আফগানিস্তান থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর আর দক্ষিণে বিশাল ভারত মহাসাগর, এই পুরো এলাকা জুড়ে ভারতীয় উপমহাদেশ। এ অঞ্চলটি ভূপ্রকৃতি বিশ্লেষণের শুরু থেকে যা রীতিমতো এক বিষ্ময়। বৈচিত্র্যের শেষ নেই এই অঞ্চলে। আছে সুন্দরবনের মত ম্যানগ্রোভ বন, আছে জয়পুরের মরুভূমি, আছে সিমলা বা কাশ্মীরের বরফ পড়া সৌন্দর্য!
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বলুন কিংবা গজনীর সুলতান মাহমুদ, মুহাম্মদ ঘুরী বা মুঘলদের কথা বলুন, স্পেনের নাবিক কলম্বাস, ভাস্কো দা গামা, বিট্রিশ নাবিক, এক কথায় প্রাচীন পৃথিবীতে যারাই অজানার খোঁজে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়েছেন সবাই পৌছাতে চেয়েছেন ভারতে – বিশ্বাস ছিল চারপাশের সমস্ত চেনা পৃথিবীতে যা নেই, তার চেয়ে ঢের বেশি আছে এই ভূখন্ডে।
বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত। একসময় এই প্রাচুর্যের ভূমি যখন অখন্ড ছিল, সেটা ১৯৪৭ সালের ভারত পকিস্তান জন্ম হোক বা আফগানিস্তান আর ব্রিটিশ ভারতের সীমারেখাই হোক, কালের পরিক্রমায় এই অঞ্চলে অদৃশ্য সব সীমারেখার সংখ্যাইই কেবল বেড়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন এইসব সীমানা কখনো বিতর্ক জন্ম দিয়েছে, কখনো ঘটিয়েছে যুদ্ধ। সীমানা ভাগের বেশিরভাগই ছিল ব্রিটিশ শাসনামলে করা। পরবর্তীতে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হলেও এইসব সীমানা রয়ে গিয়েছে আগের মতো করে।
ডুরান্ড লাইন
২,৪৩০ কিলোমিটার জুড়ে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান মধ্যবর্তী আন্তর্জাতিক সীমান্তের নাম ডুরান্ড লাইন। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ কূটনীতিক স্যার মার্টিমার ডুরান্ড আফগানিস্তান এবং তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সীমানা চিহ্নিত করতে এই লাইন তৈরি করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হলে সেই লাইনটিই পরিণত হয় পাকিস্তান -আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক সীমানা হিসাবে।
তৎকালীন ব্রিটিশরা আফগানিস্তানকে একটি স্বাধীন রাজপরিবার হিসাবে বিবেচনা করলেও সেদেশের বৈদেশিক এবং কূটনৈতিক সকল কর্মকাণ্ড ছিল ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ১৮৯৩ সালের ১২ নভেম্বর পাশ করা হয়েছিল একক পৃষ্ঠার একটি চুক্তিনামা। চুক্তিনামার সাতটি শর্তের মধ্যে ডুরান্ড লাইন সংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতিও রয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে এটি পশতুন, বেলুচ এবং অন্যান্য জাতিস্বত্বার মানুষদের বিভক্ত করে ফেলে, যারা সীমান্তের দুই পাড়ের আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান উভয় দেশেই ছিল।
রেডক্লিফ লাইন
অখন্ড ভারত ধারণাটির জন্য এক বিশাল ধাক্কা হয়ে এসেছিল র্যাডক্লিফ লাইন, যা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতকে দুটি স্বাধীন দেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত করেছিল। তৎকালীন সীমান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান স্যার সাইরিল র্যাডক্লিফ(Cyril Radcliffe) ছিলেন এই সীমান্ত লাইনের রুপকার। তাই নির্ধারিত বিভাজনরেখাটির নাম দেওয়া হয় ‘রেডক্লিফ লাইন’। ১,৭৫,০০০ বর্গমাইল অঞ্চলে বসবাস করা ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের মধ্যে বিভক্তি এনেছিল এই লাইনটি। ভারত ও পাকিস্তানকে আলাদা করা এই লাইন মূলত পূর্বাংশে বাংলা ও পশ্চিম অংশে পাঞ্জাবকেও দ্বিখণ্ডিত করেছে। যার ফলে পাঞ্জাবের একটি অংশ পাকিস্তানের সাথে আরেকটি অংশ ভারতের সাথে থেকে যায়। অন্যদিকে বাংলার পূর্বাংশকে পাকিস্তানের সাথে এবং পশ্চিম অংশকে ভারতের সাথে জুড়ে দেয়া হয়।
