NEWS TUBE

ফজলুর রহমান খানঃ আকাশচুম্বি অট্টালিকা নির্মাণের পথিকৃৎ1 min read

জুলাই ৯, ২০২০ 4 min read

author:

ফজলুর রহমান খানঃ আকাশচুম্বি অট্টালিকা নির্মাণের পথিকৃৎ1 min read

Reading Time: 4 minutes

পৃথিবীর বুকে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অনেক স্কাইস্ক্র্যাপার বা আকাশচুম্বি অট্টালিকা। এসব সুউচ্চ ভবনকে কম খরচে টেকসই করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন একজন। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম ভবন ছিল সিয়ার্স টাওয়ার, মালিকানা পরিবর্তনে যার বর্তমান নাম উইলিস টাওয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে অবস্থিত ১১০তলা এই ভবনটিতে ব্যবহৃত “টিউব স্ট্রাকচার” সিস্টেমের রূপকারও ছিলেন তিনি। তাকে বলা হয় ‘কাঠামো প্রকৌশলের আইনস্টাইন’। বিশ্বখ্যাত এই স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার এবং আর্কিটেক্ট একজন বাংলাদেশী।  তাঁর নাম ফজলুর রহমান খান, বিশ্ব তাকে চেনে এফ.আর. খান নামে।

১৯২৯ সালের ৩ এপ্রিল মাদারীপুরের শিবচর থানার ভান্ডারীকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা খান বাহাদুর আব্দুর রহমান খান ছিলেন জগন্নাথ কলেজের এক সময়কার অধ্যক্ষ। ১৯৪৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। এরপর পড়াশোনার জন্য যান কলকাতায়। ১৯৪৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পুরকৌশল বিভাগে। ১৯৫০ সালে ফাইনাল পরীক্ষার সময় শুরু হয় দাঙ্গা। সমগ্র ভারতেই এই দাঙ্গার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ দেশে ফিরে আসতে হয় এফ.আর. খানকে।

এরপর বিশেষ বিবেচনায় ভর্তি হন ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, বর্তমান সময়ে যা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) নামে পরিচিত। আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের পরীক্ষা নেয়া হয়। ড. খান পুরকৌশলে বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সমাপ্ত করেন। দুর্দান্ত ফলাফলের সুবাদে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের শুরু হয়।

১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম ভবন ছিল সিয়ার্স টাওয়ার, মালিকানা পরিবর্তনে যার বর্তমান নাম উইলিস টাওয়ার। Photo: (Jason Reed /Reuters)

১৯৫২ সালে ড. খান ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের আরবানা-শেম্পেইনে অবস্থিত ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তী ৩ বছরে তিনি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং থিওরিটিক্যাল এন্ড এপ্লাইড মেকানিক্স এই দুইটি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এই সময়ে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপরে পিএইচডি ডিগ্রিও লাভ করেন এই মেধাবী প্রকৌশলী।

১৯৫৫ সালে তিনি আমেরিকার শিকাগো শহরের স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্কিডমোর ওয়িংস অ্যান্ড মেরিলে যোগ দেন। স্কিডমোরে এক বছর কাজ করার পর ১৯৫৬ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি। যোগ দেন আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পূর্বপদে। এরপর ১৯৫৭ সালে তিনি যোগ দেন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি উন্নয়ন সংস্থায় নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে।

তিনি অনুধাবন করেন এখানে থাকলে আর যাই হোক, যে স্বপ্ন তিনি লালন করে চলেছেন, তার বাস্তব প্রতিফলন কখনো দেখাতে পারবেন না। তাই ১৯৬০ সালে আবার আমেরিকার সেই স্থাপত্য সংস্থা স্কিডমোর ওয়িংস অ্যান্ড মেরিলের শিকাগো অফিসের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন।

দ্বিতীয় দফায় আমেরিকায় আসাটা যেন ফজলুর রহমান খানের জন্য ছিল স্বপ্নপূরণের সূচনা। এতদিন ধরে যে অদম্য বাসনা তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, সবটুকু ঢেলে দিয়ে এবার তিনি নিজেকে প্রমাণ করার যুদ্ধে নামেন। ড. খান ৬০ এবং ৭০ এর দশকে স্থাপত্যের জগতে সৃষ্টি করেন এক নতুন যুগের। গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে যেয়ে তিনি আকাশচুম্বী ভবন বানানোর নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং সফলও হন। তার যুগান্তকারী সেই আবিস্কারের নাম টিউবুলার বা নলাকৃতি বিন্যাস। ড. খানের আবিস্কৃত এই পদ্ধতি উঁচু দালান নির্মাণের ক্ষেত্রে অতীতের যেকোন তত্ত্বের চেয়ে ছিল সাশ্রয়ী এবং টেকসই।

১৯৬৮ সালে শিকাগো শহরে ড. খানের নকশায় নির্মিত হয় ১০০তলা বিশিষ্ট জন হেনকক সেন্টার।

১৯৬০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আকাশচুম্বী সুউচ্চ ভবনগুলো তার টিউব স্ট্রাকচারাল সিস্টেমকে অনুসরণ করেই বানানো। টিউব স্ট্রাকচার সিস্টেম ব্যবহার করে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, জিন মাও বিল্ডিং এর মতো জগদ্বিখ্যাত কাজ সম্পন্ন করা হয়। দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা তৈরীতেও তার থিওরী অনুসরন করা হয়েছে।

১৯৬৮ সালে শিকাগো শহরে ড. খানের নকশায় নির্মিত হয় ১০০তলা বিশিষ্ট জন হেনকক সেন্টার।  তৎকালীন সময়ে এটি ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উঁচু ভবন। সিয়ার্স টাওয়ারের কথা লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করা ১১০ তলা উঁচু সিয়ার্স টাওয়ারটি নকশা তৈরি করেন তিনি। টুইন টাওয়ার, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারকে পেছনে ফেলে টানা ২৫ বছর বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন ছিল এটি। মূলত এই ভবনই ড. খানকে বিশ্বজোড়া বিখ্যাত করে তোলে। এখনো সিয়ার্স টাওয়ারে ড. খানের সন্মানে নির্মিত একটি ফলক শোভা পাচ্ছে। ১৯৯৮ সালে সিয়ার্স টাওয়ারের পশ্চিম ও দক্ষিণ সড়কের নামকরণ করা হয় ‘ফজলুর আর. খান ওয়ে’।

সিয়ার্স টাওয়ারে ড. খানের সন্মানে নির্মিত একটি ফলক

সত্তর দশকে ড. খান কম্পিউটারের সাহায্যে জটিল নির্মাণের মডেল তৈরি করার একটি সফটওয়্যারের ধারণা সবার সামনে আনেন। নাম দেন “কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন”। তার অনুরোধে স্কিডমোর ওয়িংস অ্যান্ড মেরিল কোম্পানিটি মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে এটি তৈরির পেছনে।

সৌদি আরবের জেদ্দায় অবস্থিত কিং আব্দুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রূপকারও ছিলেন ক্ষণজন্মা প্রকৌশলী। আমেরিকার ইউনাইটেড স্টেটস অব এয়ারফোর্স একাডেমির নকশাও এফ.আর. খানের করা।

এফ.আর. খানের ঝুলিতে পুরস্কার আর সন্মাননা অগণিত। তিনি ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে আমেরিকার ‘নিউজ উইক’ ম্যাগাজিন তাকে শিল্প ও স্থাপত্যের ওপর প্রচ্ছদ কাহিনীতে মার্কিন স্থাপত্যের শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করে। এছাড়া ‘ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ড’ ম্যাগাজিন তাঁকে পাঁচবার (৬৫, ৬৮, ৭০, ৭১ এবং ৭৯ সাল) স্থাপত্য শিল্পে ‘সর্বোচ্চ অবদানকারী ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে ঘোষণা করে। মুসলিম স্থাপত্য শিল্পে তাঁর গবেষণা আর বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ‘আগা খান স্থাপত্য পুরষ্কার’ লাভ করেন।

১৯৯৯ সালে ড. খানের স্মরণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

এ ছাড়াও তিনি আন্তর্জাতিক গগনচুম্বী অট্টালিকা ও নগরায়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে তাঁর সম্মানে ‘ফজলুর রহমান খান আজীবন সম্মাননা পদক’ প্রদান করে প্রতিষ্ঠানটি। নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, লি হাই বিশ্ববিদ্যালয় ও সুইস ফেডারেল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে এফ আর খান অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে না থেকেও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন ড. খান৷ প্রবাসী বাঙ্গালীদের সাথে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গণসংযোগ এবং সাহায্য সংগ্রহে তিনি প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে  প্রবাসের বাঙালিদের নিয়ে তিনি একটা ফান্ড গঠন করেছিলেন। ড. খান প্রথম বাঙালি, যিনি মার্কিন সিনেটে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমনে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য।

ড. খানের মৃত্যুর ১৭ বছর পর ১৯৯৯ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়। একই বছর তার স্মরণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

১৯৮২ সনের ২৬শে মার্চ সৌদি আরবের জেদ্দায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন৷ মৃত্যুর পর তার দেহ আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং শিকাগোতে তাকে সমাহিত করা হয়।

এফ আর খান বলতেন, ‘মানুষ বাঁচে তার স্বপ্নের জন্য। মানুষ বাঁচে তার স্বপ্ন পূরণের জন্য। মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে কেউই চায় না। কিন্তু আমি মাতৃভূমি ছেড়েছি স্বপ্নকে বাঁচাতে।’ তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল।

লেখক- ঐশ্বর্য মীম 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *