ফারাও সাম্রাজ্যের ১২তম সম্রাট তুতেনখামেনকে নিয়ে যতটা আলোচনা হয়েছে, সম্ভবত এতটা পাদপ্রদীপের আলো আর কেউ পাননি। অথচ এই তরুণ সম্রাটের সাম্রাজ্যকাল ছিল মাত্র ৯ বছর, খ্রিস্টপূর্ব ১৩৩২– ১৩২৩ সাল পর্যন্ত।
মৃত্যু নিয়েও রহস্য
তুতেনখামেনের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪১ অব্দে, মিশরের আমারনা নামক স্থানে। তাঁর পিতা ছিলেন আখেনয়াতেন। তুতেনখামেনের মমি পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হয়েছেন মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ১৮ মাত্র। তবে মৃত্যুর কারণ নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা, কেউ বলেন ছুরিকাঘাতে, কারো মতে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর বর্শার আঘাতে আবার কারো কারো মতে সাপের কামড় বা ম্যালেরিয়ার প্রভাবে। মৃত্যুর কারণ অনিশ্চিত হলেও তুতেনের মমিকৃত দেহে বেশ কিছু আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এই আঘাত মৃত্যুর আগেরও হতে পারে আবার মৃত্যুর পর তড়িঘড়ি মমিফিকেশনের জন্যও হতে পারে।
সমাধি আবিষ্কার
তুতেনখামেনের সমাধিসৌধ আবিষ্কৃত হয় ১৯২২ সালের ২৬ নভেম্বর, মৃত্যুর ৩০০০ বছর পর। প্রত্নতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার ও ধনকুবের লর্ড কারনারভানের চেষ্টায় বের হয় ভ্যালি অফ কিংসের এই স্থাপনাটি। তবে মিশরের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ১৯২৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি খোলা হয় তুতেনখামেনের চেম্বারটি।
সমাধিতে মমি ছাড়াও রয়েছে নানারকম দেয়ালচিত্র, যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র, নানারকম তৈজসপত্র এবং সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান অলংকার। তুতেনখামেনের মমিকৃত দেহটি তিনটি কফিনের ভেতর রাখা। এর মধ্যে ২টি কাঠের তৈরি যা আবার সোনার আস্তরণে মোড়া। আর আরেকটি পুরোপুরি সোনা দ্বারা নির্মিত। এই কফিনের আয়তন ১.৮৮ মিটার এবং ওজন ১১০ কেজি। আজকের দিনে এই কফিনের দাম কমসে কম ১ মিলিয়ন ডলার তো হতোই!
প্রচলিত আছে, এই তরুণ সম্রাটের সমাধিসৌধটি অভিশপ্ত। তাই যে বা যারা সম্রাটের ঘুম ভাঙাবে তার উপরই নেমে আসবে অভিশাপের কালো ছায়া। সেই অভিশাপের ফল সম্পর্কেই জেনে নিই এই লেখায়।
লর্ড কারনারভানকে দিয়ে শুরু
তুতেনখামেনের সমাধি খোলার ৫ মাসের মাথায় মৃত্যু হয় এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক লর্ড কারনারভানের। সামান্য একটি মশার কামড়ের বিষক্রিয়ায় মারা যান তিনি। কথিত আছে, তাঁর মৃত্যুর সময় ঘরের সব আলো আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারনারভানের ভাই অব্রে হার্বার্টও অন্ধত্ব বরণ করে মারা যান এর ৫ মাস পরেই।
অভিশপ্ত হাত
এরপরের ঘটনাটি ঘটে হাওয়ার্ড কার্টারের বন্ধু ইংহামের সাথে। স্রেফ পেপারওয়েট হিসেবেই একটি মমির হাত বন্ধুকে দিয়েছিলেন কার্টার। ব্রেসলেট পরিহিত সেই হাতের সাথে লেখা ছিল, ‘যে আমার দেহ সরাবে, তার উপর অভিশাপ নেমে আসবে।‘
এর পরপরই ইংহামের বাড়ি অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুনরায় নির্মাণের চেষ্টা করলে আকস্মিক বন্যায় ভেসে যায় তাও।
জর্জ জে গোল্ডের আকস্মিক মৃত্যু
আরেক আমেরিকান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জর্জ। তুতেন সমাধির আনুষ্ঠানিক উন্মুক্তের দিন উপস্থিত ছিলেন তিনিও। এর পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কয়েক মাস নিউমোনিয়ায় ভুগে মৃত্যুবরণ করেন।
ইভেলিন হোয়াইটের বিষণ্ণতা
তুতেনের সমাধি খননের সাথে যুক্ত ছিলেন ইভেলিন। কাজের প্রতি নিবেদিত হলেও একসময় ব্রিটিশ এই পুরাতাত্ত্বিককে গ্রাস করে অবসন্নতা। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৪ জন প্রত্নতাত্ত্বিকের মৃত্যু তাঁকে বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দেয়। ফলাফল– গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। মৃত্যুর সময় নোটে লিখে যান ‘ আমি এক প্রাচীন অভিশাপকে ডেকে এনেছি। তার জন্যই আমার এই দশা।‘
অ্যারন এম্বারের ম্যানুস্ক্রিপ্ট
এম্বার ছিলেন কারনারভানের বন্ধু। ১৯২৬ সালে আচমকাই তাঁর বাল্টিমোরের বাসায় আগুন লাগে। প্রথমে নিরাপদে বের হলেও ঘরের ভেতর থাকা নিজের বইয়ের ম্যানুস্ক্রিপ্ট বাঁচাতে গিয়ে পুড়ে মারা যান স্ত্রী–সন্তানসহ। ম্যানুস্ক্রিপ্টের নামটা কী জানেন? The Egyptian Book of the Dead.
