বিজয়ের মাসে যুদ্ধের ছবি1 min read
Reading Time: 5 minutes‘কোথাও আর অন্য কথা নেই। মা হারা বাপ হারা সন্তান হারা পিতার নিরুদ্ধ বেদনার্ত কাহিনী। কিন্তু তাঁর মধ্যেও সুগভীর বিশ্বাসে কি অপরিসীম ধৈর্যে প্রতীক্ষা। আল্লাহ সুদিন দেবেন। সকলের মিলিত প্রার্থনায় আল্লাহ দেশের ভালো নিশ্চয়ই করবে।‘
(২৭ মে, ১৯৭১)
_ একাত্তরের ডায়েরি – সুফিয়া কামাল (পৃষ্ঠা ৭০)
দীর্ঘ নয়মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শেষে বিজয়ের দেখা পায় বীর বাঙালি। স্বাধীনতা অর্জিত হলেও এর পাশেই দগদগে হাহাকার হয়ে জমে থাকে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মোৎসর্গ। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী প্রায় কড়া নাড়লেও গৌরবোজ্জ্বল এই অধ্যায়ের গল্প খুব কমই এসেছে রূপালি পর্দার আঙিনায়। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের কথা জেনে নিন তবে।
গেরিলা (২০১১)
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক রচিত ‘নিষিদ্ধ লোবান’এর সফল চিত্ররূপই ‘গেরিলা’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অধিকাংশ চলচ্চিত্রের গল্প ঘনীভূত হয়ে থাকে এর পুরুষ চরিত্রকে কেন্দ্র করে। সেদিক দিয়ে ‘গেরিলা’ স্বমহিমায় অনন্য। যুদ্ধক্ষেত্রে নারীর অবদান যে বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছে সেদিকে আলোকপাতই ছিল এর পরিচালক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর লক্ষ্য।
অপারেশন সার্চলাইটের রাত থেকে যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়া বিলকিস বানুকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে ২ ঘণ্টা ১৬ মিনিটের গোটা ছবি। সাংবাদিক স্বামী হাসানের খোঁজ থেকে ক্রমে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণের সাথে যুক্ত হন বিলকিস। যুদ্ধের নির্মমতায় হতবিহবল হলেও পিছিয়ে যাননি তিনি। নিজ জীবন উৎসর্গ করে হলেও বুদ্ধি ও সাহসের জোরে পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প উড়িয়ে দেন শেষে। বদলা নেন নিজ ভাইয়ের হত্যাকারীদের।
ইবনে হাসান, এশা ইউসুফ ও হাসান আবিদুর রেজার প্রযোজনায় ছবিটি মুক্তি পায় ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ ও এবাদুর রহমানের চিত্রনাট্যের ব্যঞ্জনা ছবিকে প্রাঞ্জল করতে যেমন সাহায্য করেছে তেমনি মূল ভূমিকায় জয়া আহসানের অভিনয়ও পেয়েছে কালজয়ী তকমা। এছাড়াও এতে অভিনয় করেছেন ফেরদৌস, শম্পা রেজা, আহমেদ রুবেল, মোস্তফা মনোয়ার, শতাব্দী ওয়াদুদ, আহমেদ রুবেল, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। সেরা পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, আর্ট ডিরেক্টর অভিনেত্রী, নেতিবাচক চরিত্রসহ দশটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরষ্কারের রেকর্ড গড়ে ছবিটি।
ভুবন মাঝি(২০১৭)
সরকারি অনুদানে নির্মিত ‘ভুবন মাঝি’ মুক্তি পায় ২০১৭ সালের ৩ মার্চ। কলকাতার জনপ্রিয় গুণী অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও অপর্ণা ঘোষকে লাইমলাইটে রেখে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রটি তৈরি করেন ফখ্রুল আরেফিন খান।
১৯৭০–৭১ এবং ২০০৪ থেকে ২০১৩– এই দুই টাইমলাইনের আবর্তে দর্শকদের সামনে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধকে। কুষ্টিয়ার এক নাটকপাগল তরুণ নহির। রাজনীতিতে তীব্র অনাগ্রহী হলেও প্রেমিকা ফরিদার গুণে কাব্যে, গল্পে অনুধাবন করতে পারেন শোষিত জনতার শ্লেষ। একাত্তরের উন্মত্ত অবস্থায় নহিরও নাম লেখায় মুক্তিবাহিনীতে। অগণিত অপারেশন শেষে ছিনিয়ে আনে রক্তিম লাল সূর্য। কিন্তু বীরাঙ্গনা ফরিদাকে সে আর খুঁজে পায়নি কোনদিন। সেই অতুল বেদনা নিয়েই বাউলগানে নিজেকে উৎসর্গ করেন, গ্রহণ করেন আনন্দ সাঁই নাম।
সাধারণ কুষ্টিয়ার অনাবিল সৌন্দর্যের সাথে কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সঙ্গীতের মিশেল আলাদা করে বলবার মতোই বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের গল্প এককভাবেই বলিষ্ঠ, বাড়তিভাবে তাই সিনেমাটোগ্রাফির দিকে মনোযোগ খুব কমই দেখা যায়। সেক্ষেত্রে ভুবন মাঝি ব্যতিক্রম। প্রধান দুই অভিনেতা ছাড়াও মাজনুন মিজান, কাজি নওশাবা আহমেদ, মামুনুর রশিদ, ওয়াকিল আহাদ, সুষমা সরকার প্রমুখও আছেন এতে।
আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১)
মুহ্মমদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ এর কাহিনী নিয়ে একই নামে নির্মিত চলচ্চিত্রতি মুক্তি পায় ২০১১ সালের ১ এপ্রিল। পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম মূলত শিশুকিশোর দর্শকের কথা মাথায় রেখেই ছবি নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছিলেন। সে হিসেবে তাঁকে সফল বলাই যায়।
কিশোর ইবুর জবানিতে আরেক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের নস্টালজিয়াই ছিল কাহিনী প্রতিপাদ্য বিষয়। উপন্যাসটি যাদের আগেই পড়া তাদের কাছে বেশ আশাব্যঞ্জক ছিল এর চিত্রায়ন। রাশেদ চরিত্রে নবাগত চৌধুরী জাওয়াতা আফনানের পোক্ত অভিনয় ছাড়া উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল বেশ কম। হোমায়রা হিমু, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, আরমান পারভেজ মুরাদ ও রাইসুল ইসলাম আসাদের মতো বাঘা অভিনেতারা থাকলেও ব্যপ্তি ছিল বেশ কম। এর সঙ্গীতায়োজনে ছিলেন ইমন সাহা এবং সিনেমাটোগ্রাফির দায়িত্বে ছিলে অপু রোজারিও।
মেঘমল্লার (২০১৪)
মুক্তিযুদ্ধ আর সাহিত্য যেন মানিকজোড়। ২০১৪ সালের ‘মেঘমল্লার’ও এর ব্যতিক্রম নয়। নন্দিত লেখক ও প্রাবন্ধিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ গল্পকে সেলুলয়েডের ফিতায় নিয়ে আসেন পরিচালক জাহিদুর রহমান অঞ্জন।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে রসায়নশাস্ত্রের শিক্ষক ন্রুরল হুদা। পরিবারে সদস্য মাত্র স্ত্রী আসমা, কন্যা সুধা আর আসমার ভাই মিন্টু। একাত্তরের উত্তাল মুহূর্তে সকল পিছুটান এড়িয়ে মিন্টু যোগ দেয় মুক্তিসেনানির দলে। প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও একদিন নুরুলের ভাগ্য রাতারাতি বদলে যায় শুধুমাত্র মিন্টুর রেইনকোটের বদৌলতে।
ছবিটি নিয়ে তেমন শোরগোল না পড়লেও এতে অনবদ্য অভিনয় করেন শহিদুজ্জামান সেলিম, অপর্ণা ঘোষ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে। কলকাতার অভিজিত বসুর সঙ্গীতে পরিমিতিবোধের পরিচয়ই পাওয়া গেছে এতে। ২০১৫ সালের টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয় ৯২ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবিটি।
হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭)
তুই আমাকে একদিনও মা বলে ডাকিসনি রইস। আমি জানি একটু পরে হলদি গাঁয়ের মাটি তোকে বুকে টেনে নেবে। তুই আর কোনো দিন মা বলে ডাকবি না। আমিও আর অপেক্ষায় থাকবো না। কৈশোরে, যৌবনে যে স্বপ্ন আমাকে তাড়িত করতো বার্ধক্যে যে স্বপ্ন আমি মুছে ফেলেছিলাম এখানেই তার শেষ। রইস তুই আমার কতো আদরের, কতো ভালোবাসার, কতো সাধনার ধন রে! তবু তোকে নিয়ে আমার বুকে কাঁটা ছিল। আজ আমি তোর রক্তে সে কাঁটা উপড়ে ফেললাম।‘ বুড়ির শত আকাঙ্ক্ষার ধন রইসের মৃত্যুর করুণ দৃশ্যে কাঁদেন নি এমন লোক পাওয়া বিরল।
প্রয়াত চিত্রপরিচালক চাষি নজ্রুল ইসলাম বাংলা চলচ্চিত্রের অগ্নিকালের এক কিংবদন্তী। তাঁর সৃষ্টিশীল হাতের স্পর্শেই এসেছে ‘ওরা এগারো জন’, ‘মেঘের পরে মেঘ’ প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। ১৯৯৭ সালের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ও তাঁর আরেক আলোচিত ও সফল কর্ম। এর গল্পটি এসেছে সেলিনা হোসেনের একই নামে লেখা উপন্যাস থেকে।
কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের খ্যাতনামা উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। ঘটনাটি ঘটেছিল যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামে। ঘটনাটি যিনি জেনে এসেছিলেন এবং সেই যোদ্ধা নারীকেও দেখে এসেছিলেন, তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক। রাজশাহী মহিলা কলেজে অধ্যাপনার সময় আমি তার ছাত্রী ছিলাম। তার নাম অধ্যাপক আবদুল হাফিজ। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন রণক্ষেত্রে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। বিজয় দিবসের দিন সকাল ১০টা নাগাদ তিনি ঢাকায় আমার সায়েন্স ল্যাবরেটরির কলোনির বাসায় এসেছিলেন। বেশিক্ষণ বসেননি তিনি। তিনি শুধু বলেছিলেন, একটি ঘটনার কথা বলতে এসেছি তোমাকে। এটা নিয়ে গল্প লিখবে। ১৯৭২ সালে গল্পাকারে ঘটনাটি লিখি। সমকালীন টেরেডাকটিল নামে তরুণদের একটি পত্রিকায় গল্পটি ছাপা হয়েছিল। পরে ১৯৭৪ সালে গল্পটিকে উপন্যাস আকারে লিখি।‘
ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুচরিতা, অরুণা বিশ্বাস, সোহেল রানা, দোদুল, শওকত আকবর, অন্তরা, রাজীব, নাসির খান, মিজু আহমেদ প্রমুখ। ২২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে শ্রেষ্ঠ পরিচালক, অভিনেত্রী ও কাহিনীকারের পুরষ্কার ঝুলিতে ভরে নেয় ছবিটি। গ্রামীণ পরিবেশের প্রাঞ্জল চিত্র তুলে ধরেছেন চিত্রগ্রাহক জেড এইচ পিন্টু। এর সুরারোপের দায়িত্বে ছিলেন বরেণ্য সুরকার শেখ সাদি খান।
যুদ্ধস্নাত বাংলাদেশের কাছে অত্যাচার, অনাচারের গল্প নতুন নয়। দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানিদের অন্যায় ও বৈষম্য, ভাষা রোধের অপচেষ্টা সবকিছুই শক্ত হাতে প্রতিরোধ গড়েছিল বীর বাঙালি। আন্দোলন–প্রতিবাদ যেন বাঙালির রক্তে চিরকালই বহমান। সেই শক্তিতেই নহিরের মতো বারবার প্রতি বঙ্গ সন্তান জেগে ওঠেন নব্য প্রত্যয়ে আর তাদের মুখে প্রতিধ্বনিত হয় সেই সংলাপ–
‘সারা শহর পুড়িয়ে গেছে পাকিস্তানিরা। তবুও তো আমাদের শহর। আবার গড়ে নেবো।‘