বাংলাদেশ

বিচারের বাণী আর কতবার নিভৃতে কাঁদবে?1 min read

অক্টোবর ২২, ২০২০ 4 min read

author:

বিচারের বাণী আর কতবার নিভৃতে কাঁদবে?1 min read

Reading Time: 4 minutes

বাংলাদেশের টেলিভিশন টকশো সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত শব্দ সম্ভবত “বিচারহীনতা“। “নানা মুনির নানা মত” এর আদলে বক্তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বুলি আওড়ে গেলেও দেশের বিচার ব্যবস্থা খুব বেশি উন্নতির মুখ আজো দেখেনি। এদেশে মামলার রায় হয়েছে এমন অপরাধের সংখ্যা হাতে গুণে শেষ করা সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অনেক নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসবের মাঝে খুব কম সংখ্যক ক্ষেত্রেই বিচারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে। ২০১০ সালের সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকান্ডের বিচারিক কার্যক্রম পিছিয়ে যেতে যেতে আদালতের কার্যতালিকা থেকেই বাদ পড়ে গিয়েছে।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি মহল যাকে বড় বড় অক্ষরে বিচারহীনতার সংস্কৃতি সহ অন্যান্য বড় নামে ডাকেন, আমজনতার কাছে তার অর্থ একটাই- এদেশে বিচার হয়না।

কবে বিচার পাবে আবরার ফাহাদ

একটি স্ট্যাটাস থেকে একটি প্রাণ। ঘটনাস্থল দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর ছাত্র আবরার ফাহাদ নিহত হবার পর একবছর পার হয়ে গেছে। অথচ এখনো পর্যন্ত এই মামলার রায় আসেনি। সবশেষ ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং একজন মেসবয় সাক্ষ্য দিয়েছে। এ নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষে ৬০ সাক্ষীর মাঝে কেবল ১১ জনের সাক্ষ্য দেয়া শেষ হলো। প্রশ্ন থাকতে পারে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালেই যদি এহেন ধীরগতির বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাহলে দেশের বিচার সংস্কৃতির ভবিষ্যত কোথায়?

মহামান্য আদালত চলতি মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত ধারাবাহিক সাক্ষ্য প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর চার্জশিটের ২৫ আসামির বিপক্ষে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচারকাজ শুরু হয়। কিন্তু ততদিনে পেরিয়ে গিয়েছে হত্যাকান্ডের ১১ মাস। এই নির্মম হত্যাকান্ডের চার্জশিট দখলের বেলাতেও ছিল ধীরগতি। আবরারের মৃত্যুর ১ মাস পেরিয়ে যাবার পর গত বছরের নভেম্বরে ২৫ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন ডিবি পুলিশের লালবাগ জোনাল টিমের পরিদর্শক মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান।

উল্লেখ্য এই বিচারে ২৫ আসামীর মাঝে পলাতক তিনজন। যার মাঝে দুইজনের নাম এজহারে রয়েছে।

কোন পর্যায়ে আছে মেজর সিনহা হত্যার বিচার

পুরো দেশ তোলপাড় করে ফেলা মেজর সিনহা হত্যার বিচার কাজ এখন কোন পর্যায়ে? কোন সাংবাদিক তো বটে, স্বয়ং আইনি প্রক্রিয়ায় যুক্ত ব্যক্তিরাও এই খবর সঠিকভাবে দিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে আছে সংশয়। দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সর্বশেষ মেজর সিনহা সংক্রান্ত খবর পাওয়া যায় ৭ অক্টোবর। অথচ সাবেক সেনা সদস্য হবার কারণে সবারই আশা ছিল বিচার কাজে হয়ত গতি আসবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই মামলার অগ্রগতি বলতে তিনজন আসামীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আর বেশ কিছু তদন্তের মাঝেই সীমাবদ্ধ।

৭ অক্টোবরের “সর্বশেষ” খবর অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের “সর্বশেষ” তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে তারা এই হত্যাকান্ডের বিচার দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়েছে। যদিও আপাতত এর ভবিষ্যত কোথায় তা নিয়ে দেশের মানুষের মাঝে যথেষ্ট শঙ্কা আছে।

এর আগে ৪ অক্টোবর আসামীপক্ষ এই মামলার স্থগিত চেয়ে আবেদন করে বসেন। সমস্ত প্রমাণ থাকার পরেও আসামীপক্ষের এমন আবেদন বেশ হাস্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আসামীপক্ষের দাবি এই মামলাটি অবৈধ। আইনজীবি মাসুদ সালাহ উদ্দিন বলেন, সিনহার বোনের করা মামলায় বিচার প্রক্রিয়া যথাযথ আইন অনুসারে হচ্ছে না। ফলে সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিয়ে সন্দেহ আছে।

আসামীপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছিল। বলে রাখা দরকার, এই মামলায় ১৪ জনকে আটক করা হয়। যার মাঝে ১২ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। তবু কেন মামলা স্থগিতের আবেদন করা হয়েছে, তা এক ধোঁয়াশাই বটে।

ধর্ষণ, ধর্ষণ এবং শুধুই ধর্ষণ

সাম্প্রতিক বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত শব্দ অবশ্যই ধর্ষণ। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় বিব্রত এই দেশ। সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ এবং নোয়াখালিতে ধর্ষণের ভিডিও প্রকাশের ঘটনা দেশের মানুষকে আতঙ্কের চরমসীমায় নিয়ে গেছে।

কুমিল্লা সেনানিবাসে তনু ধর্ষণের পর তাকে ভাল্লুকের আক্রমণ বলে চালিয়ে দেয়ার মত ঘটনাও এদেশে ঘটেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এমসি কলেজে ধর্ষণের ঘটনায় যৌথ অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন হাইকোর্টে পৌঁছেছে। ২৯ সেপ্টেম্বরের এই ঘটনায় এর মাঝে ৫ জন আসামী গ্রেফতার হয়েছে এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।

এছাড়া নোয়াখালীতে ধর্ষণের ৩২ দিন পর প্রকাশ হওয়া ভিডিও নিয়েও সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় হয়েছিল। এই মামলায় মূল অপরাধী দেলোয়ারকে আটক করা হয়েছে। দেলোয়ার রীতিমতো তার নিজস্ব এক বাহিনী গড়ে তুলেছিল। তাকে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। একইসাথে তার সহযোগীকেও আটক করা হয়েছে।

দেশে প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণ সংক্রান্ত আটকের খবর এলেও এসব ক্ষেত্রে বিচার অনেক বেশিই ধীর গতির।

তবু কিছু আশা আজো বেঁচে আছে

তবে এতকিছুর ভিড়ে আশার আলোও আছে। সেক্ষেত্রে বেশ কিছু মামলার রায় নিয়ে কথা বলা দরকার। প্রথমেই আসে ২০১৫ সালের সামিউল আলম রাজনের হত্যাকান্ডের কথা। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই চুরির অভিযোগ তুলে রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করেন সৌদী প্রবাসী কামরুল ইসলাম। মাত্র ৪ মাসের মাথায় এই হত্যাকান্ডের মামলায় চারজনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়। এবং তা পরবর্তীতে বহাল থাকে। যদিও ২০১৭ সালের পর আসলেই কি হয়েছে তা নিয়ে আর জানা যায়নি।

ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলার ক্ষেত্রে দেশের বিচার ব্যবস্থার কার্যক্রম দেশবাসীকে প্রচন্ড আশাবাদী করে তুলেছিল। সাত মাসের কম সময়ে, মাত্র ৬১ কার্যদিবসেই এই হত্যা মামলার রায় চলে আসে। এই মামলায় মোট ১৬ জনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়েছিল। এছাড়া বিচার চাইতে গিয়ে নুসরাতকে হেনস্তা করা সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেমকে ডিজিটাল আইন মামলায় ৮ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছিল।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছে বাগেরহাটের সাম্প্রতিক ধর্ষণ মামলার রায়। ৭ বছরের শিশুকে ধর্ষণের মামলায় আসামী আব্দুল মান্নান সরকারকে আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হয়। এবং বিষ্ময়কর হলেও সত্য, এই মামলার রায় দেয়া হয়েছে মাত্র সাতদিনের মাঝেই। গত ১৯ তারিখ এই রায় দেয়া হয়। দেশে বিচার ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করা এই মামলা নতুন দিনের সূচনা বলেই ধরে নিচ্ছেন অনেকেই।

কেন এই দীর্ঘসূত্রিতা?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন অপরাধ করা আসামীরা খুব দ্রুত আটক হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে তথ্য প্রমাণের অভাবও থাকে খুব কম। কিন্তু আসামী, তথ্যপ্রমাণ এমনকি প্রায় সবক্ষেত্রে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী থাকার পরেও এদেশে বিচার কাজে সময় লাগে খুবই বেশি। এর মূল কারণ হিসেবে আইন পেশায় নিয়োজিতদের আঙুল উঠেছে দুটো দিকে। প্রথমত মামলা জট। দ্বিতীয়ত বিচারক সংকট।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এদেশের বিচার ব্যবস্থায় ব্যাপক আকারে হস্তক্ষেপ করে। যার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বিচার আটকে থাকে। রাজনৈতিক প্রভাবে বিঘ্ন ঘটতে ঘটতে জমে যায় মামলার পাহাড়। ফলে খুব করে চাইলেও বিচার কাজ শেষ করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। সেই সাথে বিচারক সংকট তো আছেই।

মানুষ নাকি আশায় বাঁচে। সবকিছুরই একটা শুরু থাকে। বাগেরহাটের দ্রুত বিচার হয়ত বাংলাদেশের বিচারহীনতার শেষ দৃশ্য। বিচারের বাণী হয়ত কোন একদিন বাংলাদেশে নিভৃতে কাঁদবে না। মানুষ যতদিন থাকবে, ততদিন অপরাধ থাকবে, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু সেই বাস্তবতা এড়াবার উপায়ও বাংলাদেশ একদিন পাবে, এটুক প্রত্যাশায় আশা করি দোষের কিছু নেই।

লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *