ইন্টারনেটের দুনিয়ায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় একটি পরিভাষা হচ্ছে ভিপিএন(VPN)। অনেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ভিপিএন শব্দটি শুনলেও এটি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না, আবার জানলেও ভুল ব্যাখ্যা জানেন। ভিপিএন সম্পর্কে যদি আপনি সঠিক তথ্য জানেন, তবে বহুবিধ উপকার ও সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন। কিন্ত সঠিক তথ্য না জানার কারণে, আপনি ভিপিএন ব্যবহার করে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। তাই ইন্টারনেটে সতর্ক বিচরণের জন্য আপনাকে ভিপিএন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে।
তবে চলুন ভিপিএন সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জেনে নেয়া যাক-
ভিপিএন কী?
ভিপিএন এর পূর্ণরূপ হলো ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (Virtual Private Network)। যখন একটি পাবলিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একাধিক কম্পিউটারকে কিংবা আলাদা নেটওয়ার্ককে একই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়, তখন তাদের ভিপিএন বলে। এটি ইন্টারনেটে আপনার ও অন্য একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে নিরাপদ সংযোগ তৈরি করে দেয়।
ভিপিএন হচ্ছে এমন একটি নেটওয়ার্ক যা আপনাকে প্রাইভেট রাখতে সাহায্য করবে। এটি আপনার পাঠানো সকল ডাটা মুহূর্তের মাঝে এনক্রিপ্ট করে ফেলে, পাবলিক ডোমেইন থেকে সব কিছু আড়াল করে রাখে, তাই আপনি এই ভিপিএন- এর মাধ্যমে ইন্টারনেট দুনিয়ায় নিজেকে সুরক্ষিত অবস্থায় রাখতে পারেন।
আবার মনে করুন, আপনি এমন কোনো সাইটে ঢুকতে চাচ্ছেন, যাতে আপনার এলাকা ভিত্তিক প্রবেশাধিকার নেই অর্থাৎ আপনি যে এলাকায় আছেন, এই এলাকা থেকে ঐ সাইটে প্রবেশ করা সম্ভব নয়, তখন এই ভিপিএন- এর মাধ্যমে আপনার প্রকৃত লোকেশন গোপন করে, ভার্চুয়াল লোকেশন ব্যবহার করে এই সাইটে সহজেই ঢুকতে পারবেন। প্রকৃতপক্ষে ভার্চুয়াল লোকেশন নিজের পছন্দমত বাছাইকরার অস্ত্রই হচ্ছে এই ভিপিএন। ভিপিএন- এর মাধ্যমে সহজেই আপনি আপনার লোকেশনকে নিজের মতো করে নির্বাচন করতে পারবেন।
ভিপিএন কীভাবে কাজ করে?
প্রতিটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরই রয়েছে নিজস্ব আইপি অ্যাড্রেস। ভিপিএন ডাটা এনক্রিপ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে ডিভাইসের আইপি এড্রেসকে পরিবর্তন করে দেয়। এতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সহজেই নিজের পরিচয় গোপন রেখে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। ধরুন, আপনি কোনো সাইটে আপনার পরিচয় গোপন রেখে কিংবা সুরক্ষিত অবস্থায় রেখে প্রবেশ করতে চান, তখন এই ভিপিএন আপনার পরিচয়কে বদল করতে সাহায্য করবে। আপনার আইপি অ্যাড্রেস যদি পরিবর্তন হয়, তবে আপনার অবস্থানেরও পরিবর্তন হবে। আর এভাবেই ভিপিএন তার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
যেসব কাজে ভিপিএন ব্যবহার হয়
ইতিমধ্যে আপনার ভিপিএন সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়েছে বলে প্রত্যাশা করা যায়। ভিপিএন ব্যবহারের ক্ষেত্র সম্পর্কেও আপনি নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারছেন। চলুন এবার বিস্তারিত জেনে নিই, ভিপিএন যেসব কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আইপি অ্যাড্রেস ট্র্যাকিং প্রতিরোধ
কিছু কিছু ওয়েবসাইট আছে যেগুলো ব্যবহারকারীদের আইপি অ্যাড্রেস ট্র্যাকিং করে থাকে। এতে ব্যবহারকারী অনেক সময় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এমন সমস্যা প্রতিরোধ করতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে ভিপিএন। কারণ ভিপিএন আপনার আইপি এড্রেসকে পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম। আর আপনারা ইতিমধ্যেই জেনেছেন আইপি এড্রেস পরিবর্তন হয়ে গেলে কেউ আপনাকে ট্র্যাকিং করতে পারবেনা কিংবা ট্র্যাকিং করলেও আপনার সঠিক অবস্থান নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হবে।
পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার
কোনো প্রকার ভিপিএন ছাড়া পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। কারণ পাবলিক ওয়াইফাইর মাধ্যমে বিভিন্ন সাইটে প্রবেশকারীদের তথ্যের নিরাপত্তা থাকে না বললেই চলে। অনেকেই ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহার করতে গিয়ে বিভিন্ন ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্ত আপনি যদি ভিপিএন এর সাহায্যে পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার করেন, তবে এতে খুবই নিরাপদে যেমন ফ্রি ওয়াইফাই সেবা উপভোগ করতে পারবেন, তেমনি আবার আপনার নিরাপত্তা ঝুঁকিও একেবারে থাকবেনা বললেই চলে।
