Site icon Bangla Info Tube

বিশেষ মশা বহন করে নিয়ে যায় যেসব ড্রোন

ড্রোন দিয়ে মাত্র পাঁচ মিনিটে ২০ হেক্টর অঞ্চল জুড়ে মশা বিস্তৃত করা সম্ভব

Reading Time: 3 minutes

কোন এক অলস শুক্রবার দুপুরে খেয়ে দেয়ে ঘুমাচ্ছিলেন জাফর সাহেব। ঘুমাতে ঘুমাতে একসময় তিনি একটা স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন। কাঁদামাখা একটা বিশাল বড় ফাঁকা মাঠে তিনি একা দাঁড়িয়ে আছেন, পুরো মাঠে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। আকাশে প্রচণ্ড রোদ, উপরের দিকে তাকাতেই হাত দিয়ে ঢেকে ফেলতে হল চোখ। তিনি বুঝতে পারলেন না কেন তিনি এই খোলা মাঠে একা দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ একটা গুঞ্জন খুব ধীরে ধীরে জোরালো হওয়া শুরু করলো আর তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করলেন তীব্র রোদে ঠাসা পুরোটা আকাশ জুড়ে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোন বস্তুর মেঘ গুঞ্জন তুলে তার মাথার উপর ছায়ার আকৃতি তৈরি করার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পরেই সেই মেঘটা এতো কাছে চলে এলো যে তিনি বুঝতে পারলেন যে মেঘটা আর কিছুর নয়, কোটি কোটি মশার! তারা প্রবল বেগে নেমে আসছে তারই উপর। আর দেরি করলেন না জাফর সাহেব, সেই কাদামাঠেই দৌড়ানো শুরু করলেন, আবার এদিকে আবার ওদিক। একসময় একদম কাছে চলে এসেছে মশার দল আর হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে যায় জাফর সাহেবের। ঝটকা মেরে উঠে বসে খেয়াল করলেন সারা গা ঘামে ভিজে গিয়েছে, আর একটা মশা তার ডান কানের দিকে ভনভন করে উড়ছে। হয়তো ডেঙ্গু মশা, ভাবতে ভাবতেই দুহাতে চটাশ করে মেরে ফেললেন মশাটি। 

এখানে জাফর সাহেব মশার মেঘ স্বপ্নে দেখলেও বাস্তবে ব্রাজিলে একবার ড্রোন দিয়ে পঞ্চাশ হাজার মশা ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের বিস্তৃতি রোধ করতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এর সহযোগিতায় উইরোবোটিকস সেখানে ড্রোনের সাহায্যে এই বিশেষ মশা ছাড়ে। তারা বেশ সফলভাবেই গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছিল। এ সম্পর্কে উইরোবোটিকসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম ক্লপটোকজ বলেন, “প্রাথমিক পরীক্ষার ফলাফলে আমরা খুশি। শীতলীকরণ, বহন ও নির্গমনসহ গোটা প্রক্রিয়ায় মাত্র শতকরা দশ ভাগ মশার মৃত্যু হয়েছে।”

তাদের মতে ড্রোন ব্যবহারের ফলে মশা ছড়ানোর কাজটি কেবলমাত্র সহজই হয়নি, গোটা প্রক্রিয়াটি হয়ে উঠেছে আরো দ্রুততর। ড্রোন দিয়ে মাত্র পাঁচ মিনিটে ২০ হেক্টর অঞ্চল জুড়ে মশা বিস্তৃত করা সম্ভব হয়। ড্রোনগুলো প্রতি ফ্লাইটে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মশা বহন করতে সক্ষম। যদিও গবেষকরা এখন প্রতি ফ্লাইটে বহন করা মশার সংখ্যা বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া ড্রোন ব্যবহারের ফলে খরচও কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। প্রতিটি ড্রোনের পেছনে খরচ হয় মাত্র দশ হাজার ইউরো। এটি অন্যান্য পদ্ধতির খরচের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।

কেন ড্রোনে মশা বহন করা হয়? 

দ্য ইউনাইটেড স্টেট এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (USAID) দীর্ঘদিন ধরে মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপায় সন্ধান করে যাচ্ছিল। সম্প্রতি তারা এক অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এ পদ্ধতিতে প্রথমে আবদ্ধ জায়গায় বিপুল সংখ্যক পুরুষ মশা জন্ম দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এসব মশাকে গামা রশ্মির বিকিরণের মাধ্যমে পুরুষত্বহীন করে ফেলা হয়। সবশেষে পুরুষত্বহীন মশাগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয় প্রকৃতিতে, অন্যান্য মশার মাঝে। বাহ্যিক পরিবেশে তারা প্রজননের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যায়। ফার্মে উৎপাদিত এসব মশা প্রাকৃতিক মশার তুলনায় নারী মশার নজর কাড়তে পারদর্শী হয় ঠিকই, কিন্তু স্ত্রী-মশার সাথে মিলনের পরে সে মশাটিও বন্ধ্যা হয়ে যায়। ফলে নতুন করে জন্মানো মশার সংখ্যা কমে আসে।

এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই পদ্ধতিতে কোনো স্থানে প্রায় নব্বই শতাংশ মশার কমিয়ে আনা সম্ভব। যদিও কিছু গবেষকদের দাবী মশাকে পুরুষত্বহীন করে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এ ধারণাটি আরো অর্ধশতক আগে থেকেই রয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এসব মশা প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।  বিশেষ করে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই কাজটি আরো কঠিন। অধিকাংশ দেশে রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা বা গাড়ি চলার মতো রাস্তার অস্তিত্বই নেই, ফলে বাস বা ট্রাকে করে এসব মশা ছড়ানো সম্ভব হয় না। বাকি থাকে আকাশযান, যা ব্যবহার করতে গেলে মশা মারতে কামান দাগানোর মতোই হয়ে যায় বিষয়টি। কারণ এতে প্রচুর পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হয়। 

এই চিন্তায় যখন বিজ্ঞানীদের মাথায় হাত, ঠিক তখনই সমাধান নিয়ে এলো উইরোবোটিকস নামের এ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ড্রোন-প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সামাজের উপকারের লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে তারা প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের রোবোটিকস গবেষণাগার। এতে কোন সন্দেহ নেই যে ড্রোনভিত্তিক মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উদ্ভাবনের জন্যে তারাই যে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান। 

ড্রোনে মশা বহনের পদ্ধতি

মূলত এখানে ড্রোন তৈরির থেকেও বড় সমস্যা হলো মশাগুলোকে কীভাবে বহন করা হবে ও কীভাবে ছাড়া হবে প্রকৃতিতে সেটা কারণ মশা খুবই দুর্বল প্রকৃতির প্রাণী। লক্ষ্যাধিক মশা যদি একটি ছোট বাক্সে ঠাসাঠাসি করে বহন হয়, তবে তারা আহত হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তাই তাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে সুস্থ-সবল রেখে যতটা বেশি সম্ভব মশা বহন করা যায়। তারা সিদ্ধান্ত নেন একটি শীতল কন্টেইনার ব্যবহার করার যার তাপমাত্রা হবে ৪-৮ ডিগ্রী যার মধ্যে মশাগুলো ঘুমিয়ে পড়বে। এর ফলে যথেষ্ট ঘনভাবে তাদের বহন করা যাবে। ড্রোন থেকে মশাগুলোকে ছাড়ার বিষয়টিতেও যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা সব মশা একসাথে ফেলে দিলেও সেগুলো আহত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। তাই তারা বেশ কয়েকটি পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ফলস্বরূপ তারা একটি ছোট ছিদ্রসম্পন্ন ঘূর্ণায়মান বাক্স ব্যবহার করেন, যাতে একটি একটি করে মশা বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। এখান থেকে বেরোনোর পর তারা কয়েক সেকেন্ডের জন্য অন্য আরেকটি চেম্বারে অবস্থান করে, যেখানে তাদের শরীরের তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রার সাথে এক করা হয়। এ পদ্ধতিতে মূলত এটা নিশ্চিত করা হয়ে যে তারা জেগে উঠেছে এবং বাইরের পরিবেশে উড়ে বেরানোর জন্য প্রস্তুত। 

আমাদের দেশেও আমরা প্রতিনিয়িত নানা মশাবাহিত রোগের শিকার হচ্ছি প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে এই মুহুর্তে ডেঙ্গুর প্রকোপে আতঙ্কিত পুরো দেশ। আধুনিক প্রযুক্তির আশীর্বাদে যদি এভাবে মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়, তবে সেটি সত্যিই অসাধারণ বিষয় হবে এবং আমরা আমাদের দেশের জন্যও এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবো। 

লেখক- সালেহীন সাকিব 

Exit mobile version