‘২ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে শেষ রাষ্ট্র বেনিন জেনোসাইড কনভেনশন অনুমোদন করে। এর ফলে এখন পর্যন্ত ১৪৯ টি রাষ্ট্র এই কনভেনশনের আওতাভুক্ত হলো অর্থাৎ ১৪৯ টি রাষ্ট্র চুক্তিবদ্ধ হলো তারা নিজ নিজ রাষ্ট্রসীমার মধ্যে জেনোসাইডের সম্ভাবনা প্রতিহত করবে, পৃথিবীর অন্য কোথাও জেনোসাইড ঘটলে এর দ্রুত অবসান ঘটাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে এবং পৃথিবীর যেখানেই জেনোসাইড ঘটুক, অপরাধীর শাস্তি বিধানের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।‘
_ জেনোসাইড ৭১ তত্ত্ব.তর্ক.তথ্য –হাসান মোরশেদ (পৃষ্ঠা ৮২)
মানবতার চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তে পুরো বিশ্ব বারবার একত্র হয়েছে, শান্তিচুক্তি ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান করেছে যুদ্ধসহ নানান সমস্যা। কিন্তু বহু শান্তিচুক্তি করবার পরেও আদতে শান্তি স্থাপিত হয়নি নানা দেশে। একাত্তরের গণহত্যা কিংবা নাৎসি বাহিনির চূড়ান্ত বর্বরতা- কালে কালে স্তম্ভিত করেছে মানবতাকে। এমনই এক বিস্মৃত ঘটনা সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবিরের গণহত্যা।
পটভূমি
১৯৭৫–১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলা লেবানিজ গৃহযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়, উদ্বাস্তুর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয় কয়েক কোটি লোক। গৃহহীন, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এই জীবনের অধিকাংশ ভুক্ত ভোগীই ছিল ফিলিস্তিনি, লেবানিজ মুসলিম। তবে এই অত্যাচারের পটভূমি নতুন নয়। ইসরায়েল–ফিলিস্তিনের দ্বৈরথ বহু পুরনো। আর তা থেকেই ১৯৬৪ সালে উত্থান ঘটে পিএলও বা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের। এই দলের লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলি সেনাদের অত্যাচার থেকে সহিংস উপায়ে ফিলিস্তিনিদের রক্ষা ও স্বাধীনতা অর্জন।
দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালাচ্ছিল পিএলও। ১৯৮২ সালের জুনে ইসরায়েলি গৃহযুদ্ধ তুঙ্গে থাকা অবস্থাতেই লেবাননে প্রবেশ করে ইসরায়েলি সৈন্যরা। টানা তিন মাস যুদ্ধের পর পিছু হটে পিএলও। ফলস্বরুপ তৎকালীন সংগঠন প্রধান ইয়াসির আরাফাত বৈরুত থেকে এর সদর দপ্তর প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু ততদিনে বেশ দেরিই হয়ে গেছে। লেবাননের রাজধানীসহ এর সীমান্তবর্তী এলাকা তখন ইসরায়েলি সেনাদের অধিকারে ।
১৯৮২ সালের ২৩ আগস্ট, লেবানিজ ফোর্সের বশির জামায়েল লেবাননের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন খ্রিস্টান ডানপন্থী ফ্যালাঞ্জি কাতিব পার্টির প্রধান। লেবাননে বশিরের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই ইসরায়েল সরকার পিএলওর সাথে সাময়িক দেনদরবারের কথা ভেবেছিল। যুদ্ধে আক্রান্ত লেবাননের সরকার প্রধানের কাছে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবও রেখেছিল ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনশাম বেগিন। তবে পিএলও গেরিলাদের আটক ও হস্তান্তরের প্রশ্নে বশির বেঁকে বসলে ইসরায়েলের সাথে বিরোধ বাঁধে তাঁর। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনীর সহায়তায় পিএলও গেরিলারা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ইসরায়েলি রণমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন। সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকেই তিনি গুজব ছড়াতে থাকেন, লেবাননের উদ্বাস্তু শিবিরে কিছু পিএলও গেরিলা গা ঢাকা দিয়ে আছে।
এই খবরের ভিত্তিতেই কার্যত অবরুদ্ধ করা হয় লেবাননের দক্ষিণ– পশ্চিম উপকণ্ঠের সাবরা ও শাতিলা শিবিরকে। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীও ১১ সেপ্টেম্বর লেবানন ত্যাগ করে। তবে সব হিসেব গোলমেলে হয়ে যায় আরেক ষড়যন্ত্রে। ১৯৮২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর নিজ কার্যালয়ে এক বোমা বিস্ফোরণে ২৬ কর্মকর্তাসহ বশির মারা পড়েন। এতে ইসরায়েল, মোসাদ, সিআইএ তথা মার্কিন ইন্ধন থাকলেও সম্পূর্ণ দায় চাপানো হয় পিএলওর উপর। সাধারণ লেবানিজদের বোঝানো হয় , পিএলও লেবাননে নির্বাচিত সরকারের বিপক্ষে এবং ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনি শরণার্থী গোষ্ঠী তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও পরবর্তীতে সিরিয়ান গোয়েন্দাবাহিনির হাবিব শারটোনি এই হামলার দায় শিকার করে নেয়।
গণহত্যার সূচনা
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি সেনারা প্রবেশ করে সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবিরে। এরিয়েল শ্যারনের মদদে লেবাননের সামির জাজা ও ইয়ালি হাবিকের সহায়তায় শুরু হয় ইতিহাসের অন্যতম ন্যাক্কারজনক গণহত্যা।
প্রথমে ইসরায়েলি সেনাবাহিনি এই দুই শিবিরের চতুর্দিক ঘিরে ফেলে। এর প্রতিরক্ষা দলের স্নাইপার শুটারগণ অবস্থান নেয় ক্যাম্পের চারপাশে থাকা সুউচ্চ স্থাপনার ছাদে। এরপর শিবিরের অভ্যন্তরে ইসরায়েলি সেনা ও ফ্যালাঞ্জিস্ট খ্রিস্টান উগ্রবাদিরা প্রবেশ করে। বশিরের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ফ্যালাঞ্জিস্টরা আদতে ছিল স্প্যানিশ খ্রিস্টান ফ্যাসিস্ট মতবাদের অনুসারী। দুই শিবিরে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট ও ধর্ষণ চালায় এই দুই বাহিনি। সাবরা ও শাতিলার অধিকাংশই ছিলেন নিরীহ নারী, শিশু ও প্রৌঢ়। তবে শুধু ফিলিস্তিনিই নয়, এর মাঝে ছিলেন ১৪০ জন লেবানিজও। ১৬ সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যা ছয়টা থেকে শুরু করে ১৮ সেপ্টেম্বর সকাল আটটা পর্যন্ত চলা, মোট ৩৬ ঘণ্টার গণহত্যায় মারা পড়েন প্রায় পাঁচ হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি।
নারকীয় হত্যাযজ্ঞ