ব্লক সাইটে প্রবেশ
মনে করুন, বাংলাদেশ ফেসবুকে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলো। এমতাবস্থায় আপনি বাংলাদেশে বসে থেকে সরাসরি কখনোই ফেসবুকে প্রবেশ করতে পারবেন না। এইক্ষেত্রে আপনাকে ফেসবুকে ঢুকতে সাহায্য করবে ভিপিএন। এভাবে যে কোনো ব্লক সাইটে প্রবেশ করতে এই ভিপিএন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ব্যক্তিগত ফাইল নিরাপদে আদান-প্রদান
অনেক সময়ই আমাদেরকে বিভিন্ন কাজের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্যত্র আদান-প্রদান করতে হয়। এসব আদান- প্রদান করতে গিয়ে অনেক সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ফাইলের ক্ষতি সাধিত হয় কিংবা অনেক সময়ই খুবই গোপনীয়তার সঙ্গে ফাইল আদান-প্রদান করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ভিপিএন ব্যবহার করে যদি ফাইল আদান-প্রদান করা হয়, তবে ফাইলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে। তাই ব্যক্তিগত ও অফিস আদালত থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ফাইলপত্র নিরাপদে আদান-প্রদান করতে ভিপিএন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ভিপিএন ব্যবহারের সুবিধা
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা ভিপিএন ব্যবহারের নানাবিধ সুবিধা সম্পর্কে বিক্ষিপ্তভাবে ইতিমধ্যেই অবগত হয়েছি। এবার এক নজরে ভিপিএন ব্যবহারের সুবিধাগুলো জেনে নিন।
১. নিজস্ব আইপি অ্যাড্রেস পরিবর্তন করে সহজেই নিজের অবস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
২. বিভিন্ন ব্লক ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার সুযোগ লাভ।
৩. ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
৪. সহজেই হ্যাকিংয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
৫. নিজের পরিচয় গোপন করে সহজে ইটরেন্ট থেকে ফাইল ডাউনলোড করা সম্ভব হয়।
ভিপিএন ব্যবহারের অসুবিধা
আমরা এতক্ষন ভিপিএন এর নানাবিধ সুবিধা ও ইতিবাচক দিক সম্পর্কে জানলাম। হয়তো আপনার কাছে মনে হচ্ছে, ভিপিএন ব্যবহারের মধ্যে শুধুমাত্র ইতিবাচক দিকই রয়েছে। আপনি যদি এমনটি ভেবে থাকেন, তাহলে বলবো আপনি ভুল ভেবেছেন। কারণ ভিপিএন ব্যবহারের রয়েছে নেতিবাচক দিকও। তাহলে চলুন, এবার ভিপিএন ব্যবহারের অসুবিধাগুলো সম্পর্কে অবগত হয়ে নিই।
অধিকাংশ ভালো ভিপিএন ব্যবহার করতেই অর্থ ব্যয় করতে হয়। আবার কিছু কিছু ভিপিএন বিনা মূল্যেও ব্যবহার করা যায়, কিন্ত এতে ব্যবহারকারী বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়। বিনামূল্যে ব্যবহারকারী ভিপিএন সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ব্যবহারকারীদের তথ্য অনেক সময়ই সুরক্ষিত রাখার পরিবর্তে পাচার করে দেয়। এতে ব্যবহারকারী আরো বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়। আবার টরেন্ট থেকে ফাইল ডাউনলোড করতে গিয়েও আপনি ঝামেলায় পড়তে পারেন; কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভিপিএন ব্যবহার করে টরেন্ট থেকে ফাইল ডাউনলোড করা সম্ভব হয় না। আবার কেউ কেউ ভিপিএন ব্যবহার করে বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আর এতে অনেকেই ভুক্তভোগী হয়ে পড়ে।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভিপিএন সফটওয়্যার
আপনি যদি নির্ভরযোগ্য ভিপিএন সফটওয়্যার সম্পর্কে না জানেন। তবে ভিপিএন ব্যবহার করতে গিয়ে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারেন। তাই আপনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভিপিএন সফটওয়্যার সম্পর্কে জেনে রাখুন। NorNord VPN, ProXPN, Hotspot Shield, Cybershost, SecurityKiss, SpotFlux, ItsHidden, GPass, ইত্যাদি হলো বেশ জনপ্রিয় ভিপিএন সফটওয়্যার। এগুলোর অধিকাংশই ফ্রিতে ব্যবহার করতে পারবেন। এগুলো ছাড়াও আরো বেশ কিছু জনপ্রিয় ভিপিএন সফটওয়্যার রয়েছে।
ভিপিএন ব্যবহারের কিছু নেতিবাচক দিক থাকলেও ভিপিএন ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকার উপভোগ করতে পারবেন। তবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। সতর্কভাবে ভিপিএন ব্যবহার করলে আপনি নিজেকে সহজেই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা থেকে রক্ষা করতে পারবেন।