পপ জগতের মহাতারকা মাইকেল জ্যাকসন 1 min read
Reading Time: 4 minutesযদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার ইংরেজি গান শোনার শুরু কোন গান থেকে? এই প্রশ্নের উত্তরে ৮০ ও ৯০ দশকে জন্ম নেয়া অধিকাংশ বাংলাদেশির উত্তর আসবে মাইকেল জ্যাকসনের বিট ইট। মাইকেল জ্যাকসনকে চেনেন না, এমন মানুষ পাওয়া বোধ করি বিরল। একজন সঙ্গীতশিল্পী কেবল গান গাইবেন না, বরং সবাইকে বিনোদিত করবেন, স্টেইজে লাখো দর্শককে অনবদ্য পারফরম্যান্সের মাধ্যমে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবেন, এমন ধারণা সম্ভবত মাইকেল জ্যাকসনই প্রবর্তন করেছিলেন। কি ছিল না তার গানে! ‘ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট’ দিয়ে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড’ কিংবা ‘আর্থ সং’ দিয়ে আনতে চেয়েছেন পরিবেশ সচেতনতা আবার ‘দে ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট আস’ গানের মাধ্যমে করতে চেয়েছেন প্রতিবাদ। পপ সঙ্গীতকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন বলেই আজো লাখো কোটি মানুষ পপ বলতেই সবার আগে কল্পনা করেন ফর্সা মুখের এক ব্যক্তিকে যিনি গান গাইছেন আর স্টেইজ মাতাচ্ছেন মোহনীয় নাচের ভঙ্গিমায়।
পরিচয়
তার পুরো নাম মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন। বিশ্ববাসী চেনে মাইকেল জ্যাকসন বা কিং অফ পপ নামে। উন্মাদনা, বিস্ময়কর গায়কী আর নাচ—এই সব কিছু এক করলে যা দাঁড়ায়, শ্রোতাদের কাছে তাই মাইকেল জ্যাকসন। ব্যক্তি জীবন থেকে সঙ্গীতের বর্ণিল অধ্যায়, সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন মানুষের আগ্রহের চূড়ান্তে। সহজাত প্রতিভা আর উদ্ভট খেয়াল দুটোই ছিল তার।
পপ, আরএন্ডবি, রক, সোল, ফাঙ্ক অথবা ডিস্কো—নানা জনরায় কাজ করেছেন মাইকেল। লিখেছেন অসাধারণ কিছু গানও। জ্যাকসন পরিবারের অষ্টম সন্তান ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে মাত্র ৫ বছর বয়সে পেশাদার সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ‘জ্যাকসন ফাইভ’ নামের একটি ব্যান্ডে ভাইদের সঙ্গে গাইতেন মাইকেল। ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করেন একা পথচলা। এই সময় প্রকাশিত হয় তার প্রথম স্টুডিও অ্যালবাম ‘গট টু বি দেয়ার’। এরপর থেমে থেমে চলা।
সেই সময় তিনি মোটাউন রেকর্ডসে কাজ করতেন। ১৯৮০ এর দশকের মধ্যেই তিনি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সঙ্গীত শিল্পী যিনি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তিনি যে শুধু গায়ক হিসাবেই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তা একেবারেই নয় বরং গানের পাশাপাশি তাঁর নাচও ছিল সমান জনপ্রিয়। তাঁর বিখ্যাত নাচের মধ্যে ছিল মুনওয়াক এবং রোবট। পরবর্তীকালে বহু জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পীরাও তাঁর নাচের প্রশংসা করে ছিলেন।
সঙ্গীতজীবন
তাঁর অসংখ্য অ্যালবামের মধ্যে সর্বোচ্চ বিক্রিত অ্যালবাম হল ‘থ্রিলার’। এছাড়াও তাঁর বহুল প্রচলিত অ্যালবামের মধ্যে যে অ্যালবামের নামগুলি উঠে আসে সেগুলি হল- হিস্টরি, অফ দ্য ওয়াল, ডেঞ্জারাস এবং ব্যাড। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে মাইকেল জ্যাকসন সর্বকালের সফল শিল্পীদের একজন। তাঁর সর্বপ্রথম রিমিক্স অ্যালবাম ‘ব্লাড অন দ্যা ডান্স ফ্লোর: হিস্টরি ইন দ্যা মিক্স’। ২০০১ সালে তিনি রিলিজ করেন তাঁর জীবনের দশম তথা সর্বশেষ স্টুডিও অ্যালবাম ‘ইনভিন্সিবল’।
আশির দশকে জনপ্রিয় অ্যালবাম ‘বিলি জিন’ ও তার পরে ‘থ্রিলার’ মাইকেলকে গোটা বিশ্বে অনন্য রূপে তুলে ধরে। তখনকার দিনের প্রায় ৫ কোটি ডলার খরচ করে মাত্র ১৪ মিনিটের ‘থ্রিলার’ ভিডিও বানিয়েছিলেন মাইকেল।
সঙ্গীত বিষয়ক পত্রিকা ‘রোলিং স্টোনস’ এর মতে, ১৯৬৪ সালে কিংবদন্তী বৃটিশ ব্যান্ড বিটলসে’র একটি কনসার্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত টেলিভিশনে সঙ্গীত প্রচারের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ‘থ্রিলার।’ ‘থ্রিলার’এর বিস্ময়কর সাফল্যের পর মাইকেল জ্যাকসনকে ‘সঙ্গীতের বাজারের একক উদ্ধারকর্তা’ খেতাব দেয় ‘টাইম’ ম্যাগাজিন।
পরবর্তীতে ‘স্মুথ ক্রিমিনাল’, ‘ব্ল্যাক অর হোয়াইট’, ‘বিট ইট’এর মত দূর্দান্ত ব্যবসাসফল ভিডিও প্রকাশ করেন জ্যাকসন।
বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত অ্যালবামের মধ্যে মাইকেলের ৫টি অ্যালবাম রয়েছে। অ্যালবামগুলো হল, অফ দ্য ওয়াল (১৯৭৯), থ্রিলার (১৯৮২), ব্যাড (১৯৮৭), ডেঞ্জারাস (১৯৯১) এবং হিস্টোরি (১৯৯৫)। দুইবার ‘রক অ্যান্ড রোল হল অফ ফেইম’ নির্বাচিত হন মাইকেল। ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে সর্বকালের সবচেয়ে সফল শিল্পী বলা হয় তাকে। পেয়েছেন ১৩টি গ্র্যামি পুরস্কার। সঙ্গে ৭৫ কোটি অ্যালবাম বিক্রয়ের রেকর্ড তো রয়েছেই।
১৯৮২ সালে প্রকাশিত হওয়া মাইকেল জ্যাকসনের ষষ্ঠ একক অ্যালবাম ‘থ্রিলার’ বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। সেসময় থেকেই তাঁকে ‘কিং অব পপ’ বলা শুরু হয়। দীর্ঘসময় যাবত ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যবসাসফল গানের অ্যালবামের স্থানটি দখল করেছিল ‘থ্রিলার।’
উল্লেখযোগ্য কিছু গান
বিলি জিন’ – ১৯৮৩ সালে ইন্সট্রুমেন্টাল ভার্সান কালেকসান অ্যালবামে মুক্তি পায় এই গানটি। মাইকেল এই গোটা গানটি রেকর্ড করেছিলেন একটি ৬ ফিটের কার্টবোর্ড টিউবের মধ্যে বসে।
‘বিট ইট’ – ১৯৮২ সালে থ্রিলার অ্যালবাম থেকে জনপ্রিয় হয় এই গানটি। ১৯৮৩ সালে ‘বেস্ট রক ভোকাল পারফরম্যান্স’ হিসাবে এই গানটি গ্র্যামি পুরস্কার পায়।
হিল দ্য ওয়ার্ল্ড’ – অ্যালবামের নাম ডেন্জারাস। ১৯৯১ সালে মুক্তি পাওয়া এই গানটি বানিয়ে মাইকেল ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। তাই ১৯৯২ সালে তিনি এই গানের নামেই বানিয়ে ফেলেন ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশান’।
‘ইউ আর নট অ্যালোন’ – ১৯৯৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই গানটি মার্কিন ইতিহাসের প্রথম বিলবোর্ডের ১০০ টা গানের মধ্যে ১ নম্বরে ছিল।
বর্ণবাদ আন্দোলনের পোস্টারবয়
মাইকেল জ্যাকসন তার গানকে শুধুমাত্র বিনোদনের মধ্যে আটকে রাখেন নি। তিনি গানের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও দিয়েছেন।
কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের অনেকেই মনে করেন, সেসময়কার সঙ্গীতজগতে বিদ্যমান বর্ণবৈষম্য দূর করার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা মাইকেল জ্যাকসনের। তার ‘ব্ল্যাক অর হোয়াইট’ গানের লিরিক্স একবার খেয়াল করা যাক,
See, it’s not about races
Just places, faces
Where your blood comes from
Is were your space is
I’ve seen the bright get duller
I’m not going to spend my life being a color
এটাই ছিল মাইকেল জ্যাকসনের চিন্তা। I’m not going to spend my life being a color বাক্যটা দিয়ে সঙ্গীত মঞ্চ থেকে যে ডাক তিনি দিয়েছিলেন, তা উপেক্ষা করার সাধ্য কার ছিল?
