মালায়লাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিঃ সরলতার প্রতি ভালোবাসা1 min read
Reading Time: 4 minutes‘আমাদের ২২ বছরের প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে কাঞ্চনমালা। এবার স্বপ্নের সংসার শুরু হবে আমাদের। এতটা বছর যখন অপেক্ষা করেছো, আর দুটো মুহূর্তও পারবে।
আজ তুমি মন খুলে হাসতে পারবে, জগতকে জানাতে পারবে আমাদের অমর প্রেমের কথা।
ইতি তোমার মইদিন’
শেষাবধি কাঞ্চন আর মইদিনের জোড়া হাত আর এক হয়নি। ২২ বছর ঘরে বন্দি থেকেও শুধু পত্রালাপে কাঞ্চন–মইদিনের অবিস্মরণীয় প্রেমের গল্প কেরালার প্রতিটি ঘরই জানে। পরিণতি না পেলেও ‘এন্নু নিনতে মইদিন’ নামে সেলুলয়েডের ফিতেয় তা উঠে এসেছে ঠিকই। এমন সরল–সহজ, নির্মলতার গল্পের ফিল্মের ওপর নামই এখন মালায়ালি সিনেমা।
বলিউডের পরেই তামিল– তেলেগু সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে চেনে লোকে। তবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তামিল সিনেমা এগিয়ে গেছে অনেক দূর। ‘রোবট’, ‘আই’, ‘মারি’ ইত্যাদি বিগ বাজেটের ছবির পাশাপাশি বলিউডকে হামেশাই রিমেকের সুযোগ দিচ্ছে তামিল ছবিগুলো। পিছিয়ে নেই তেলেগুও। ভারতীয় ছবির ইতিহাসই এলোমেলো করে দিয়েছিল ‘বাহুবলি’ ও ‘বাহুবলি ২’। ধুন্ধুমার একশন, জমাট কাহিনীই এই দুই ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় মূলধন।
তবে এদের থেকে বেশ আলাদাই বলতে হবে মালায়লাম ছবিগুলোকে। একেবারে সাদামাটা গল্পের সাথে একপশলা জীবন মিশিয়েই যেন তৈরি হয় ছবিগুলো। অপূর্ব সিনেমাটোগ্রাফি, লং শটের বিচিত্র ব্যবহার, মোহনীয় সুর আর স্বভাবজাত অভিনয়ের গুণেই স্বতন্ত্র এক জায়গা করে নিয়েছে এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি।
মালায়লাম ছবি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। তাই এই লেখায় তুলে আনা হলো অল্প ক’টি মালায়লাম ছবির কথা।
প্রেমাম (২০১৫)
একজন মানুষের জীবনে প্রেম কতবার আসে? একবার, দুইবার, তিনবার? প্রতিটি প্রেমই কী এক অনুভূতির জন্ম দেয় নাকি সময়ের সাথে ভিন্ন রূপে আসে? জর্জ ডেভিড নামী সাদাসিধে এক ছেলের জীবনে বসন্তের আগমন নিয়েই এগিয়েছে ‘প্রেমাম’।
মাত্র ৪ কোটি রুপির ছবিটি বিশ্বব্যাপী আয় করে ৬০ কোটিরও বেশি। কৈশোরে হার্টথ্রব মেরি, তারুণ্যে স্নিগ্ধ মালার আর যুবাকালে সেলিনের প্রেমে পড়ে জর্জ। কিন্তু কোন প্রেমই সরলরেখায় চলেনি। কৈশোরে মন ভাঙার পর কলেজ শিক্ষিকার সাথে চুটিয়ে প্রেম করলেও টেকেনি সেটা। সেই বেদনা নিয়েই জর্জ কাটিয়ে দেয় ১৫ টি বছর। শেষমেশ কার তীরে নোঙ্গর ফেলবে জর্জ? সে কি ভুলতে পারে মালারকে?
অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি, লোভনীয় লোকেশন, রাজেশ মুরুগেসানের প্রশান্ত সুর সৃষ্টির গুণে বক্স অফিসে সাফল্য পায় ছবিটি। এর সাথে সাথে পরিচালক আলফানসো পুথারেনও দেখিয়ে দেন, স্রেফ নিজ ভাষায় মানুষের গল্প বলাটাই ফিল্ম। ছবিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন নিভিন পৌলি, সাই পল্লবী, অনুপমা পরমেশ্বরন, ম্যাডনা সেবাস্তিয়ান সহ অনেকেই। প্রেমামের গুণেই পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন সাম্প্রতিক সেনসেশন সাই পল্লবী।
চার্লি (২০১৫)
বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক। এর মধ্যেই আপনি পালিয়ে চলে এলেন আরেক শহরে। খুঁজে পেতে একটা থাকার জায়গাও মিলে গেল আপনার। কিন্তু এ কী! গোটা ঘরজুড়ে এত রঙিন বোতল কিসের? বর্ণিল দেয়ালের আঁকিয়ে কে? পুতুলের মিছিল কেন আনাচে কানাচে? আর ওই যে বারান্দায় দাঁড়ালে সুফি গানের সুর ভেসে আসে– সেটাই বা কিসের আলামত?
এই একরাশ প্রশ্ন সামনে এসেছিল টেসার। তবে এক অদ্ভুত ফোনকলেই কেটে যায় সব রহস্য। এ ঘরের আসল মালিকের নাম চার্লি। তবে লোকটা যে সে কেউ না। গোটা শহরজুড়ে তাকে ঘিরে রয়েছে নানান রহস্যময় গল্প। কারো কাছে সে দানবীর, কারো কাছে চোরের দোস্ত, কেউ বলে ওর মতো মাটির মানুষ আর হয়না, আবার কেউ ওর নাম শুনলেই নমস্তে বলে পালায়! জাদুকরী চরিত্রের মানুষটা আসলে কে? তার খোঁজেই নেমে পড়ে টেসা।
ছবিতে চার্লি চরিত্রে অভিনয় করেছেন মালায়লাম হার্টথ্রব দুলকার সালমান, সাথে ছিলেন লাস্যময়ী পার্বতী। এছাড়াও অপর্ণা গোপিনাথ, সৌবিন সাহির অভিনয় করেছেন। মার্টিন প্রক্কটের পরিচালনায় ও জমন টি জনের নান্দনিক সিনেমাটোগ্রাফির সুবাদে এই ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম আলোচিত ছবি এটি।
বেঙ্গালোর ডেইজ (২০১৪)
মালায়লামি ছবির দর্শকদের ক্ষেত্রে একেবারে হাতেখড়ির ছবি এটা। তবে আদর্শলিপি ভেবে এড়িয়ে গেলে বোকামিই হবে।
তিন স্বপ্নাতুর তরুণের গল্প, ঘাত প্রতিঘাত, জীবন ও ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ার অসামান্য গল্পই ‘বেঙ্গালোর ডেইজ’। কেরালা থেকে নিজ নিজ স্বপ্ন পূরণে পাড়ি জমায় দিব্যা–কুট্টান– অর্জুন। একসময় তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় শিবদাস, মীনাক্ষী আর সারাহ। খুব সরল– সুবোধ জীবন আর ভালোবাসার খোঁজে আসা তিন তরুণ একসময় টের পায়, জীবনটা এত সহজ নয়, ভালোবাসা– আত্মসম্মান টিকিয়ে রাখাও এক সংগ্রাম।
অঞ্জলি মেনন পরিচালিত ছবিটি অসম্ভব জনপ্রিয়তার অর্জনের পাশাপাশি কেরালা স্টেট ফিল্ম এ্যাওয়ার্ডে সেরা চিত্রনাট্য, সেরা অভিনেতা, অভিনেত্রীর পুরস্কার পায়। অন্যদিকে সেরা পরিচালক ও পার্শ্ব অভিনেত্রীর ফিল্মফেয়ার পুরস্কারও আসে এর ঝুলিতে। ছবিতে অভিনয় করেছেন নিভিন পৌলি, নাজরিয়া নাজিম, দুলকার সালমান, পার্বতী, ফাহাদ ফাসিল, নিত্য মেনন, ইশা তালওয়ার প্রমুখ।
ওম শান্তি ওশানা (২০১৪)
‘সবুরে মেওয়া ফলে’- প্রবাদের সাথে সবচেয়ে ভালো যায় নিভিন পৌলি ও নাজরিয়া নাজিম অভিনীত এই ছবিটি। রম–কম ধাঁচের ছবিতে পুজা ম্যাথু চরিত্রে নাজরিয়ার মিষ্টি উপস্থাপন আর গিরি হিসেবে নিভিনের রসায়নই ছিল মূলধন।
জটিল সময়ে মিষ্টি প্রতীক্ষা আর মান–অভিমানের দারুণ সমন্বয় ঘটেছে এই ছবিতে। সম্প্রতি টলি পাড়াতেও এর রিমেক ‘কে তুমি নন্দিনী’ তৈরি হয়েছে।
কুম্বালাঙ্গি নাইটস (২০১৯)
এ বছরের প্রথম ভাগে মুক্তি পেয়েই বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছে ছবিটি। কিছুটা পারিবারিক, কিছুটা ব্রোমান্সের কড়চা মেশানো সিনেমাটিও হেঁটেছে মালায়ালি দর্শনে। ভাইদের মধ্যকার খুনসুটি আবার মিল বন্ধনের গল্পই শৈল্পিক ভাবে তুলে এনেছেন পরিচালক মধু নারায়ণ তার প্রথম ছবিতে।
ফাহাদ ফাসিল, শানে নিগম, সৌবিন সাহির, এনা বেন ও শ্রীনাথ ভাসি অভিনীত এই ছবিটি আয় করেছে ৪০ কোটি রূপি, যা এর বাজেটের প্রায় ৭ গুণ!
এগুলোর বাইরেও মালায়ালি ছবির সংখ্যা প্রচুর। ‘দৃশ্যম’, ‘সলো’, ‘একশন হিরো বিজু’, ‘টেক অফ’, ‘100 Days of Love’, ‘ওকে কানমানি’,’ কালি’, ‘মেমোরিজ’, ‘জেমস এন্ড এলিস’, ‘উস্তাদ হোটেল’ ,’ বিক্রমাদিত্য’ প্রভৃতির গুণগ্রাহীর সংখ্যাও অনেক।
অতি আধুনিক সময়ে যখন অন্যসব ইন্ডাস্ট্রি নজর রাখছে উন্নত ভিএফএক্স, একশনের দিকে; সেখানে মালায়লাম ছবিগুলোর মূল আবেদন মানবিকতা ও উদার সৌন্দর্যে। তাই নান্দনিকতার দিক দিয়ে ভারতীয় অন্য ইন্ডাস্ট্রিগুলোর চাইতে এগিয়ে এই মালায়ালিরাই। তাই সমালোচক বোদ্ধাদের মতে , ‘মালায়ালি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হলো সে জায়গা যেখানে কনটেন্ট ইজ দ্য কিং।‘