বলিভিয়ার বামপন্থি প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস তীব্র আন্দোলনের মুখে নভেম্বরের দশ তারিখ ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে মেক্সিকোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। পুরো দেশ জুড়ে তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মাধ্যমেই মূলত তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
বলিভিয়ার গত নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি দুটি কারণে জনগণের কাছে ছিল প্রশ্নবিদ্ধ! প্রথমত মোরালেস সংবিধান অমান্য করেই ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। কেননা বলিভিয়ার সংবিধান কাউকে টানা চতুর্থ বারের মতো নির্বাচনে লড়ার অধিকার দেয় না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশন এবং তদন্ত কমিটি এই নির্বাচনে কারচুপির যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছে। উল্লেখ্য যে, বলিভিয়ায় টানা চতুর্থবার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করার কোন সু্যোগ নেই। কিন্তু মোরালেস একটানা চতুর্থ বারের মত জাতীয় নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার জন্য গণ ভোটের মাধ্যমে সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনেন।
মোরালেস মেক্সিকোতে আশ্রয় নিলেও বলিভিয়ার মাটিতে আন্দোলন এখনো চলমান রয়েছে। কারণ সেদেশের জনগণ এখন নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার আদায় করতে চাইছেন, যেই অধিকার বিগত ১৩ বছর ধরে মোরালেস তিলে তিলে সবার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন।
ক্ষমতার গদিতে মোরালেস
২০০৫ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে মোরালেস বলিভিয়ার ক্ষমতার আসনে বসেন। তিনি ছিলেন বলিভিয়ার প্রথম আদিবাসী প্রেসিডেন্ট। ২০০০ সালের গোঁড়ার দিকে প্রাকৃতিক গ্যাস বেসরকারিকরণ নিয়ে বলিভিয়ায় ব্যাপক আকারে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং তৎকালীন সময়ে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন মোরালেস এবং তার সমর্থকেরা।
এরপর ২০০৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর মোরালেস বলিভিয়ার অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধশালী করার জন্য গ্যাস শিল্পকে জাতীয়করণ করে দেন। এছাড়া এই সময়ে তিনি অন্যান্য অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোকে অর্থায়নে সহায়তা করেছিলেন। ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান ঘোচানো এবং সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করাই ছিল এই পদক্ষেপগুলোর উদ্দেশ্য।
তিনি বলিভিয়ার গ্রামীণ উন্নয়নের জন্যও বেশ কিছু প্রকল্প শুরু করেছিলেন। তারমধ্যে শিক্ষার প্রসার এবং কৃষকদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান ছিল অন্যতম। বিশ্ব ব্যাংকের মতে মোরালেসের আমলে বলিভিয়াতে দারিদ্র ও বৈষম্য অনেকখানি হ্রাস পেয়েছিল ।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোরালেস সংবিধানে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই পরিবর্তনগুলোর মাধ্যমে মোরালেস চেয়েছিলেন প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো যাতে করে পানি, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং আবাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সমান অধিকার পায়। এই ধরনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোরালেস বিশ্বের অন্যতম একটি সামাজিক সংবিধান তৈরি করেছিলেন, যেটা কি না নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। উদাহরণ স্বরূপ আরো বলা যেতে পারে, তিনি ৩৯ টি আদিবাসী ভাষাকে সরকারি ভাবে স্বীকৃতিও দিয়েছিলেন। এছাড়াও এই সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে আরো জোরালো করার চেষ্টা চালিয়েছেন। এমনকি বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ের আইনসভায় এখন আদিবাসী প্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত আসনও রয়েছে।
নিজের আদর্শ থেকে মোরালেসের বিচ্যুতি
এত সব ভালো উদ্যোগে মোরালেসের প্রশংসনীয় ভূমিকা থাকলেও সময়ের সাথে সাথে নিজেকে নানা বিতর্কে জড়িয়ে ফেলেন তিনি। তিনি তার নিজের তৈরি আদর্শ ভুলে গিয়ে নিজের ক্ষমতার দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়া শুরু করেন। এমনকি তিনি আদিবাসীদের একটি পবিত্র ভূমির উপর দিয়েই রাস্তা তৈরি করার ব্যাপারে মতামত প্রকাশ করেছিলেন। যা কি না আদিবাসীদের মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে পরবর্তীতে চিহ্নিত করা হয়।
নিজের ক্ষমতার মেয়াদের সীমা বৃদ্ধি করার জন্য তিনি ২০১৬ সালের দিকে একটি গণভোট নিয়েছিলেন, যাতে করে তিনি চতুর্থ বারের মত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে কারণ করতে পারেন। তবে সেই গণভোটে তিনি হেরে যাওয়াতে বস্তুত বোঝা যাচ্ছিল যে তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।
তবে অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি আদালতের রায়ের মাধ্যমে পুনরায় রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ক্ষমতার মোহে নিজেকে হারিয়ে বসা মোরালেস যে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই একই ধরনের আরেক আন্দোলনের মাধ্যমেই ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার থাকলেও আন্দোলন চলমান
মোরলেস পদত্যাগ করলেও বলিভিয়াতে আন্দোলন থেমে নেই। মোরালেসের যেমন বিরোধী পক্ষ রয়েছে ঠিক তেমনিই এখনো তার সমর্থকরা রাজপথে সচল। আবার অনেকেই মনে করেন মোরালেস মূলত সামরিক বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের কারনেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বলিভিয়ার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দাবী মোরালেসের নির্দেশনা মোতাবেকই তার সমর্থকরা এখনো রাজপথে বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজমান রেখেছে। ক্ষমতার কিছুটা রদবদল ঘটে অন্তর্বর্তী সরকার আসলেও এখনো আইনসভায় মোরালেসের এমএএস পার্টি সবচাইতে বেশি আসন দখল করে আছে।
সর্বোপরি, এখন একটাই উদ্বেগ- আগামীতে কি হতে যাচ্ছে বলিভিয়ায়? দেশীয় রাজনৈতিক মনোভাবগুলোর দ্বৈরথ চলতেই থাকবে হয়ত, যতক্ষণ না পর্যন্ত নতুন করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে কেউ একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।