বেশ অনেকদিন থেকেই আলোচনা ছিল, নামটি নিয়ে। নামটি হলো, দ্যা ট্রু আমেরিকান বা সত্যিকারের আমেরিকান। আর সত্যিকারের আমেরিকান কে, যখনই এই প্রশ্ন আসে তখনই নাম চলে আসে বাংলাদেশী রইচ ভুইয়ার। এই নামটি , নিউইয়র্ক টাইমস এর বেস্ট সেলার বা সর্বাধিক বিক্রিত একটি বই এর নাম। দ্য ট্রু আমেরিকান; মার্ডার এন্ড মার্সি ইন টেক্সাস’ নামের এই বইটি লেখা হয়েছে রইচ ভুইয়ার আত্মত্যাগকে কেন্দ্র করেই। লিখেছেন, আনান্দ গ্রিধারা। তার সেই বইকে কেন্দ্র করেই বিশ্বখ্যাত পরিচালক পাবলো ল্যারিয়ান নির্মান করছেন দ্যা ট্রু আমেরিকান। এই ছবির প্রাথমিক ট্রেইলার এরি মধ্যে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে এটি মুক্তি পাওয়ার কথা।
কে এই রইচ ভুইয়া? রইচ ভুইয়া একজন বাংলাদেশী অভিবাসী, যিনি ৯/১১ পরবর্তী মুসলিম বিদ্বেষ এর স্বীকার একজন অভিবাসী। পড়াশুনার জন্য এসেছিলেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে, কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষ করে আর ফিরে যাননি দেশে। মাইক্রোসফট এর স্বীকৃতিপ্রাস্ত সিস্টেম ইন্জিনিয়ার, আর বাংলাদেশে বিমান চালনায় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত রইচ ভুইয়ার বয়স তখন ২৭ বছর। টেক্সাসের ডালাস মেট্রোপ্লেক্স শপিং মলে তিনি স্বল্পমুল্যের ডলার সপ এ চাকুরী করতেন।
টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঠিক ১০ দিন পরে, মার্ক স্টরম্যান নামক একজন হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট, যিনি আরবের নাগরিকদের নিধন করার সংকল্প নিয়ে মানুষ হত্যায় নেমে পড়েন। স্টরম্যানের বন্দুক এলোপাথাড়ি আঘাত হানে রইচ এর কর্মস্থলে। রইচ ভুয়ার চোখমুখে গুলি লাগে, তার সাথে থাকা আরো ৩ জন মানুষ ঐ গুলিতে মারা যান। কিন্ত ভাগ্যক্রমে বেচে যান রইচ ভুইয়া। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে এই হত্যাকান্ড তখন একটি বহুল আলোচিত বিষয় ছিল। রইচ ভুইয়া, সেই সময় হাসপাতালের বিছানায় থেকে, বার বার আকুতি করতে থাকেন যেন, স্টরম্যানকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। কেননা, রইচ বলছিলেন, অপরাধী হয়তো না বুঝেই হত্যাকান্ড চালাতে উদ্যত হয়েছে, তার শুভবুদ্ধি উদয় হবে, মাফ করে দিলে।
রইচের সেই ক্ষমার বানী ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সব গনমাধ্যমের পাতায় পাতায়। খুব অল্প সময়ের রইচ ভুইয়া বনে যান, এক সত্যিকারের আমেরিকান হৃদয়ের মানুষ হিসেবে। সেই থেকে রইচ ভুইয়া নামটি- দ্যা ট্রু আমেরিকান নামেই পরিচিত। তবে, সেটির পূর্নতা পায় ২০১৪ সালে তাকে নিয়ে লেখা বই এর কারনে। এখন সেটি সিনেমায় রুপান্তরিত হচ্ছে যার কাজ চলছে গত কয়েক বছর ধরেই।
রইচকে আঘাতকারীর ভুমিকায় মার্ক রাফালো অভিনয় করছেন। রইচ এর ভুমিকায় অভিনয় করছেন, পাকিস্থানী বংশোদ্ভুত হলিউড অভিনেতা কুমেল নান্জিয়ানি। নারী চরিত্রে এ্যামি এ্যাডামস।
রইচ ভুইয়ার সাথে এই লেখকের কথা হয়েছিল ২ বছর আগে। তিনি যখন ক্যালিফোর্নিয়ার বাংলাদেশ ডে প্যারেড এ অংশ নিতে এসেছিলেন তখন। অনুষ্ঠান শেষে রইচ ভুইয়ার সাথে একটি টিভি ইন্টারভিউ এ রইচ ভুইয়া বলেছিলেন, তার ক্ষমার কথা, ত্যাগের কথা এবং মহত্বের কথা। নিজের জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে থেকেও রইচ ভুইয়া সার্বক্ষনিক ভাবে চেয়েছিলেন, যেন শাস্তি না হয় হামলাকারীর।
‘আমার এখনও কপালের সামনের দিকে ডান পাশটা অবশ থাকে। এই যে একটি চোখ, এটিতে কিন্ত আমি দেখিনা। মাথার এই যে চামড়া দেখছেন, সেটা কিন্ত আমার শরীরের অন্য জায়গা থেকে কেটে এনে বসানো। আমি মনে করি, এটা আমার দ্বিত্বীয় জীবন। আমার সাথে যাকে হামলা করা হয়েছিল, সে কিন্ত মরে গেছে। স্রষ্ঠা আমাকে বাচিয়ে রেখেছে, নিশ্চয়ই কোন ভাল কাজে, তাইনা? আমি সেটাই করার চেষ্টা করে যাচ্চি’- বলছিলেন রইচ ভুইয়া।
সেই চেষ্টা থেকেই তিনি গড়ে তোলেন তার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ওয়াল্ড উইদাউট হেইট বা ঘৃনামুক্ত বিশ্ব। বিশ্বের নানান জায়গায় তিনি মানবতার কথা, হেইট ক্রাইম বা ঘৃনাপ্রসুত বিদ্বেষ কমানোর কথা বলেন, ভাতৃত্ববোধ আর ক্ষমার চর্চা করতে অনুপ্রানিত করেন। ফেসবুক বা গুগলে রইচ ভুইয়া যুক্তরাষ্ট্রের খুবই পরিচিত একটি নাম।
যেই ঘৃনা বিরোধী প্রচারণা রইচকে সত্যিকারের আমেরিকান হিসেবে খেতাব এনে দিয়েছে, বিশ্বের মনে জায়গা করে দিয়েছে বাংলাদেশের মহানুভবতার নাম, সেই ঘৃনাবোধ আবার সজাগ হয়েছে গোটা যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে।
সাহেদ আলম : সম্পাদক, বাংলা ইনফো টিউব
আরও দেখুন- কিভাবে আসা যায় আমেরিকায়? আমেরিকার স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা কি?