বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র1 min read
Reading Time: 4 minutes‘সভ্যতা ব্যাপারটা পুরোটাই মিথ্যে আর অকেজো যদি সেটা মানুষে মানুষে হানাহানি,রক্তপাত বন্ধ না করতে পারে। হাজার হাজার টর্চার চেম্বার, লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যুই বলে দেয় যুদ্ধ কী।’
–অল কোয়াইয়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট (এরিক মারিয়া রেমার্ক)
জার্মান লেখক এরিক মারিয়া রেমার্ক, জোসেফ হেলার, রিচার্ড আলডিঙ্গটনসহ বহু প্রতিথযশা লেখকই আজীবন যুদ্ধের বিপরীতে কথা বলে গেছেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন বলেই যুদ্ধের হাহাকার আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিয়তার নির্দয় চিত্রটা বেশ ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে তাঁদের দোয়াতের কালিতে।
১৯১৪–১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৩৯–১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সর্বমোট ১২০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্বযুদ্ধগুলো শুধু রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বিরোধের ফলে হলেও অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায়, হারায় মাতৃভূমি।
বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা আজও মানুষকে ভাবায়। তবে সেই ভাবনায় সবচাইতে বেশি এগিয়ে বোধহয় হলিউডই! যুদ্ধ নিয়ে এই সিনেমাপাড়ায় তৈরি হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র। চলুন জেনে আসি সেগুলো থেকে চুম্বক কয়েকটির কথা।
শিন্ডলারস লিস্ট (১৯৯৩)
গাড়িটার দিকে বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন অস্কার শিন্ডলার। সেখানে গাড়ির বদলে দশটা মানুষ থাকতে পারতো, বাঁচতে পারতো আরও দশটা জীবন। অথবা কোট পিনটার দামে কেনা যেতো আরও দুজনকে।
লিয়াম নেসন ও স্যার বেন কিংসলে অভিনীত ‘শিন্ডলারস লিস্ট’ ছবির শেষ দৃশ্য এটি। শুধু এই দৃশ্যই বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর ভেতরে থেকেও মানবতার প্রখর দৃষ্টান্ত স্থাপনের ইতিহাস। শিন্ডলার ও তাঁর ইহুদি হিসাবরক্ষক স্টার্ণের প্রখর দূরদর্শিতায় ১২০০ নিরপরাধ ইহুদি বেঁচে যায় জার্মান কন্সেট্রেশন ক্যাম্প থেকে। স্টিফেন স্পিলবার্গের পরিচালনায় ২২ মিলিয়ন বাজেটের এই ছবিটি আয় করে ৩২২ মিলিয়ন ইউএস ডলার। থমাস কেনেলি রচিত জীবনিভিত্তিক বই ‘শিন্ডলারস আর্ক’কে উপজীব্য করে নির্মিত এই ছবি অস্কার, গোল্ডেন গ্লোবসহ অজস্র পুরস্কার জয় করে নেয়।
দ্য পিয়ানিস্ট ( ২০০২)
অস্কারের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে সেরার পুরস্কার ঘরে তুলেছিলেন আড্রিয়েন ব্রডি এই ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ দিয়েই। রোমান পোলোনস্কির অন্যতম সেরা কাজ মানা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ছবিকে। পোলিশ পিয়ানোবাদক ওয়াদিসওয়াফ স্প্লিজমানের বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও হলোকাস্টের নগ্নরূপ উঠে এসেছে এই যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে।
পাম ডি অর, সিজার এ্যাওয়ার্ড সহ বহু আন্তর্জাতিক সম্মান পাওয়া এই ছবিটি আয় করে ১২০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। অনেকের মতে সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।
ডানকার্ক (২০১৭)
গল্প শোনাবার বেলায় ক্রিস্টোফার নোলান অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার আরেক পশলা দেখা গেছে যুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ডানকার্কে’। এটিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই নির্মিত। ব্রিটেন– আমেরিকা–ফ্রান্স–নেদারল্যান্ড, এই চার দেশের প্রযোজনায় তৈরি এই ছবির মূল গল্প আবর্তিত হয়েছে ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের ডানকার্কে ঘটে যাওয়া এক প্রলয়ঙ্করী ঘটনাকে ঘিরে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স থেকে ব্রিটিশ সেনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় জার্মান সেনাবাহিনীর হামলার দারুণ রুপায়ন দেখা গেছে এই ছবিতে। যদিও উইনস্টন চার্চিল সেসময় এই ঘটনাকে ‘ব্যাপক মিলিটারি দুর্যোগ’ হিসেবেই অভিহিত করেছিলেন।
অস্কারে শ্রেষ্ঠ সাউন্ড এডিটিং, সাউন্ড মিক্সিং ও সম্পাদনার পুরস্কার জিতে নেওয়ার পাশাপাশি ৫২৭ মিলিয়ন ইউএস ডলারও আয় করে এটি।
ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস (২০০৯)
কোয়ান্টিন টারান্টিনোর ধাঁচটাই অন্যরকম। সবাই যে পথে হাঁটে সেই পথে তিনি পাও মাড়ান না। তাই যুদ্ধের গল্প বলার ধরণেও তিনি দেখিয়েছেন অন্য স্বাদের খোঁজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উত্থান ঘটে নাৎসিদের, আর এর পাশাপাশি তাদের দমন করতে এগিয়ে আসে একদল ইহুদি–আমেরিকান যোদ্ধা– যাদের নাম ‘বাস্টার্ডস’।
ছবিতে নির্বিচার ইহুদি হত্যার চাইতেও গুরুত্ব পেয়েছে এর বিরুদ্ধে জেগে ওঠা শক্তির তৎপরতার দৃশ্য। আংশিক সত্য ঘটনা অবলম্বনে ছবিটিতে অভিনয় করেছে ব্র্যাড পিট, ডায়ানে ক্রুগার, ক্রিস্টোফ ওয়াল্টজ সহ অনেকেই। হান্স লান্ডা চরিত্রের জন্য প্রথমে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওকে ভাবা হলেও পরে জার্মান ওয়াল্টজকেই নেন টারান্টিনো।
এই ছবিটি মূল গল্পের সাথে সাথে অনন্য সুরারোপ আর ব্যতিক্রমী ভায়োলেন্সের জন্যও আলোচনায় আসে। ৩২১ মিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করা এই ছবিতে অস্কারে ৮ বিভাগে মনোনয়ন পেলেও একমাত্র ওয়াল্টজই সেরা সহ অভিনেতার অস্কার ঝুলিতে ভরেন।
হক শ রিজ (২০১৬)
অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনার বেলাতেও যে মেল গিবসন সফল, তার আরেকটি প্রমাণ ’হক শ রিজ’। ২০০৪ সালে প্রচারিত ‘দ্য কনসাইন্শাস অবজেক্টর’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এন্ড্রু গারফিল্ডকে নিয়ে তৈরি করেন এই ছবিটি।
অধিকাংশ যুদ্ধের ছবির মতো এটিও জীবনীভিত্তিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া আমেরিকান চিকিৎসক ডেসমন্ড ডসের অভিজ্ঞতা নিয়েই তৈরি হয়েছে এই ছবিটি। অভিজ্ঞতার সাথে আবেগের অনন্য মিশেলের এই ছবিটিও বক্স অফিসে আলোড়ন তুলতে সমর্থ হয় সে বছর। আমেরিকান ফিল্ম সোসাইটি একে ২০১৬ সালের সেরা দশ চলচ্চিত্রের তালিকাতেও রাখে।
সেভিং প্রাইভেট রায়ান
‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’কে বলা হয় যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের নবজন্মের দূত। স্টিফেন স্পিলবার্গের এই ছবিতে ক্যামেরার কাজ এতটাই নতুন ধাঁচের ছিল যে পরবর্তীতে একে অনুসরণ করেই অনেক যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র এবং গেম নির্মিত হয়। এই ছবিটিও সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি।১৯৪৪ সালের পটভূমিতে নির্মিত এই ছবিটি সর্বকালের অন্যতম সেরা ওয়ার মুভিজ হিসেবেও স্বীকৃত।
টম হ্যাংকস, ম্যাট ড্যামন, ভিন ডিজেল অভিনীত এই ছবিটি সারাবিশ্বে আয় করে ৪৮২ মিলিয়ন ইউএস ডলার। সে বছর অস্কারে সর্বাধিক ১১ টি মনোনয়ন পায় ছবিটি এবং সেরা পরিচালক্সহ ৫টি পুরস্কার বগলদাবা করে।
যুদ্ধকেন্দ্রিক অসংখ্য ছবির মধ্যে মাত্র কয়টির নাম নেয়া বেশ দুঃসাধ্য। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং শরণার্থীদের মানবেতর জীবন নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রের সংখ্যা কম বা বেশি যাই হক না কেন, সবকিছুরই মূলে পরিচালক ও কলাকুশলীরা একটি বার্তাই পৌঁছাতে চান– ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি ও মানবতাই হোক কাম্য।