বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে যত রহস্য1 min read
Reading Time: 5 minutesবারমুডা ট্রায়াঙ্গেল–রহস্যময় অন্তর্ধান, ইউএফও, এলিয়েন আর নানা উপকথা-রুপকথা নিয়ে ঢাকা একটি স্থান যা সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।বছরের পর বছর মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এর রহস্য। একে নিয়ে লেখা হয়েছে কনস্পিরেসি থিওরি, বই, কমিকস, বানানো হয়েছে সিনেমা।কিন্ত আসলেই আমরা কতটুকুইবা জানি এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর রহস্যের ব্যাপারে?
আজকে জানাবো বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর ব্যাপারে ১২টি দারুণ তথ্য।
১. বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল মায়ামি থেকে পুয়ের্তোরিকো পর্যন্ত বিস্তৃত, এবংসমুদ্রের ৪৪০,০০০বর্গমাইল জুড়ে রয়েছে । ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৭৫টি প্লেন এবং শত শত জাহাজ হারানোর অফিসিয়াল রেকর্ড রাখা আছে। গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে প্রচুর জাহাজ, প্লেন এবং মানুষ নিখোজ হয়ে যাবার কারণে একে ডেভিল’স ট্রায়াঙ্গেল বা শয়তানের ত্রিভুজও বলা হয়ে থাকে।
প্লেন বা জাহাজ এই ট্রায়াঙ্গেলে হারিয়ে গেলে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ট্রায়াঙ্গেল এর কাছেই গাল্ফ স্ট্রীম প্রবাহমান।তাই হারানো জাহাজ বা প্লেন সেই স্ট্রীমের কারণে নিখোজ এলাকা থেকে বয়ে চলে যায়।
হিসাব করে দেখা গেছে গত ১০০ বছরে প্রায় ১০০০ এর বেশি প্রাণহানি হয়েছে এই ট্রায়াঙ্গেলে। অবশ্য যতই এলিয়েন, সামুদ্রিক দানব বা সমুদ্রতলের হারানো জনপদ আটলান্টিস নিয়ে গুজব থাকুক না কেন, এটি তারপরেও পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্থান।
২. এই ট্রায়াঙ্গেলের ভেতরেই বাহামাস এর এন্ড্রোস দ্বীপে ইউএস নেভির AUTEC (Atlantic Undersea Test and Evaluation Center) রয়েছে।নেভি এখানে সাবমেরিন, সোনার এবংঅন্যান্য অস্ত্রাদি পরীক্ষা করে থাকে। কিন্ত মুখরোচক গুজব আছে এর ব্যাপারেও ।অনেকেই মনে করে এইট্রায়াঙ্গেলের ঘটনাবলীর পেছনে হয়ত এদেরই হাত রয়েছে। আবার অনেকের ধারণা আসলে তারা ট্রায়াঙ্গেলের সত্যতা উদ্ধারেই নিয়োজিত।
৩. পাইলট ব্রুস গেরন দাবি করেন এই ট্রায়াঙ্গেলে এক গুচ্ছ মেঘের মধ্য দিয়ে যাবার সময় তার ২৮ মিনিট হারিয়ে গেছে। সাথে তার প্লেনের যন্ত্রপাতিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বারমুডা থেকে মায়ামি যাবার তিন ঘন্টার রাস্তাও নাকি তিনি তিনভাগের একভাগ সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন!
