একটি আধুনিক শহর বলতেই আমাদের কল্পনায় চলে আসে মানুষে ঠাসা ব্যস্ত রাস্তার চিত্র। কিন্তু এই পৃথিবীর বুকে এমনও এক শহর আছে যার পুরো ভিত্তি পানির নিচে। সে শহরের নামটি হয়ত আমরা কমবেশি সবাই জানি। বলছি ইতালির ভেনিস শহরের কথা। প্রায় ১১৮ টি ক্ষুদ্র দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই শহর। আড্রিয়াটিক সাগরের পাশে উত্তর ইতালীর এই শহর প্রতি বছরই পর্যটকদের টেনে নিচ্ছে নতুন করে। এত বড় একটা শহর কেবল পানির উপর দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে হাজার বছর ধরে, এ যেন এক জ্বলজ্যান্ত বিষ্ময়।
ভেনিসের শুরু
চারপাশে সাগরে ঘেরা একটা হ্রদের মত জায়গায় কেইবা প্রথম বসবাস করার কথা চিন্তা করেছিল এমন প্রশ্ন কি আপনার মনে উঁকি দিচ্ছে?
উত্তরটা খুব একটা কঠিন নয়। ভেনিসে এখন মানুষের আগমন শৌখিনতার কারণে ঘটলেও শুরুতে তা ছিলো ভয় থেকে। খ্রিস্টীয় ৫ম শতকে ইতালিতে বারবারিয়ানদের আক্রমণ হবার পর ইতালির অনেক লোকই ঘর ছেড়ে পালিয়ে নিজেদের এখানে লুকিয়ে রাখেন। বিশাল হ্রদের মত এই অঞ্চলটি তারা নিজেদের নিরাপত্তা এবং নিরাপদ আশ্রয়ের স্থান হিসেবে খুজে নেন। স্থানীয় জেলেদের কাছে তারা হয়ে পড়েন শরণার্থী। ইতালিতে আক্রমণ যতই বাড়তে থাকে, ভেনিসেও বাড়তে থাকে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা। বিপুল পরিমাণ শরণার্থীদের জায়গা দিতে গিয়েই জন্ম নেয় নতুন এক শহর।
ভেনিসের নির্মাণ
ভেনিস নিয়ে কথা বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করা হয় এর নির্মাণ নিয়ে। পানির উপর শত শত প্রাচীন স্থাপনা টিকে থাকার গল্পটা অনেক বেশি রোমাঞ্চকর। ৪০২ সাল নাগাদ যখন প্রথম শরণার্থী দলটি এই অঞ্চলে আসা শুরু করে তারা বুঝতে পারে, এখানে বসবাস করতে চাইলে তাদের আরো বেশি জায়গা এবং খুবই শক্তপোক্ত কোন ভিত্তি দরকার। এই দ্বীপগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তোলা, হ্রদকে আরো গভীর করা এবং এলাকাটি বড় করে প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলার উপযোগী করে নেয়া, সবটাই তাদের মাথায় রাখতে হয়েছিলো। তাই শুরুতে তারা প্রায় কয়েশ খাল খনন এবং প্রতিটি খালের পাড়কে কাঠ বা গাছের গুড়ি দিয়ে পাইলিং এর কাজ শুরু করে দেয়। ঠিক একই রকম গাছ এবং পাইলিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় নতুন সেই শহরের বাসস্থান নির্মাণের ক্ষেত্রেও।
নব্য আগতরা প্রথমেই হাজার হাজার কাঠ শক্তভাবে কাদামাটিতে গেঁথে রাখেন। পাইলিং করা কাঠগুলো পাশাপাশি রাখা হয়েছিল যেন এদের মাঝে কোন ফাকা স্থান না থাকে। এরপর সেই গেঁথে রাখা কাঠের মাথা সমানভাবে কেটে নেয়া হয়। যেটি হয়ে যায় শহরের বেড়ে ওঠার শক্ত ভিত্তি। কিন্তু মজার ব্যাপার হল কাঠ পানির নিচে থাকলেও সেটি কোনভাবে পঁচতে শুরু করেনি। যদিও এটি বিশ্বাস করা কঠিন, তবে সত্য কথা হলো, ভেনিস শহর এখনো পর্যন্ত হাজার বছরের সেই পুরাতন কাঠের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে।
ভেনিস নিয়ে মজার কিছু তথ্য
১। প্রায় ৪০০ ব্রিজ এবং ১৭০ টি খালের ভেনিস শহরের গড় গভীরতা ১০ দশমিক ৫ মিটার। এর সর্বোচ্চ গভীরতা ২১ মিটার। আর পুরো শহরে দ্বীপের সংখ্যা ১১৮ টি।
২। পৃথিবীর সবচেয়ে সরু রাস্তা, ক্যালে ভ্যারিসকোর অবস্থান এই শহরেই। রাস্তার প্রস্থ মাত্র ৫৩ সেন্টিমিন্টার।
৩। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষ্য সৃষ্ট কারণ দুই মিলিয়ে প্রতিবছর ভেনিস শহর ১ থেকে ২ মিলিমিটার করে তলিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলো যেখানে বিংশ শতাব্দীতে এসে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারে হাত দিয়েছে, সেখানে ভেনিসে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু হয় সেই ১৯৭০ থেকে।
৪। অবাক করা ব্যাপার হলো, দক্ষিণ আমেরিকান দেশ ভেনিজুয়েলার নামকরণ করা হয় ইতালির এই ভেনিস বা “ভেনেজিয়া” শহরের নাম অনুসরণ করে। স্প্যানিশ ভাষায় ভেনিজুয়েলা মানেই দাঁড়ায় ‘ছোট ভেনিস”
৫। ইতালির অন্তর্ভুক্ত হবার আগে ভেনিস সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র ছিলো। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে ১৭৯৭ সাল পর্যন্ত এটি স্বাধীন একটি গণপ্রজাতান্ত্রিক দেশ ছিলো।
৬। পৃথিবীর প্রথম উন্মুক্ত ক্যাসিনো ছিলো এই ভেনিস শহরেই। এটি ১৬৩৮ সালে উন্মুক্ত করা হয়।
৭। বিখ্যাত ইতালিয়ান সম্বোধন “সিয়াও” এর উৎপত্তি এই ভেনিস শহরেই। ভেনিসের স্থানীয় ভাষায় “এস-সিয়াভো ভোস্ট্রো” মানে তোমার সেবক। এই “এস সিয়াভো” থেকে পরে তার উচ্চারণ বদলে যায়, সিয়াও।
বর্তমানে অনেকেই ভেনিসকে ভাসমান শহর না বলে ডুবন্ত শহর বলতেই বেশি আগ্রহী। ভেনিস আসলে এর জন্মলগ্ন থেকেই একটু একটু করে ডুবছে। শুরু থেকে শহরের বিভিন্ন স্থাপনার ভার পানির নিচের কাদামাটিতে প্রচন্ড চাপ প্রয়োগ করছিলো। এতে করে কাদামাটি থেকে পানি বেরিয়ে এসে মাটিকে আরো ঘন করে তুলছিলো। ফলাফল হিসেবে বাড়ছিলো পানির উচ্চতা। এছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনের কারণেও ভেনিসে পানির উচ্চতা বাড়ছে। বিগত ১০০ বছরে ভেনিস শহর প্রায় ৯ ইঞ্চি তলিয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে আড্রিয়াটিক সাগরপাড়ে পানির উচ্চতা দিনে দিনে আরও বাড়বে এবং ২১০০ সাল নাগাদ বিলীন হয়ে যাবে বিশ্বের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ভেনিস শহর।