পুরো পৃথিবীতে এই মূহুর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় এখন একটাই- ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। এই প্রথম সারা পৃথিবীর বড় বড় তাবৎ বিজ্ঞানী মিলে ‘ইভেন্ট হরাইজন টেলেস্কোপ’ প্রজেক্টের মাধ্যমে বুধবার, ১০ এপ্রিল ব্ল্যাকহোলের ছবি জনসম্মুখে নিয়ে আসেন।
ব্ল্যাকহোল দেখতে কেমন? এই প্রশ্ন নিয়ে আমাদের কল্পনার শেষ ছিলনা। কিন্ত এখন সেই প্রশ্নের উত্তর আমাদের হাতেই। আর এর মাধ্যমেই রচিত হল ইতিহাস, ভবিষ্যতের পথে একপা এগুনো।
ব্ল্যাকহোল হল মহাবিশ্বের এমন একটি জায়গা যেখানে খুব অল্প আয়তনে অনেক বেশি ভর বিদ্যমান। এতই বেশি যে তার নিজের মহাকর্ষীয় শক্তি এক দিকে যেমন তার ভেতর থেকে কোন কিছুকে বের হতে যেমন না, তেমনি তার কাছাকাছি আসা যেকোন জিনিসকে টেনে নেয় নিজের ভিতর। এই শক্তি এতই বেশি যে আলোও বের হয়ে আসতে পারেনা। প্যারিস পিএসএল এর নভোচারী গাইপেরিন এটির উদাহরণ হিসেবে বলেন, ব্ল্যাকহোল অনেকটা সূর্যকে ৬ কিলোমিটারের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলার মতো।
এই মহাকাশীয় দানবকে ফাঁদে ফেলতে অনেকদিন থেকেই চেষ্টা করছেন। এপ্রিল, ২০১৭ থেকে ৮ টি টেলেস্কোপকে পৃথিবীরচার পাশে ছেড়ে দেয়া হয় শুধুমাত্র একটিই উদ্দেশ্যে- দুটি ব্ল্যাকহোলের অন্তত একটি ছবি জোগার করা। অবশেষে দুই বছরের অপেক্ষায় অবসান হল ১০এপ্রিল, ২০১৯।
“এই ছবি ব্ল্যাকহোলের উপস্থিতি নিয়ে সকল সংশয় দূর করে দেয়”, জানান জন পিয়েরে লুমিনেট, যিনি ১৯৭৯ সালে প্রথম ব্ল্যাকহোলের ডিজিটাল সিমুলেশন তৈরি করেন। “ছবিটি একটি অকাট্য প্রমান, কেননা বিজ্ঞানীদের অনেকের মধ্যেও এ নিয়ে বিশাল সংশয় ছিল”।
এই ছবি তোলা কিন্ত মোটেও সহজ ছিল না। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ৩০ মিটার IRAM টেলেস্কোপ, যা ইউরোপে অবস্থিত এবং এর দায়িত্বে রয়েছে ফ্রান্সের CNRS, জার্মানির মার্ক্স-প্ল্যাংক-গিসেল শ্যাফট এবংস্পেনের IGN। সাথে রয়েছে চিলিতে তৈরি শক্তিশালী রেডিও টেলেস্কোপ যার দায়িত্বে রয়েছে ইউরোপ, ইউনাইটেড স্টেটস ও জাপান। চারটি আলাদা মহাদেশের, ছয়টি পর্বতের উপরে বসানো আটটি রেডিও অবজার্ভেটরি থেকে Event Horizon Telescope এর মাধ্যমে দুটি ব্ল্যাক হোল স্যাজিটারিয়াস আর ভার্গোর উপরে নজর রাখা হচ্ছিল।
স্যাজিটারিয়াস আমাদের মিল্কিওয়ের একদম মাঝ বরাবর রয়েছে, পৃথিবীর থেকে ২৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরে। এর ভর সূর্যের চেয়ে ৪.১ মিলিয়ন গুণ বেশি। অথচ এর ব্যাসার্ধ সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের মাত্র দশ ভাগের একভাগ।
অপরটির কোন নাম নেই, যার ভর স্যাজিটারিয়াসের ১৫০০ গুণ বেশি, পৃথিবী থেকে ৫০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে এবং M87 গ্যালাক্সিতে অবস্থিত। এরই ছবি আমরা দেখতে পারছি।
ছবিটিতে দেখা যায় গাঢ় কমলা রঙের ধুলা এবং গ্যাসের গোলাকৃতির একটি রিং এর মধ্যে গাঢ় কালো অংশ। এই পদার্থগুলো ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি এসে বিলীন হওয়ার আগে আলোর গতিতে ব্ল্যাকহোলের চারপাশে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এই ঘূর্ণনের সময় এরা যে রেডিয়েশন বিকিরণ করে তা EHT ধারণ করে নেয়।
