বিনোদন

বং জুন-হোর সাম্যের পৃথিবী1 min read

ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০ 7 min read

author:

বং জুন-হোর সাম্যের পৃথিবী1 min read

Reading Time: 7 minutes

পৃথিবী তো রাতারাতি বদলে যাবেনা, কিন্তু আমি চাই অল্প হলেও যেনপ্যারাসাইটমানুষকে আন্দোলিত করতে পারে।

গোটা হলজুড়ে তখনও করতালির তুমুল আওয়াজ, অথচ ব্যাক স্টেজে হাঁটু ভেঙে বসে আছেন বং জুনহো। অস্কারের বিরানব্বইয়ের বছরের ইতিহাস একরাতে দুমড়ে ফেলেছেন যেন বিশ্বাসের ঝুড়িতেই কুলোচ্ছেনা। ডার্ক কমেডি ঘরানারপ্যারাসাইটদিয়ে তিনি ইতিহাসে প্রথম কোরীয় তথা এশিয় পরিচালক হিসেবে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা চিত্রনাট্য সেরা আন্তর্জাতিক ফিচার ফিল্মের অস্কার জয় করেছেন 

আমার হলো শুরু

বং জুনহোর জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যবিত্ত পরিবারে, ১৯৬৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। বাবা বং সাংগুন ছিলেন গ্রাফিক ডিজাইনার অধ্যাপক আর মা পার্ক ইয়ং ছিলেন পুরোদস্তুর গৃহিণী। তবে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহটা এসেছে দাদা পার্ক তায়েনের সূত্রেই। ঔপনিবেশিক কোরিয়ায় জনপ্রিয় লেখক ছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে ইওনসেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রি নিলেও মন পড়েছিল সিনেমার জগতে। নব্বইয়ের প্রথমে তাই বন্ধুদের নিয়েইয়েলো ডোরনামক ক্লাবও খুলে ফেলেন। সেখান থেকেই স্বল্পদৈর্ঘ্যের স্টপমোশন ছবিলুকিং ফর প্যারাডাইজহোয়াইট ম্যানতৈরি করেন।

কোরিয়ান একাডেমী অফ ফিল্ম আর্টসে দুই বছরের পাট চুকিয়েমেমোরি উইদিন দ্য ফ্রেমইনকোহেরেন্সনির্মাণ করেন যা ভ্যানকুভার হং কং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। এরপরের বছরগুলোয় সহপাঠীদের সাথে একত্রে বেশ কিছু স্বল্প দৈর্ঘ্য ছবি তৈরি করলেও ১৯৯৬ সালেরসেভেন রিজন্স হোয়াই বিয়ার ইজ বেটার দ্যান লাভারএর মাধ্যমে চিত্রনাট্যকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।৯৭ ৯৯ হোটেল ক্যাকটাসএবংফ্যানটম দ্য সাবমেরিনদুই চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করেন। 

তবে প্রথম একক পরিচালনার ভার পান ২০০০ সালেরবারকিং ডগ নেভার বাইটসএ। সমালোচকের দৃষ্টিতে বাহবা পেলেও দর্শক টানেনি তা। যদিও হংকং স্ল্যামড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার অর্জন করে এটি। দ্বিতীয় ছবিমেমোরিজ অফ মার্ডারদিয়েই নিজের জাত সমস্ত মহলে বুঝিয়ে দেন প্রথম। ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ক্লাসিক এই সিরিয়াল হত্যার ছবি ছিল আশির দশকের সত্য ঘটনাশ্রয়ী। প্রায় বিশ বছর আগের মামলার পুঁথি পত্র জোগাড়টাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। গ্র্যান্ড বেলে সেরা ছবি, পরিচালক, অভিনেতাসহ চারটি পুরস্কার জেতে এটি। এর কল্যাণেই আসলে সর্ব সাধারণ চলচ্চিত্র প্রেমিদের নজরে আসেন জুন।ইনফ্লুয়েঞ্জা’(২০০৪), ‘টুয়েন্টিডিফাই’,’সিংক এন্ড রাইজ’ (২০০৪),‘টোকিও’ (২০০৮), ‘সেন্স অফ হোম’ (২০১১) সহ বেশ কিছু অমনিবাস চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তিনি। মাঝেসি ফগ’ (২০১৪), ‘এন্টার্কটিক জার্নাল’ (২০০৫) চিত্রনাট্যকার হিসেবে ছিলেন। 

