ্ববাসীকে জানান দেন স্বাধীন বাংলাদেশের কথা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামের কথা, একই সাথে তিনি বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানান নয়া রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান
১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের ঘোষণা করা হলেও শপথ অনুষ্ঠান হয় ১৭ এপ্রিল। শপথ গ্রহণের স্থান নির্ধারণ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা বিরাজ করছিল। কারণ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নব্য গঠিত সরকারের নেতৃবৃন্দের উপরে যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ করে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার আশঙ্কা ছিল। এই জন্য এমন একটি স্থান খোঁজা হচ্ছিল যেখানে ভারত থেকে প্রবেশ করা সহজ হয়, কিন্তু আকাশ পথে কিংবা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে স্থলপথে প্রবেশ করা বেশ কঠিন হয়। অনেক চিন্তা ভাবনার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানেই অনুষ্ঠিত হবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। কারণ এই স্থানে ভারত থেকে প্রবেশ করা অনেক সহজ ছিল, কিন্তু আমবাগান থাকার কারণে আকাশপথে এই স্থান সহজেই দেখা সম্ভব হতো না। এছাড়াও স্থলপথে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আমবাগানে যাওয়ার রাস্তা বেশ দুর্গম ছিল; যদিও তা মেহেরপুর শহর থেকে বেশী দুরে ছিল না।
তবে বিভিন্ন সূত্রের প্রমাণ মেলে প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ১৪ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেবে। কিন্তু পাকিস্তান হানাদার বাহিনী জানতে পারার কারণে তারা ১৩ই এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলা চালায়। ফলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ১৭ই এপ্রিল শপথ গ্রহণের দিন ধার্য করা হয় এবং সবদিক বিবেচনা করে অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানকেই বেছে নেওয়া হয়।
অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এই শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের সকল কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। ভবেরপাড়া মিশনারি হাসপাতাল থেকে কিছু চেয়ার টেবিল ধার করে আনা হয় মঞ্চ তৈরি করার জন্য। মঞ্চে ৬/৭টি চেয়ার রাখা হয়েছিল। একটি চেয়ার খালি ছিল, কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুপস্থিত ছিলেন।
নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে আমবাগানে চারিদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এছাড়া বিমান হামলা মোকাবেলা করার জন্য ভারতীয় আর্মির কিছু লোকও ছিল।
সকাল নয়টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ আসা শুরু করে। এগারোটার সময় সেই কাঙ্খিত অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাংলাদেশকে “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ“ রুপে ঘোষনা করা হয়। তারপর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একে একে তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, কামরুজ্জামানসহ অন্যান্য সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর নাম ঘোষণা করেন।
এই শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আব্দুল মান্নান। আর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে শোনান গণপরিষদের স্পিকার ইউসুফ আলী। এছাড়া তিনিই ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের শপথ বাক্যও পাঠ করান। এই অনুষ্ঠানে একশর দেশি-বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। একই অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীন আহমদ তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ওই আম্রকাননের নামকরণ করেন ‘মুজিবনগর’। মুজিবনগরকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঘোষণা করা হয়।
কারা ছিলেন এই মন্ত্রিসভায়?
এই সরকার ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার রূপে কার্যকর হয়েছে– এমন মর্মে নবগঠিত সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। এই দিন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সাংগঠনিক কাঠামো গঠিত হলেও পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছিল। ১৮ এপ্রিল মন্ত্রীসভার সদস্যদের মধ্যে দপ্তর বন্টন করা হয়। ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ভাগ করা হয় মুজিবনগর সরকারকে। এছাড়াও কিছু বিভাগ মন্ত্রী পরিষদের অধীনে ছিল।
মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে তিনি জেলখানায় বন্দী থাকার কারণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাজউদ্দিন আহমেদকে করা হয় প্রধানমন্ত্রী। অর্থএবং বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান এ এইচ এম কামারুজ্জামান। পররাষ্ট্র, আইন মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় বিষায়াদির দায়িত্ব পান খন্দকার মোশতাক আহমেদ। প্রধান সেনাপতি নির্বাচিত হন কর্নেল এম এ জি ওসমানী। চিফ অফ স্টাফ এর দায়িত্ব পান কর্নেল(অব.) আব্দুর রব। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এবং বিমানবাহিনী প্রধান পান গ্রুপ ক্যাপ্টেন(অব.) এ কে খন্দকার। এছাড়াও বিভিন্ন পদে বিভিন্ন যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মুজিবনগর সরকারের কার্যকরী ভূমিকার ফলাফল স্বরূপ আমরা পাই এই স্বাধীন ও সার্বভৌম সোনার বাংলাদেশ।