এই অসাধারণ দলটি এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে আমাদের মিল্কিওয়ের ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে।
তাহলে এই ঐতিহাসিক সময়ে চলুন জেনে নেয়া যাক ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্যঃ
১. ঠিক যেমন ঘড়ি স্পেস স্টেশনের চেয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছে একটু ধীরে চলে ঠিক তেমনি ব্ল্যাকহোলের কাছে একেবারেই ধীরে চলে। সবটাই গ্রাভিটির কারণে। কত ধীরে চলবে তা নির্ভর করবে ব্ল্যাকহোলের আকারের উপর। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি বড়সড় ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি একদিন, পৃথিবীর কাছে ৭০ বছরের সমানও হতে পারে।
২. আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রচুর ব্ল্যাক হোল রয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় ১০০ মিলিয়ন। কিন্ত সুবিধার কথা হচ্ছে সব কটাই আমাদের নাগালের বাইরে। অর্থাৎ ব্ল্যাকহোলে পড়ে আমাদের পৃথিবী ধ্বংস হবার সম্ভাবনা তেমন নাই।
৩. আমরা সবাই জানি ব্ল্যাকহোল থেকে কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্ত একটা জিনিস পারে- রেডিয়েশন। কিছু কিছু বিজ্ঞানীদের মতে এই রেডিয়েশন নির্গমনের ফলে ব্ল্যাকহোল তার ভর হারায়। অর্থাৎ, ব্ল্যাকহোলের ধ্বংস হতে পারে।
৪. সাধারণ ধারণায় মনে হয় যে কেউ যদি ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি যায় ব্ল্যাকহোলের মধ্যে পুরো মানুষটাই হারিয়ে যাবে। কিন্ত আসলেই কি তাই? ব্ল্যাকহোলের শেষ প্রান্ত, যাকে ইভেন্ট হরাইজন বলা হয়, সেই অংশে শরীরের যে অঙ্গটি আগে পৌছাবে, মহাকর্ষের টানে তা এতটাই প্রসারিত হয়ে যাবে যে পুরো শরীর ব্ল্যাকহোলে পৌছানোর আগেই সে মারা যাবে।
৫. জনপ্রিয় ধারণা মতে, এলবার্ট আইন্সটাইন কিন্ত ব্ল্যাকহোল থিওরি আবিষ্কার করেননি। তিনি ১৯১৬ সালে ব্ল্যাকহোলের থিওরিকে নিয়ে নতুন ভাবে আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু আসলে তাঁর আরো আগে ১৭৮৩ তে জন মিচেল নামক একজন বিজ্ঞানী প্রথম চিন্তা করেন যে মহাকর্ষীয় শক্তি কি এত বেশি হতে পারে যে আলোও সেই শক্তি ভেদ করতে না পারে!
৬. ব্ল্যাকহোলের চেয়েও আজব কিছু কি হতে পারে? হ্যাঁ, পারে। হোয়াইট হোল! শুনতে আজব লাগলেও অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন ব্ল্যাকহোলের মতই হোয়াইটহোলও থাকতে পারে। ব্ল্যাকহোল অনেকটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার এর মতো, সামনে যা পায় তাই গ্রাস করে নেয়।হোয়াইটহোল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। থিওরী আছে যে ব্ল্যাকহোল সব কিছুকে ভেতরে টেনে নিয়ে অন্য এক ডাইমেমশনে হোয়াইটহোলের মাধ্যমে বের করে দেয়। এটি শুধুই একটি থিওরী। কিন্ত কি জানেন, ব্ল্যাকহোলও কিন্ত কয়েক বছর আগে শুধু থিওরিই ছিল। আজ কিন্ত তা সত্যি হয়েছে