আততায়ীর হাতে রিচার্ড বেথেল
বেথেলও ছিলেন কারনারভানের সাথে যুক্ত। কারনারভানের সেক্রেটারি বেথেলই কার্টারের পিছু পিছু প্রথম পা রেখেছিলেন তুতেন সমাধিতে। অনেকের মতো তাঁর মৃত্যুর অস্বাভাবিকতা অভিশাপের গল্পে ঢেলেছে ঘি। ১৯২৯ সালে লন্ডনের একটি ক্লাবে নিজস্ব রুমে কে বা কারা শ্বাসরোধে হত্যা করে তাঁকে।
রহস্যাবৃত এক্স রে
রেডিওলজিস্ট স্যার আর্কিবাল্ড ডগলাস রেইড মৃত্যু নিয়েও আছে রহস্য। মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের আগে তুতেনখামেনের মমির এক্স রে করেছিলেন তিনি। এর পরদিন থেকেই তীব্র অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ৩ দিন পর মারা যান।
প্রাচীন অভিশাপের কড়া
আরেক মিশরীয় পুরাতত্ত্ববিদের কাহিনীটা একটু চমকপ্রদ। তুতেন সমাধি খননের কাজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন হেনরি। এর কিছুদিন বাদেই ঘরে ফিরতেই তিনি দেখতে পান পোষা ক্যানরি পাখি দিয়ে পেটপুজা করে ফেলেছে এক কোবরার। আর কে না জানে এই কোবরাই হলো প্রাচীন মিশরীয় সম্রাটদের রক্ষাকবচের প্রতীক! সে যাত্রায় হেনরি বেঁচে গেলেও ১৯৩৫ সালে ফের এক কাজে মিশর গেলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয় তাঁর।
মূল প্রত্নতাত্ত্বিক কার্টার অবশ্য এসব অভিশাপকে তুড়ি মেরে বেঁচে ছিলেন ৬৪ বছর পর্যন্ত। লিম্ফোমা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও তাঁর জীবনে অন্য কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি।
অভিশাপ না গুজব?
তুতেনখামেনের সমাধি নিয়ে নানান জল্পনাকল্পনা থাকলেও অভিশাপের ব্যাপারে নিশ্চিত করেননি কেউই। মৃত্যুকালে কার্টারের বয়স ছিল ৬৪। তাঁর দলেরই আরেকজন রিচার্ড অ্যাডামসন বেঁচেছিলেন আরও ৬০ বছর অব্দি। অথচ টানা ৭ বছর ধরে তুতেনের চেম্বার পাহারাও দিয়েছেন তিনি। এক গবেষণায় দেখা যায় উল্লেখিত ব্যক্তিগণ ছাড়া তুতেনখামেনের সমাধি উন্মুক্তের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই ৭৩ বছরের বেশি সময় ধরে জীবিত ছিলেন।
মিশরীয় পুরাতত্ত্ববিদ র্যান্ডি ব্রায়ান্টের মতে, এই অভিশাপের গল্পটি পুরোটাই বানোয়াট। সম্ভবত কিছু সুবিধা পাওয়ার জন্যই পরিকল্পনামাফিক ছড়ানো হয়েছিল এই গুজব।
কার্টারই মূলত এই পরিকল্পনা করেন। ওই সময়ে এই আবিষ্কার ছিল সবচাইতে আলোচিত ঘটনা। তাই সাংবাদিকদের নজর কাড়তে এবং মমি চোরদের দূরে রাখতেই স্থানীয় ধারণায় রং চড়িয়ে এই গল্প ফাঁদেন তিনি। এর সাথে স্যার আরথার কোনান ডয়েলও তাঁর লেখায় নিয়ে আসেন এই অভিশাপের কথা। ফলে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেনি তখন।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল দিয়েছে আরও দারুণ তথ্য। ২০০২ সালে প্রকাশিত এই জার্নালে বলা হয় , খননের সাথে যুক্ত ৪৪ জন ব্যক্তির অধিকাংশই স্বাভাবিকভাবে এবং পরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা কোন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের মৃত্যুও ঘটেছে সমাধি খননের ১০ বছরের মধ্যে, তৎক্ষণাতই নয়।
সত্যি মিথ্যে এখনও প্রকাশিত না হলেও সম্রাট তুতেনখামেন এবং তাঁর অভিশাপ নিয়ে আজকের দিনেও মানুষের রয়েছে প্রবল আগ্রহ। গুজব না সত্যি সেটা হয়তো সময়ই বলে দেবে।