সিঙ্গাপুরের সুই অ্যান সেসময় ছিলেন লন্ডন নিবাসী অর্থোপেডিক সার্জন। মানবতার খাতিরেই লেবানিজ গৃহযুদ্ধে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন তিনি। জেনোসাইডের সময় সাবরা ও শাতিলা শিবিরের দায়িত্বেই ছিলেন তিনি ও আরেক নরওয়েজিয়ান ডাক্তার। তাঁর জবানিতেই শোনা যাক সেদিনের অবস্থা সম্পর্কে, ‘১৬ই সেপ্টেম্বর হাসপাতালে আচমকাই আহত মানুষের ভিড় বাড়তে লাগলো। এদের সিংহভাগই মহিলা। তারা জানায়, সেদিন ভোর পাঁচটায় যখন পানি সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়েছিল তখনই সেনাবাহিনির লোকজন গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই মারা পড়ে অনেকে।
তবে সন্ধ্যা থেকে সশস্ত্র বাহিনি ঘরে ঘরে গিয়ে হত্যাকাণ্ড শুরু করে। এরপরেও যারা পালিয়ে আসতে সমর্থ হন তাদের বেশিরভাগই জরুরি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল। অথচ সে তুলনায় জনবল ও রক্তের সংস্থান ছিল একেবারের অপ্রতুল। হাসপাতালের সিঁড়ি থেকে প্রত্যেকটি কোণে লোকে লোকারণ্য।
পরদিন সকালেই প্রায় দুহাজার লোক জড়ো হলো চিকিৎসার জন্য। খাদ্য, ওষুধ, রক্ত সবকিছুরই সংকট তখন। হেড নার্স বাইরের এক হাসপাতাল থেকে সাহায্য আনতে গিয়ে জানালো, সেখানের সব রোগী–ডাক্তার– নার্স নির্বিচার হত্যার শিকার। বহু নার্স নাকি ধর্ষিতও হয়েছেন।
১৮ তারিখের অবস্থা আরও ভয়াবহ। লেবাননি এক সেনা কর্মকর্তা সকালেই আমাদের মধ্যে যারা বিদেশি আছেন তাদের হাসপাতাল ত্যাগ করতে বললেন। আমরা যখন বেরিয়ে আসছিলাম, অনেক শরণার্থীই অনুরোধ করেছিল তাদের সন্তানকে আমাদের সাথে বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার। হাসপাতালের বাইরে দেখলাম বহু নারি–শিশু–পুরুষকে সেনারা দলবেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। রস্তায় হাঁটার পথে বহু মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে। ইট কাঠের স্তুপে একজনের দেহ দেখে এগিয়ে যেতেই থমকে উঠলাম। মরা লোকটার চোখ উপড়ে নিয়েছে মিলিশিয়ারা।‘
জবানিতে পৈশাচিক বর্বরতা
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড হার্স্ট দীর্ঘদিন যাবত ইসরায়েলি– ফিলিস্তিনি দ্বৈরথ নিয়ে কাজ করছেন । তিনি তাঁর ‘The Gun & The OLive Branch’ এ গণহত্যার স্বরূপ নিয়ে বলেন, ‘ ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ফ্যালাঞ্জিস্টরা প্রথমে শাতিলায় ঢোকে। তারা রাইফেল ও ধারালো অস্ত্র বহন করছিল। রাতেও থেমে থাকে নি নারকীয় যজ্ঞ। বরং ইসরায়েলি সেনারা তাদের বারান্দা, উঠানে আলো জ্বালিয়ে রাখতো। প্রয়োজনে বাজি পুড়িয়েও আলোর ব্যবস্থা করেছে তারা। ফ্যালাঞ্জিরা ঘুমন্ত ফিলিস্তিনিদের ঘরে ঢুকে নির্বিচারে ব্রাশফায়ার করে। আবার কাউকে অকথ্য নির্যাতনও করে। যেমন– চোখ উপড়ে ফেলা, চামড়া ছিলে নেয়া, নারীদের ধর্ষণ করে স্তন ও যৌনাঙ্গ কেটে নেয়া। শিশুদের বেলায় তারা কোন ছাড় দিতো না। ছোট বাচ্চাদের দেহ দুই ভাগ করতো অথবা দেয়ালে আছড়ে মগজ বের করে নিতো।
হাসপাতালগুলোর অবস্থা ছিল আরও পৈশাচিক। রোগীদের বিছানাতেই হত্যা করা হয়। কারো হাত কেটে আংটি নেয়া হয়েছে, কারো গলা কেটে চেইন লুট করেছে। অনেকের দেহ গাড়িতে বেঁধে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হতো। হত্যাযজ্ঞ শেষে দাফনের ঝামেলা পোহাতে চায়নি তারা। বুল্ডোজার দিয়ে ঘরবাড়িসহ মৃতদেহ চাপা দিয়েছিল ইসরায়েলি সৈন্য ও ফ্যালাঞ্জিরা। দাফনের একটা লোকও ছিল না। লাশগুলো কুকুরবিড়ালের আহারে পরিণত হয়েছিল তখন।‘
ইসরায়েলি সাংবাদিক রন বেন ইশাই এই গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন বিশ্বের কাছে। তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ প্রথম যখন ওখানে যাই চারিদিকে শুধু দুঃস্থ নারীদের আহাজারি চলছে। একটা ঘরও দাঁড়িয়ে নেই, সব গুঁড়িয়ে গেছে দুইদিনেই। স্তূপের মাঝ থেকে লোকের হাত, পা, মাথা বেরিয়ে আছে। অপার্থিব একটা পরিবেশ। এর মধ্যেই দেখতে পেলাম, কোঁকড়া চুলের ছোটখাটো একটা মুখ। একটা মেয়েশিশু, বয়স আর কত! পাঁচ বা ছয়! ওই বয়সের আমারও একটা মেয়ে আছে। কিছু আগেই তার সাথে খেলা করে ফিরলাম আমি।‘
আরেক সাংবাদিক গাজি খুরশিদ তাঁর বই ’অধিকৃত ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী সন্ত্রাস’ এ লিখেছেন, ‘রাস্তায় পাঁচ ফিলিস্তিনি নারী ও কয়েকটি শিশুর লাশ স্তূপাকারে মাটির উপর পড়েছিল। এদের মধ্যে একজন মহিলার কাপড় সামনের দিক থেকে ছেঁড়া ও তাঁর স্তন দুটি কেটে নেয়া হয়েছিল । এর পাশেই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা একটি মেয়ের মাথা। আরেক যুবতীর লাশ দেখতে গিয়ে চমকে উঠলাম আমরা। সে তাঁর দুধের শিশুকে কোলে আগলে রেখেছিল , তবুও কতগুলো গুলি শরীর ঝাঁজরা করে ওই দুধের শিশুর শরীরে বিদ্ধ হয়েছে।’
অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক টনি ক্লিফটন ‘God Cried’ বইয়ে আরও রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন, ‘এক ব্যক্তির পোড়া লাশ দেখে কেঁপে উঠেছিলাম আমি। পরে জেনেছি ফ্যালাঞ্জিরা ওই ফিলিস্তিনির গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। পুড়ে অঙ্গার হওয়া মুখের মধ্যে শুধুমাত্র সাদা দাঁতগুলোই অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল।’
বিস্মৃতির আড়াল
১৮ সেপ্টেম্বরেই গোটা বিশ্বের কাছে এই ভয়ানক অপরাধের খবর পৌঁছে যায়। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমনকি ইসরায়েলেও এর বিপক্ষে মিছিল নেমে আসে রাজপথে। তদন্তের স্বার্থে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠিত হয়। কমিটির প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ইসরাইলই এই ঘটনার জন্য দায়ী। এমনকি এর প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্যারনও এর সরাসরি ইন্ধনদাতা। ১৯৮৩ সালে এই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শ্যারন পদত্যাগে বাধ্য হন। ২০০১-০৫ সালের কিস্তিতে প্রধানমন্ত্রীর পদও পান ‘বৈরুতের কসাই’। সারাবিশ্বে বিক্ষোভ চললেও সাবরা আর শাতিলা শরণার্থী শিবিরের এই ঘটনায় জড়িতদের কোন বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি।
ফিলিস্তিনিদের জীবন ইতিহাস ঘাঁটলে গত সাত দশকে শুধু রক্তপাত ও সংগ্রামই পাওয়া যাবে। প্রহসন, গণহত্যা আর বিচারহীনতাই যেন ফিলিস্তিনি নর-নারীর অনন্ত নিয়তি।