শুধু ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে ভিত্তি করে ব্রিটিশরা অখন্ড ভারতকে ভােঙেছিল তিনটি অংশে- পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান এবং ভারত। তবে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। ফলস্বরূপ একটি নতুন দেশ সূচিত হয় এবং এটি বাংলাদেশ নামে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয়।ভারতকে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করা রেডক্লিফ লাইনটি ভারত এবং বাংলাদেশের বর্তমান সীমান্তরেখা।
ম্যাকমোহন লাইন
ভারত এবং চীন – এই দুই দেশের সীমান্ত এঁকেছে ম্যাকমোহন লাইন। যদিও চীন কখনই বিভাজনরেখাটিকে স্বীকার করেনি। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের সিমলা শহরে তিব্বত এবং ব্রিটিশ ভারত সরকারের প্রতিনিধিদল তিব্বতের সীমানা নির্ধারণের জন্য সভার আয়োজন করে। সম্মেলনে ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন হেনরি ম্যাকমোহন। ব্রিটিশ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন তিনি। সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব বর্তায় তাঁর উপরেই।
তাঁর নির্ধারিত সীমানার নাম দেওয়া হয় “ম্যাকমোহন লাইন”। সিমলা চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে চীন। তারা দাবি করে, তিব্বত সরকার সার্বভৌম নয় এবং তাই চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা তাদের নেই।
চীনের মানচিত্রে দেখা যায় ম্যাকমোহন লাইনটির দক্ষিণে প্রায় ৬৫,০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে স্বায়ত্তশাসিত তিব্বত প্রদেশের একটি অঞ্চল রয়েছে, যা দক্ষিণ তিব্বত নামে পরিচিত। কিন্তু এই অঞ্চলটি ভারতের অরুণাচল প্রদেশের মধ্যে পড়ে। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে সময় চীনা সেনাবাহিনী কিছু দিনের জন্য এই অঞ্চলটি দখল করে।
পাল্ক স্ট্রেইট
পাল্ক স্ট্রেইট ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্য এবং শ্রীলঙ্কার মান্নার জেলাকে পৃথক করে। এটি উত্তর-পূর্বে বঙ্গোপসাগরকে পাল্ক উপসাগরের সাথে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে মান্নার উপসাগরের সাথে সংযুক্ত করে।
স্ট্রেইটটি ৩৩ থেকে ৫০ মাইল (৫৩ থেকে ৮০ কিলোমিটার) প্রশস্ত। এটি নামকরণ করা হয় রবার্ট পাল্কের নামে, যিনি বৃটিশ কোম্পানি রাজ আমলে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির গভর্নর (১৭৫৫–১৭৬৩) ছিলেন।
অন্যান্য সীমান্ত
উল্লেখিত প্রধান এই লাইনগুলো ছাড়াও আরও কিছু সীমানা রয়েছে যা ভারত উপমহাদেশের বৃহত্তম দেশ ভারত এবং প্রতিবেশী দেশগুলোকে একে অপরের সাথে বিভক্ত করেছে। উত্তরখণ্ড, ইউপি এবং বিহারের ইন্দো-নেপাল সীমান্ত, সিকিম, আসাম ও অরুণাচলে ভারত-ভুটান সীমান্ত, অরুণাচল প্রদেশের ইন্দো-মায়ানমার সীমান্ত, নাগাল্যান্ড, মণিপুর এবং মিজোরাম – সব মিলিয়ে ভারতীয় মহাদেশকে মোট আটটি দেশে বিভক্ত করেছে এই সব সীমান্ত লাইন।
লেখক- ঐশ্বর্য মীম