কিন্ত বিজ্ঞান তা মানবে কেন। বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে আসলে গেরনের সাথে যা হয়েছে তাহলো খুবশক্তিশালী ঝড়ো হাওয়া।রোল ক্লাউড বলে একটি ব্যাপার আছে যা খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা।হয়তো সেসময় প্লেনের অনুকূলে খুব জোড়ে বাতাস বইছিল যা খুবই শক্তিশালী ছিল এবং এই বাতাসই প্লেনকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। এবং সেইসাথে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি বা অচল তড়িৎ এর কারণে যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।যদিও অবিশ্বাসীদের মন এত সহজে ভোলেনা। অনেকেই মনে করে কোন টাইমট্রাভেল এর ঘটনাই ঘটেছিল।
৪. বারমুডা নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনা ফ্লাইট ১৯ এর অন্তর্ধান। ১৯৪৫ এর ৫ নভেম্বর ইউএস নেভির ৫টি এভেঞ্জার টর্পেডো বম্বার প্লেন রাস্তা হারিয়ে ফেলে। ফ্লাইট১৯ নামের একটি উদ্ধার প্লেনকে পাঠানো হয় তাদের ফিরিয়ে আনতে।
এভেঞ্জার প্লেনগুলো দুপুর ২.৩০ এর দিকে বারমুডার আশেপাশে বোমানিক্ষেপ অনুশীলন করছিল। এরপর তারা পরবর্তী অনুশীলনের জন্য দক্ষিণে চলা শুরু করতেই ফ্লাইটলিডার লেফটেন্যান্ট চার্লস সিটেইলর, যিনিএকজন দক্ষ ও ঝানু অফিসার ছিলেন, জানালেন তাঁর কম্পাস কাজ করছেনা। হঠাৎ ভারী বর্ষণ আর বজ্রপাতের কারণে ফ্লাইট১৯ নিজেই রাস্তা হারিয়ে ফেলে।
ফ্লোরিডা কোস্টের কাছেই অবস্থানরত আরেক পাইলট তার রেডিওতে ফ্লাইট১৯ এর কথোপকথন শুনতে পায়। টেইলর তাকে জানায় তিনি ফোর্ট লডারডেল যেতে চান কিন্ত তার কম্পাস কাজ করছেনা এবং তার কোনো ধারণা নেই তিনি ফ্লোরিডার কোন জায়গায় অবস্থান করছেন। কিন্ত এটা অত্যন্ত অবিশ্বাস্য ব্যাপার, কেননা তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই বাহামাস দ্বীপপুঞ্জ পার করে গিয়েছিলেন। তার মানে তারা ইতিমধ্যেই শতশত মাইল দূরে চলে গিয়েছিলেন।এভঞ্জার প্লেনের পাইলটদের আদেশ করা হয়েছিল যেন তারা অস্তগামী সূর্যের দিকে আগাতে থাকেন। কিন্ত টেইলরের মনে বিশ্বাস হয়েছিল যে তারা শতশত মাইল দূরে গাল্ফ অফ মেক্সিকোর আশে পাশে চলে গিয়েছেন। তাই তিনি তার প্লেন উত্তর-পূর্বদিকে চালিয়ে ফ্লোরিডা খুঁজে বের করতে চাইছিলেন।
ফিউল শেষের দিকে চলে আসায় টেইলর তার পাইলটদের সমুদ্রেই ক্রাশল্যান্ডিং এর প্রস্তুতি নিতে বললেন। কিন্ত পাইলটদের মনে খটকা লাগায় তারা আরো এগিয়ে যেতে চাইলে রেডিও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নেভি সাথে সাথে তাদের খোঁজার জন্য একজোড়া PBM Mariner নৌকাপাঠায়।২০ মিনিট পরেই তাদের একটিতে আগুনলাগে এবং সেটিও হারিয়ে যায়। ধারণা করা হয় সেটিতে আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।পরবর্তীতে ৩০০ জাহাজ ও প্লেনের দ্বারা প্রায় ৩,০০,০০০বর্গমাইল খোঁজাখুজির পরও কোন প্লেনেরই সামান্যতম হদিসও পাওয়া যায়নি। না পাইলট, না প্লেন এমনকি না একটুকরো ভাঙ্গা অংশ।
তদন্ত বোর্ড ধারণা করে যে হয়তো বা টেইলর ভুল করে বাহামা দ্বীপপুঞ্জে চলে গিয়েছিলেন, যেটিকে ভুল করে ফ্লোরিডা ভাবছিলেন। কিন্ত সেক্ষত্রে প্রশ্ন থেকে যায়! কেনইবা তিনি তাঁর আসল অবস্থান থেকে শতশত মাইল দূরে চলে গেছেনব লেভাবছিলেন৷ একজন অভিজ্ঞ এবং পাকা পাইলট কেন এত বড় ভুল করবেন।প্রত্যক্ষদর্শীরা এও দাবীকরেন, মিশনে যাবার পূর্বে নাকি টেইলর বলেছিলন তাঁর এই মিশনে যাবার ইচ্ছে নেই। আবার এভেঞ্জার প্লেনের পাইলটরাই বা কেন সবাই একযোগে উদ্ধার প্লেনের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি কাজে লাগাতে পারলনা, এমনকি তারা কোন মেসেজও শুনতেপায়নি! এসব প্রশ্নের নেই কোন উত্তর।