তাঁকে বলা হতো সর্বপ্রথম কৃষ্ণাঙ্গ তারকা, যিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। মানুষের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা সে সময়কার উদীয়মান আফ্রিকান-আমেরিকান সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে দারুণ অনুপ্রেরণা তৈরী করেছিল।
আশার, কেইন ওয়েস্ট, উইকন্ড’এর মত এখনকার অনেক জনপ্রিয় কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীই বলেছেন তাঁরা মাইকেল জ্যাকসন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।
পৃথিবীর তরে পপসম্রাট
Did you ever stop to notice
All the children dead from war
Did you ever stop to notice
This crying earth, these weeping shores
একজন সঙ্গীতশিল্পী কেবল গান গাওয়া কিংবা বিনোদন দেয়ার জন্য না। সঙ্গীত হতে পারে মানব সমাজের মুক্তির স্লোগান। হতে পারে প্রতিবাদের ভাষা। মাইকেল জ্যাকসনের আগে সেভাবে হয়ত কেউই সেটি করে দেখাতে পারেননি। আর্থ সং গানে তিনি সরাসরি প্রশ্ন রেখেছেন মানবতার প্রতি। দেখাতে চেয়েছেন একটি সুস্থ পৃথিবীর জন্য ভালবাসা।
অথবা হিল দ্য ওয়ার্ল্ড গানের কথাইই ভাবুন। যেখানে তার আহ্বান ছিল সাম্যবাদী এক পৃথিবীর প্রতি।
Heal the world
Make it a better place
For you and for me
And the entire human race
There are people dying
If you care enough for the living
Make it a better place
For you and for me
এই গানটি এতটাই সাড়া ফেলেছিল যে, ১৯৯২ সালে মাইকেল জ্যাকসন প্রতিষ্ঠা করেন হিল দ্য ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন থেকে শুরু হয় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কল্যাণমূলক কাজ।
বিতর্কিত প্লাস্টিক সার্জারি
তার মৃত্যু দিবস উপলক্ষ্যে ইউটিউব চ্যানেল ট্রিট’কে একটি ইন্টারভিউ দেন আরেক কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী রক গানের গুরু এলভিস প্রিসলি কন্যা লিসা মেরি। তিনি ছিলেন মাইকেল জ্যাকসনের প্রথম স্ত্রী। লিসা মেরি বলেন, ১৯৯৪ সালের আগস্টে আমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এর আগে প্রেম ছিল। সে আমার সঙ্গে প্রেমের আগে ‘কালো’ থেকে ফর্সা হওয়ার জন্য প্রথমবার শরীরের রং পাল্টায়। কিন্তু আমার তাকে স্বাভাবিক রংয়েই ভালো লাগত।
বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ক্লার্ক জয়েস জ্যাকসনের মৃত্যুর পেছনে বারবার রঙ পরিবর্তনের জন্য প্লাস্টিক সার্জারি করাকে দায়ী করেছেন। কারণ, এর ফলে জ্যাকসন চর্মরোগে ভুগতেন ।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জ্যাকসনের মৃত্যুর পর শোক ভাষণে বলেছিলেন, এটি আমার কাছে এখনো রহস্য আমাদের সময়ের হিরো মাইকেল জ্যাকসন কেন ‘কালো’ থেকে ‘সাদা’ হয়ে উঠতে চাইতেন!
আজ থেকে ১১ বছর আগে নিজের বর্ণিল প্রত্যবর্তন ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। দিনরাত ব্যস্ত ছিলেন শেষ একটা ওয়ার্ল্ড ট্যুরের জন্য। কিন্তু রাজসিক সে প্রত্যাবর্তন হয়নি। ডাক্তারের ষড়যন্ত্র কিংবা নিজের ভুলে অতিরিক্ত প্রপোফল ওষুধে ঘুমের মাঝেই মৃত্যু হয় মাইকেল জ্যাকসনের। তার মৃত্যুতে রীতিমতো ভেঙে পড়ে পুরো বিশ্ব। এত বেশি সার্চ করা হয় যে ক্র্যাশ করে বসে গুগল সার্চ ইঞ্জিন। প্রথমবারের মত ক্র্যাশ হয় উইকিপিডিয়া। এক পর্যায়ে গুগল বাধ্য হয় ৩০ মিনিটের জন্য নিজেদের সাইট বন্ধ রাখতে।
এমন রূপকথার জন্ম সেই ২০০৯ সালে কজনই বা দিতে পারতেন? একজনই হয়ত পারতেন। এবং দিনশেষে তিনি মাইকেল জ্যাকসনই।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