২০০৬ সালের আরেক সফল প্রজেক্ট কল্পবিজ্ঞান হররে মিশেলদ্য হোস্ট ২০০৯ সালে আবার দৃষ্টি কাড়েনমাদারদিয়ে। মানসিক প্রতিবন্ধী এক তরুণ তার মায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রামই ছিল এর উপজীব্য। ২০১৩ সালে আলোচিতস্নো পিয়ার্সার ২০১৭ সালে নেটফ্লিক্সের প্রযোজনায় মুক্তি পায়ওকজা সামান্য শূকর থেকেই আস্ত একটা ছবির ছক এঁকে নিয়েছিল জুন।

সহজাত যাপনের কথা

বং জুনের প্রতি ছবিতেই সাধারণ মানুষের বেদনার একটা ছাপ থাকে।বারকিং ডগস ত্যক্ত অধ্যাপক, ‘মাদার দারিদ্র্য ক্লিষ্ট মায়ের সন্তান হত্যার প্রচেষ্টা, ‘দ্য হোস্টেখামখেয়ালি কর্পোরেট বিজ্ঞানের বলি হওয়া জনতা, ‘ওকজা পুঁজিবাদের চক্রে প্রাণীর প্রতি সহিংসতা, এমনকিমেমোরিজ অফ মার্ডারএও ছিল সেই সাধারণ জীবনের ছাঁচ। সিনেমার শেষ অঙ্কে নৃশংস সিরিয়াল কিলারের খোঁজে মরিয়া পার্ক দুমানের সেই নিরাশ, হতভম্ব দৃষ্টির কথা মনে আছে? সাধারণ লোকও যে ভয়ংকর হতে পারে, এমন বিপরীত ধারণাও পাওয়া যায় তাঁর সিনেমায়। 

তবে সর্বশেষ দুটি কাজস্নোপিয়ারসারপ্যারাসাইটমোটা কলমে দেখিয়েছে শ্রেণি পার্থক্যকে।স্নোপিয়ারসার এই অসাম্যের চিত্রায়ন ছিল Horizontal বা সরলরৈখিক। কিন্তুপ্যারসাইটছিল Vertical 

ক্লাসিক সিরিয়াল কিলিং চলচ্চিত্র ‘মেমোরিজ অফ মার্ডার; Photo:IMDb

খুব সাধারণ জীবনযাপনেই বিশ্বাসী আমি। ধোঁয়া ওঠা কফি হাতে লিখে যাওয়ার প্রেরণা পাই খুব বেশি। আর মিশিও হাতে গোনা জনের সাথে।এইজন্যই হয়তো কানে পাম ডি অর জেতার পর কোরিয়ান বিমানবন্দরে বেশ অস্বস্তিতেই পড়েছিলেন তিনি। 

ব্যক্তিজীবনে নিজেকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্নই জুনহো। বলতে গেলে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই কাটে তীব্র উদ্বেগে। মনঃচিকিৎসকের বরাত দিয়ে বলেও দিলেন, ‘ আমার উদ্বেগের মাত্রাটা মাঝে মধ্যে এত বেড়ে যায় যে স্বাভাবিক সামাজিকতাও রক্ষা করতে পারিনা। এই আড়ষ্টতার একমাত্র ওষুধ চলচ্চিত্র। এই মাধ্যমটার প্রতি সত্যিই খুব কৃতজ্ঞ আমি।‘ 