১৯৯১ সালে গুপ্তধন শিকারীরা দাবি করেছিল তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন ৫টি এভেঞ্জার প্লেনের কিছু অংশ খুঁজে পেয়েছে।যদিও পরে দেখা গেছে এদের কোনটিই সেই হারিয়ে যাওয়া প্লেনের অংশ নয়।
৫. বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে প্রথম অতি প্রাকৃত ধারণা পাওয়া যায় ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর জার্নাল থেকে।তিনি লিখেছেন যে তিনি আজব কিছু আগুনের গোলা দেখেছিলেন আকাশে এবং তাঁর কম্পাসও কাজ করছিল না।
৬. ১৯৬৪ সালে লেখক ভিনসেন্ট গ্যাডিস বারমুডা ট্রায়াঙ্গল কথাটির প্রথম ব্যবহার করেন।
৭. কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক থিওরিতে বলা হয়, হয়তোবা এখানে মিথেনের প্রভাব বেশি, যার ফলে জাহাজ, প্লেন বা অন্যান্য যানে আগুন ধরে যেতে পারে।
৮.দৈব বা অদৈব কারণেই হোক, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে সবচেয়ে ভয়ংকর ও অস্বাভাবিক ঝড়ের প্রকোপ দেখা যায় যারা কোন কারণ ছাড়াই তৈরি হয়ে যায়।
৯. ১৯১৮ সালের মার্চে ৫৪২ ফুট লম্বা জাহাজ ইউএসএস সাইক্লপস প্রায় ৩০০ মানুষ এবং ১০,০০০ টনম্যাঙ্গানিজ নিয়ে উধাও হয়ে যায় এই বারমুডায়। জাহাজটি ছিল সেইসময়ের সবচেয়ে আধুনিক ও সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন জাহাজ রেডিও সুবিধা থাকা সত্বেও কোন ধরনের সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠায়নি সাইক্লপস। এ ঘটনায় প্রেসিডেন্ট উড্রোউইলসন বলেছিলেন, শুধুমাত্র সমুদ্র আর ঈশ্বরই জানে সাইক্লপসের কি হয়েছে।পরবর্তীতে সাইক্লপসের আরো দুটি সঙ্গী জাহাজ ও একি রাস্তায় হারিয়ে গিয়েছিল।
১০. ১৯৪০ এর গোড়ার দিকে, ব্রিটিশ সাউথ আমেরিকান এয়ার ওয়েজের স্টারটাইগার এবংস্টার এরিয়েল এবং ব্রিটিশরয়াল এয়ার ওয়েজে ডাগলাস ডিসি-৩বিমান কোন রকম কারণ ছাড়াই একেবারে উধাও হয়ে যায়, যার নামনিশানা ও পাওয়া যায়নি। এরা ছিল সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা প্রযুক্তির প্লেন। আশ্চর্যজনকভাবে এরাও কোনরকম সাহায্যবার্তা পাঠায়নি!
১১. ২০০১ সালে কিউবা সরকারের হয়ে কাজ করা একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ও তার স্বামী কিউবার আশে পাশের সমুদ্রেরতলদেশ পর্যবেক্ষণ কালে পিরামিড সদৃশ পাথর পান। পরবর্তীতে ROV দ্বারা তদন্তে আরো গ্রানাইটের মত পাথর পাওয়া যায়, সেগুলো এমনভাবে সাজানো ছিল যেন মনে হয় ইচ্ছাকৃতভাবে কোন আকৃতি দেবার জন্যই এদের একটির উপর আরেকটি রাখা হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন এই আকৃতিগুলো পানির যে গভীরতায় আছে সেখানে যেতে কমপক্ষে ৫০,০০০ বছর লেগেছে। কিন্ত ৫০,০০০ বছর আগের সভ্যতা এর নিখুঁত আর্কিটেকচারাল জ্ঞান কোথায়পেল তার উত্তর কারো জানা নেই বিজ্ঞানীরা না মানলেও অনেকেই বিশ্বাস করে এটিই সেই হারানো শহর যার কথা মায়ান পুরানে উল্লেখ আছে। ট্রায়াঙ্গলের মধেই ‘বিমিনি রোড’ নামক পাথর দিয়ে বানানো রাস্তার মত আকৃতি পাওয়া গেছে যা হারানো শহর আটলান্টিস নিয়ে মানুষের ধারণাকে উস্কে দেয়।
আসলেই কি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল হারানো শহর আটলান্টিসকে ধারণ করে নাকি এটি একটি অতি প্রাকৃতস্থান, নাকি শুধুই একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগপূর্ণ স্থান তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। তবে এখনো এটি মানুষের কাছে রহস্যেরই ভান্ডার।