ব্যাংক খাতে দুর্নীতি- প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা লুটপাট1 min read
Reading Time: 3 minutesসাধারণত ব্যাংক খাতকে বলা হয় একটি দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড, আর পুরো শরীর সুস্থ থাকার জন্য হৃদপিণ্ডের সুস্থ থাকাটা সত্যিই বেশ জরুরী। কেমন আছে আমাদের দেশের হৃদপিণ্ড? ব্যাংক খাতের সামগ্রিক অবস্থাই বা কেমন? বর্তমান বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদদের মতে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটির অবস্থা তেমন একটা ভালো নয়। সকাল বেলায় চা এর সাথে যখন খবরের কাগজ মেলে ধরবেন, তখন প্রায় প্রতিদিনই দেখবেন এই খাতের কোন না কোন দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ। তবে ব্যাংক খাতের এই দুর্নীতির মুল চাবিকাঠি হচ্ছে ক্রেডিট অর্থাৎ ঋণ ব্যবস্থা।
২০১২ সালের দিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেশে বেশ কিছু ব্যাংক এর অনুমোদন দেয়া হয় এবং এই ঋণ খেলাপি নামক ক্যানসার খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে সবগুলো ব্যাংক এর মধ্যে। ২০১৩ সালের নতুন ব্যাংকগুলোর নাম হল ফারমার্স ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ও এনআরবি ব্যাংক, মিডল্যান্ড, ইউনিয়ন, মেঘনা, মধুমতী, গ্লোবাল, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। বিগত ছয় বছরে নতুন অনুমোদন পাওয়া এই ব্যাংকগুলো এবং পুরানো ব্যাংকগুলোর সব মিলিয়ে ঋণ খেলাপির অংকটা শুনলে আপনাকে একটু নড়েচড়ে বসতে হবে। হ্যাঁ! নতুন অনুমোদন পাওয়া নয়টি ব্যাংকের এই ঋণ খেলাপির অংকটা হল চার হাজার দুইশত সত্তর কোটি টাকা! আর এই ঋণ খেলাপির পরিমাণ এতটাই বেড়ে চলেছে যে বিগত দুই বছরে নতুন ব্যাংকগুলোতে প্রায় আট গুন ঋণ খেলাপি বেড়েছে। আর এই বিশাল পরিমাণ ঋণের মধ্যে কেবলমাত্র ফারমার্স ব্যাংকেই প্রায় তিন হাজার সত্তর কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন এই ব্যাংকগুলো সম্পর্কে দিয়েছে চমকপ্রদ কিছু তথ্য। আর সেটা হল ২০১৬ সালের শেষের দিকে করা হিসেব অনুযায়ী এই নতুন ব্যাংকগুলোতে প্রায় পাঁচশত ষাট কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে। ২০১৭ সালে এই অংকের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে হয় নয়শত ষাট কোটি টাকা এবং ২০১৮ সালের শেষের দিকে এই ঋণ খেলাপি করা টাকার পরিমাণ অবিশ্বাস্য হারে বেড়ে হয়েছে প্রায় চার হাজার দুইশত সত্তর কোটি টাকা! ঋণ খেলাপির পরিমাণ এই হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিগত ছয় বছরে নতুন ব্যাংকগুলোর ভিত্তি মজবুত তো হয়নিই বরং দিনদিন এই ব্যাংকগুলো খুব বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে।
ইব্রাহিম খালিদ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এ নিয়ে বলেন, “আমাদের দেশে নতুন এই ব্যাংকগুলোর কোন প্রয়োজন ছিল না। আর প্রয়োজন না থাকার কারণে এই ব্যাংকগুলোর ব্যাংকিং ব্যবস্থাও তেমন একটা মজবুত অবকাঠামোর উপরে ছিল না। তবে এরমধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের দায়বদ্ধতাই এখানে সবচাইতে বেশি, এই ব্যাংকের কারণেই পুরো ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপির সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। এই করুন অবস্থা খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উপর এবং এটা করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রয়েছে”
ফারমার্স ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ২০১৬ সালে যেখানে এই ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ২৭৭ কোটি টাকা সেখানে মাত্র দুই বছর ব্যবধানে ২০১৮ সালে এই ঋণ খেলাপির পরিমাণ অবিশ্বাস্য হারে বেড়ে হয়েছে প্রায় তিন হাজার সত্তর কোটি টাকা! প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক মন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর। তবে ব্যাংকের অবস্থা চরম খারাপের দিকে যাওয়া শুরু করার পর ২০১৭ সালের শেষের দিকে তিনি তার পদ ছেড়ে দেন।
অপরিদকে অন্যান্য ব্যাংক যেমন মেঘনা ব্যাংকের পরিসংখ্যানের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ২০১৬ সালে যেখানে এই ব্যাংক এর ঋণ খেলাপির পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি টাকা সেখানে ২০১৮ সালের শেষের দিকে এর পরিমাণ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২৩৫ কোটি টাকা। এই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হলেন সাংসদ এইচ এন আশিকুর রহমান।
২০১৬ সালে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ছিল দুই কোটি টাকা এবং ২০১৮ সালের শেষের দিকে এর পরিমাণ হয়েছে ৮৭ কোটি টাকা।
২০১৭ সালের শেষের দিকে মিডল্যান্ড ব্যাংকের ঋণ খেলাপির পরিমাণ ছিল সাতাশ কোটি টাকা এবং ২০১৮ সালের শেষের দিকে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ কোটি। একই ভাবে মধুমতী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০১৬ সালে যেখানে ছিল ছয় কোটি সেখানে ২০১৮ সালের শেষে এর সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১০২ কোটিতে।
ইউনিয়ন ব্যাংকের ঋণ খেলাপির পরিমাণ ২০১৬ সালের শেষের দিকে ছিল তিন কোটি টাকা এবং ২০১৮ সালের শেষের দিকে এর পরিমাণ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় চুরাশী কোটি টাকা। এই ব্যাংকটির মালিকানায় রয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ও এস আলম গ্রুপ। অপরদিকে এনআরবি ব্যাংকের ঋণ খেলাপির পরিমাণ ২০১৮ সালের শেষের দিকে ১৫৭ কোটি টাকা হয়েছে এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের হয়েছে ১১৮ কোটি টাকা। এছাড়া এনয়ারবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ২০১৮ সালের শেষের দিকে এসে দাঁড়ায় প্রায় তিনশত পঞ্চাশ কোটি টাকায়। তবে ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসায় এই ব্যাংকটির বর্তমান কার্যক্রম এবং অবস্থা বেশ ভালো আছে বলে জানা গিয়েছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এর মতে খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যাপারে বড় ধরনের কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। তবে এজন্য সরকার এবং আদালতের পক্ষ থেকে প্রচুর পরিমাণে সহযোগিতার প্রয়োজন আছে।
জানলাম ঋণ খেলাপির কিছু তথ্য তবে এখনো আরো একটি ব্যাপারে কিছু তথ্য দেয়া বাকি রয়ে গেছে। আর সেটা হল ব্যাংক জালিয়াতি ও টাকা আত্মসাৎ নিয়ে! বিগত দশ বছর ধরে এননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় এগারো হাজার দুইশত ত্রিশ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। অপরদিকে বেসিক ব্যাংক হারিয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, হলমার্ক ঘটনায় সোনালী ব্যাংক হারিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। আবার নতুন অনুমোদিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে এনআরবি এবং ফারমার্স ব্যাংক থেকেই আত্মসাৎ হয়েছে প্রায় বারোশ কোটি টাকা।