কাজের ধরণ নিয়েও খুঁতখুঁতে বং। এর সাথে যোগ হয় চরম উৎকণ্ঠা। নিখুঁত চেষ্টার সাথে সাথে প্রতিটা কাজ নিয়ে ভীষণ চিন্তাও করেন তিনি। বিশদ বিবরণ নিয়েই মাঠে নামেন প্রতিবার। স্টোরি বোর্ডের প্রতি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেন। অনেকের মতে কাজ শেষে সেই স্টোরি বোর্ডকে গ্রাফিক উপন্যাস হিসেবেও চালিয়ে দেয়া যায়। তবে এও মানেন, প্রয়োজনে এর বাইরেও ক্যামেরা ধরতে বাধ্য হন পরিচালকেরা। তাঁর কাছে স্টোরি বোর্ড হীন চিত্রনাট্য মানে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় পথে নামার মতোই। 

স্নোপিয়ার্সার থেকে প্যারাসাইট

হলিউডে পাকাপাকি কাজ করার কোন পরিকল্পনা ছিলনা বং জুনের। কিন্তু ফরাসি গ্রাফিক উপন্যাস ‘Le Transperceneige’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েস্নোপিয়ার্সারএর কাজে হাত দিতেই মাথার কলকব্জায় যেন আরেক নিনাদ টের পেলেন। ২০১৩ সালের সেই সময়টাতেই শ্রেণি বৈষম্যের ব্যাপারে বিস্তর পড়াশোনা করেছিলেন, পাশাপাশি কলেজ জীবনে ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতাও ইন্ধন জুগিয়েছে পুরোদমে। তখন অঙ্কুরিত হয় ‘প্যারাসাইট’ চিন্তা। 

Snowpiercer- অসাম্যের নগ্ন উপস্থাপন; Photo:Medium

তবে ছবির পেছনে এর অন্যতম অভিনেতা সং কাং হোর ভূমিকা বিশাল। বং জুন টানা চার বছর ছবির গল্প নিয়ে ভাবলেও ২০১৭ সালেই পাতায় লেখার কথা ভাবেন। গল্পের সিংহভাগ লেখা হয় নির্মাণের আগের চার মাসে। চিত্রনাট্য নিয়ে সং কাং হোকে দেখাতেই সম্মতি জানান সং। উল্লেখ্য, এই কাং হোকে নিয়েইমেমোরিজ অফ মার্ডার’, ‘দ্য হোস্টস্নোপিয়ারসার’ –তিনটি সফল কাজ করেছেন জুন। মঞ্চাভিনেতা এক বন্ধুর তাগাদায় মঞ্চ নাটক হিসেবেই একে উপস্থাপনের কথা ভাবছিলেন। এর আগেওকজা পটভূমি ছিল কোরিয়ার পর্বতমালা থেকে মার্কিন মুলুকের ম্যানহাটন পর্যন্ত বিস্তৃত। সুতরাং মঞ্চের মাপা পিচে যে গল্প বলবেন,তার ধরণটা ভিন্ন হওয়ার দাবি ছিল তীব্র।তখনই মাথায় আসে ধনী দরিদ্র দুই পরিবারের ধারণা। কলেজ জীবনে অবস্থাশালী এক পরিবারের ছেলে মেয়েদের পড়াবার দায়িত্ব ছিল তাঁর। তখনই আসলে ধনবান জীবনটাকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পান। সেই বাড়িতে বন্ধুদের নিয়ে অনুপ্রবেশের চিন্তাটা তখন ফ্যান্টাসি হিসেবেই ডালপালা মেলেছিল।

কোরিয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সি জে এন্টারটেইনমেন্টের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছেপ্যারাসাইটআরস্নোপিয়ার্সার অন্যদিকে হলিউডি ছবিওকজা ছিল এরচেয়ে চারগুণ বাজেট। কম বাজেটের ক্ষেত্রে ছবির সূক্ষ্ম উপস্থাপনের দিকে নজর দেন জুন। পরবর্তী কাজের বুননে এখনই আটঘাট বাঁধছেন। আপাতত একটি কোরিয়ান অ্যাকশন থ্রিলার এবং সত্য ঘটনা অবলম্বী একটি ইংরেজি ছবির তৈরির কথা চলছে। 

প্যারাসাইট কেন সেরাদের সেরা?

প্যারাসাইটবা কোরীয় ভাষায়হিসেনচুংশব্দের অর্থ পরজীবী। পরজীবীর ধর্মই হলো সুস্থ সবল দেহে ঘর তুলে নীরবে রক্ত শুষে নেয়া। প্রথম প্রথম সেই পরজীবীর সূচালো থাবা টের পাওয়া না গেলেও ক্রমে সেই গ্রাস করে নেয় যাপিত দেহকে। এই সূত্রের সাথেই মিল রেখেপ্যারাসাইটএর গোড়াপত্তন। তবে শুরুতেই এর নামপ্যারাসাইটছিল না। ফরাসি শব্দদিক্যাল্কোমানিথেকেদিক্যালরাখাই ছিল প্রাথমিক পরিকল্পনা; যার অর্থমূল নকশার আদলে নকল নকশা আঁকা’- অর্থাৎ দূর থেকে এক মনে হলেও আসল আর নকলের প্রভেদ টের পাওয়া যায় নিকটবর্তী হলেই। 

২০১৯ এর ২১ মে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শিত হয় এটি। সারাবিশ্বে মুক্তি পায় মে মাসের ৩০ তারিখ। ছবির গল্প সাদামাটা ভাবে বলতে গেলেদুই পরিবারের আন্তঃসম্পর্ক আর পরজীবী কাঠামোই নির্দেশ করে। তবে তলিয়ে দেখলে মেলে একরাশ রত্নভাণ্ডার। বং জুনহো দক্ষিণ কোরিয়া তথা গোটা বিশ্বেই চলমান শ্রেণি বৈষম্যের নগ্ন রূপটা দেখিয়ে দিয়েছেন সেলুলয়েডের পাতায়।  

অধিকাংশ ছবির ক্ষেত্রেই গল্প তিন ভাগে বিভক্ত থাকে।প্যারাসাইটএর বেলায় এর খানিকটা ব্যত্যয় চোখে পড়বে। মূলত এখানে দুইটি অংশ জুড়ে দাঁড় করা হয়েছে গোটা ট্র্যাজিকাল হরর। প্রথম অংশে ছিল কিম পরিবারেরর বেজমেন্ট যাপন থেকে আরম্ভ করে পার্ক পরিবারে অনুপ্রবেশের সাফল্য পর্যন্ত। কিন্তু এর পরের অংশেই পুরো উল্টে যায় কাহিনি। পার্ক পরিবারের বেজমেন্টে দীর্ঘদিন বন্দি গুনসের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে আরেক অন্ধকার আবর্তের পরিচয় পায় দর্শক।মাত্র তিন বিট দশ মিনিটে প্লট বদলে হররে পরিণত হয় তা। সাসপেন্স অপরাধের মূলে ঘুণে ধরা সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের তীক্ষ্ণতার জন্যই ভেঙে যায় কিম পার্ক পরিবার। প্রবল চেষ্টার পরেও দারিদ্র্যের ঘ্রাণ দেহ থেকে মুছতে পারেনা কিমরা। পরিণতিতে আকস্মিক ঘটনায় খুন হয় পার্ক দং ইক কিম কিজং। 

প্রশ্ন হচ্ছে, ছবিতে ভিলেন কে? পার্ক পরিবার না কিম পরিবার? নাকি সামাজিক বৈষম্য? নাকি পরিবেশ অথবা স্বয়ং ঈশ্বর? দুই ঘণ্টা বারো মিনিট শেষে দর্শকের মনে এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খেয়েছি বেশি। সরাসরি এর কাহিনীকার জুনকে প্রশ্ন করতেই হেসে ওঠেন তিনি। ‘সত্যি বলতে কেউই ভিলেন নয় এখানে। কিন্তু তবুও মনে হবে, এত বীভৎস পরিণতির কারণ কী? আমাদের চারপাশের প্রতিটা লোকের মাঝেই ভালো মন্দ আছে। পরিস্থিতি ও সময় আমাদের বাধ্য করে একেক রূপ প্রকাশ করতে।‘

‘প্যারাসাইট’ এ জুনের পছন্দের চরিত্র কিম কি-উ; Photo: The Guardian

সিনেমার সমস্তটা জুড়েই ছিল শিল্পের কারিগরি। প্রথম দৃশ্যে কিম কি রুপী চই শিকের উপর রোদের নিবেদনের অর্থ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করেও অবস্থা উন্নতির কথা ভাবতে পারতো কিম পরিবার। ফ্রি ওয়াইফাইয়ের জন্য বেপরোয়া দুই ভাইবোনের কর্মকাণ্ডই তখন বুঝিয়ে দেয়, মরিয়া হয়েই সব আদায় করে নিতে চায় তারা।

এরপরের দৃশ্যেই কিউয়ের বন্ধু মিনহিউকের দেয়ামেটাফোরিক ল্যান্ডস্কেপউপহার অল্পক্ষণেই বদলে দেয় ভবিষ্যৎ। কিউয়ের প্রবেশ ঘটে ধনবান পার্ক পরিবারে। ক্রমেই পরিকল্পিতভাবে বেকার কিম পরিবার জায়গা করে নেয় পার্কদের প্রাসাদোপম ঘরে। এক্ষেত্রে প্রায় প্রতি দৃশ্যেই দুই শ্রেণির মধ্যকার বিভেদটা স্পষ্ট দেখিয়েছেন পরিচালক। খেয়াল করলেই দেখবেন, কিম পরিবারের সদস্য পার্ক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অধিকাংশ দৃশ্যেই একটা সরলরেখা আলাদা করে রেখেছে তাদের। সিঁড়ির ব্যবহারও ছিল রূপক। উপরে ওঠার মাধ্যমে উচ্চশ্রেণি বন্যার দৃশ্যে নামার মধ্য দিয়ে আকস্মিক ভূপতনের দিকে নির্দেশ করা হয়েছে।

সিনেমাটোগ্রাফি সম্পাদনাতেও ছিল তুখোড় প্রচেষ্টা। পুরনো গৃহকর্মীকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অপসারণের দৃশ্যটি মোট আট মন্টেজের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেপ্যারাসাইট অপরদিকে বিত্তশালী পার্ক পরিবারের সম্পদ প্রদর্শনেও আশ্রয় নিয়েছেন রূপকের। সরাসরি অর্থ বিত্ত না দেখালেও তাদের কর্ম, পরিকল্পনা, বেহিসেবি খরচ আর লোক দেখানো ঐশ্বর্যের মাধ্যমে পরিচালক দেখিয়েছেন কোরীয় তথা পুরো বিশ্বেই বৈষম্য এখনো প্রকট। পৃথিবীর মুষ্টিমেয় লোকের হাতেই যে সম্পদের পাহাড় সেটা নির্দেশ করলেও পার্ক দং ইকের(লি সুন কিউন) প্রতিষ্ঠানের নাম ‘Another Brick’ দিয়ে পরিচালক বোঝান পার্ক শুধুমাত্র কর্পোরেট দাসত্বের এক উদাহরণ মাত্র। এছাড়াও বেজমেন্টের নোংরা পরিবেশ আর গোপনীয়তার অভাবকে দরিদ্র জীবনেরই অংশ হিসেবে দেখান পরিচালক। অথচ অন্যপাশে বৈভবসিক্ত প্রাসাদ যেন অনেকটাই নিঃসঙ্গ আর জীবন্ত।

সেট নকশায় লি জাহুনের দলকে বেশ শ্রম দিতে হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কিম পরিবারের এলাকাটা ছিল পরিত্যক্ত এক এলাকা। ফলে বেশ ঢালাওভাবে সাজাতে হয়েছে তাদের। বন্যার দৃশ্যে আস্ত পানির ট্যাংকই সাবাড় করেছে সেটা। 

.৩৫: অনুপাতে রাখা ক্যামেরার সুবাদে পার্ক প্রাসাদের ঘরগুলোকে সেভাবেই সাজিয়েছে সেট ডিজাইনার দল। উচ্চতার চাইতে ঘরগুলোর অতিরিক্ত গভীরতার মাধ্যমে পরিচালক বুঝিয়েছেন, শ্রেণিগত উচ্চতা আপাত দর্শনে কম মনে হলেও এর গভীরতা অনেক। ঠাট্টাচ্ছলে বলেনসবাই বলছে আমি ইতিহাস তৈরি করে ফেলেছি। অথচ আমি এতসব ভেবে কাজ করিনি। স্রেফ একটা সিনেমাই বানিয়েছি।‘ নিখুঁত সিনেমাটোগ্রাফির যোগ্য সঙ্গী ছিল জুং জা-ইলের সুরারোপ। 

অস্কার হাতে Parasite- এরকলাকুশলীরা; Hollywood Reporter

দুচোখ মেলে শেখা

সিনেমার ক্ষেত্রে সীমারেখার ভাবনাটা একেবারেই আনতে চাননা অস্কারজয়ী এই পরিচালক। শুধু নিজস্ব ধারা কিংবা ভিনদেশি ছবির ট্যাগ লাগিয়ে আলাদা করতে নারাজ তিনি। তাঁর মতে, সব ছবিরই স্বকীয় একটা লাবণ্য আছে। বিশ্ব নাগরিক হিসেবে যে কেউ যেকোনো ছবিতে বুঁদ হতেই পারেন। 

নিজের ছবি সম্পর্কে বলেন, ‘আমার ছবিতে তিনটি উপাদান আপনি পাবেনই- ভয়, উদ্বেগ আর হাস্যরস। তবে এই রসিকতা কিন্তু একেবারে নিটোল নয়। হাসতে হাসতেই গা শিরশিরিয়ে উঠবে আপনার।আতংকে!’

হলিউডে বেশ সময় ধরে আনাগোনা থাকলেও এর আঁচ গায়ে লাগাননি তিনি। ‘Okja’, ‘Snowpiercer’ এর মতো সফল হলিউডি ছবির পরেও নিজ নিয়মের বলয়েই নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চান। নিজের উদ্বেগটাও লুকিয়ে রাখতে চাননা। ইন্ডিওয়ারে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান শুধু উদ্বেগ নিয়েই দুইশো পর্বের টেলিভিশন শো তৈরি করতে পারবেন তিনি। 

প্রসঙ্গঃ সিনেমা 

বং জুনহোর অনুপ্রেরণার মূলে আছেন কিংবদন্তী পরিচালক আলফ্রেড হিচকক। হরর ঘরানার সমার্থক হিচককের অনুসারী হিসেবে নিজেকে দাবি করেন জুন।প্যারাসাইট যদি কোন ছবির প্রভাব থেকে থাকে সেটা প্রথমতসাইকোর। ১৯৬০ এর এই ছবি বারবার দেখার কারণ একটাই, বেটসের বাড়িটা। মোটেলের চাইতে ওই বাড়িটাই বেশি আকর্ষণীয় লেগেছে আমার। আস্ত বাড়িটাই একটা তীক্ষ্ণ চরিত্র ছিল। এছাড়াদ্য হাউসমেইড প্রভাবিত করেছে আমাকে।

জাপানি উপনিবেশের করাল হাত থেকে মুক্তির পর প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়েছিলেন কোরিয়ান চলচ্চিত্রকারেরা। মাঝে সরকারের কড়াকড়ি, বিভাজন নানা সময় পথভ্রষ্ট করলেও আজকের কোরিয়ান সিনেমা বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম বলিষ্ঠ কণ্ঠ। পাম ডিঅর, গোল্ডেন গ্লোব আর অস্কার জিতে সেই কণ্ঠে মণিহারই যেন পরালেন বং জুনহো। 

লেখক- সারাহ তামান্না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *