ইতিহাস

প্রাচীন মিশরের সাত দেবতা1 min read

অক্টোবর ১৭, ২০১৯ 5 min read

author:

প্রাচীন মিশরের সাত দেবতা1 min read

Reading Time: 5 minutes

রহস্যের দেশ মিশর। যুগে যুগে এর পিরামিডফারাওয়ের গপ্পো নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। সত্যজিৎ রায় কিংবা সৈয়দ মুজতবা আলীসকলের লেখাতেই এককালের সমৃদ্ধ মিশরের আখ্যান উঠে এসেছে। সভ্যতার চরম শিখরে ওঠার কৌশল প্রথম রপ্ত করেছিল এই জাতি। তাদের শিল্প, নির্মাণ কৌশলের খুঁটিনাটি আজও রহস্য। 

মুজতবা আলীর মতেআজ যদি সেই ফারাওরা বেঁচে থাকতেন তবে তাঁর প্রতি জাগতো ভীতি। এই পিরামিড যে তৈরী করতে পেরেছে, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবার কল্পনাও তো মানুষ করতে পারে না।তবে পরাক্রমশালী এই ফারাওরাও কিন্তু ভয় পেতো দেবতাদের। প্রাচীন মিশরে শখানেক দেবতারউপদেবতার আরাধনা চলতো সারাবছর। তাদের সবার কথা বলতে গেলে রাত শেষ হওয়ার আশংকা আছে। তাই চলুন প্রধান জন সম্পর্কে জেনে নিই। 

আমুন-রা

আমুন এবং রা মূলত দুইজন দেবতা ছিলেন। মিশরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে দুই দেবতাকে এক করে আমুনরা ডাকা হয়। আমুন হলো থিবস শহরের প্রধান দেবতা, অনেকে একে গ্রিক দেবতা জিউসের সাথেও তুলনা দেন। বিশ্বাস করা হতো, আমুনের নির্দেশেই বায়ু প্রবাহিত হয়। আমুন দেখতে অনেকটা অভিজাত পরিবারের ছেলের মতো যার মাথায় হামানদিস্তা সদৃশ মুকুট আছে। এছাড়া তাকে রাজহংস বা মেষের মাধ্যমেও প্রকাশ করতো প্রাচীন মিশরীয় পুঁথিলেখকগণ। 

খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩৯১২৯২  অব্দি আমুনের আরধনা চলতো আঞ্চলিকভাবে। মিশরের রাজধানী থিবসে স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকেই সারাদেশে আমুনচর্চা শুরু হয়। মন্দির গুলোতে নতুন করে আমুনের মূর্তি গড়া হয়, পুরোহিতেরাও প্রচারে নামেন। আগে শাসক শ্রেণির দেবতা হিসেবে পরিগণিত হলেও, সেসময় আমুনের পূজা শুরু করে সাধারণেরাও। আমুন যেহেতু বাতাসের মতো অদৃশ্য বস্তুর নিয়ন্ত্রকঅতএব একে ডাকা হতোলুকানো ঈশ্বরনামে। যুদ্ধজয়ের জন্য মিশরীয়রা তার পুজো করতো। আমুনের স্ত্রী ছিল আমোউনেত। মিশরের লুক্সর আর কারনাকের মন্দিরে আমুনের দৃষ্টিনন্দন অসংখ্য মূর্তি দেখা যায়। 

দেবতা আমুন; Photo Source: Wikipedia

রা ছিলেন সূর্যের দেবতা। সূর্য বরাবরই নীলনদ তীরের মানুষের কাছে ছিল গুরুত্ববহ। মানুষের দেহে বাজপাখির মাথাএমনই ছিল রাএর বাহ্যিক আকৃতি। সেসময়ের লোকেরা ভাবতো ফারাওরা এই সূর্যদেবেরই অবতার। 

থিবসকে রাজধানী হিসেবে ঘোষণার পর এক করে দেয়া হয় দুই দেবতাকে। ফলে এর নাম হয় আমুনরা। সম্মিলিত শক্তির ফলে আরও গ্রহণযোগ্যতা পায় এই দেবতারা।

আনুবিস

মিশরীয় ইতিহাসে আনুবিসের প্রভাব অত্যন্ত গাঢ়। মমিফিকেশন দিয়েই তাবৎ দুনিয়াকে চমকে দিয়েছিল প্রাচীন মিশর। স্থাপত্যের সাথে যে রসায়নেও দক্ষতা ছিল মিশরীয়দেরএসবই তার প্রমাণ। মৃতদেহের সৎকারের জন্য পালিত আচার অনুষ্ঠানের দেবতা ছিল আনুবিস। শৃগাল বা শেয়ালের মুখ এবং মানবদেহের সমন্বিত রূপ এই দেবতা। আদ্যিকালে কবরস্থান বা মৃতদেহ সৎকারের স্থানে শেয়াল, নেকড়ে ঘুরতে দেখা যেতো প্রচুর। সম্ভবত তা থেকেই সেই ধারণার উত্থান। 

মৃতদেহ সংরক্ষণ করছে দেবতা আনুবিস; Photo Source: All that interesting

খ্রিস্টপূর্ব ২৫৭৫২১৩০ সাল পর্যন্ত গোটা দেশেই আনুবিসের প্রতি আনুগত্য বজায় ছিল। পরে মৃত্যু দেবতা হিসেবে আনুবিসের পদ চলে যায় অসিরিসের হাতে। পুরাণ অনুসারে, অসিরিসের দেহকে মমি করার মধ্য দিয়ে আনুবিস মমিশিল্পের দেবতা পদে অধিষ্ঠিত হয়। 

অসিরিস

অসিরিসের জীবনের দুটো অংশ। প্রথম ভাগে অসিরিস ছিল একজন মিশরীয় রাজা। রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে তারই ভাই সেথ এবং ইথিওপিয়ার রাণীর ষড়যন্ত্রে মারা পড়ে সে। সেথ ছলেবলে ভাইকে একটি কফিনে ঢুকিয়ে ডালা আটকে দেয় এবং নীলনদে নিক্ষেপ করে। অক্সিজেনের অভাবে অসিরিসের মৃত্যু হয়। তবে এতেই শেষ না। পরে অসিরিসের স্ত্রী আইসিস নীল নদের করাল স্রোত থেকে রক্ষা করে তাকে এবং ঈশ্বরের কাছে তার প্রাণভিক্ষা করে। আইসিসের একনিষ্ঠ সাধনায় অসিরিস পুনরুজ্জীবিত হয়। সেই ক্ষণকালের মিলনের ফলে জন্ম নেয় দেবতা হোরাস। এরপরেই অসিরিসকে পাতালের দেবতা পদে আসীন করা হয়। 

পরাক্রমশালি রাজাই একসময় পাতালের দেবতায় পরিণত হয়; Photo Source: Truth Theory

অসিরিসকে মমিকৃত রাজারূপেই সর্বত্র দেখা যায়। তবে মূর্তি, লিপি প্রভৃতিতে তার সবুজাভ চামড়া আর স্নিগ্ধসৌম্য মুখের উল্লেখ আছে। এছাড়াও মাথায় মুকুট হাতে শস্য মাড়াইয়ের ঝাড়াও বহন করে এই সাবেক রাজা। নীলনদ, উর্বরতা, মদ, কৃষিকাজ এবং পুনর্জন্মের দেবতা হিসেবে একে পূজা করতো প্রাচীন মিশরবাসী। 

আইসিস

অন্যদের থেকে আইসিস ব্যতিক্রম কারণ, এখনও মিশর, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এর পূজাআর্চনা এখনও চলে। গ্রিক মিথোলজিতেও আইসিসকে আফ্রোদিতির অনুসারী হিসেবে পাওয়া যায়। বহু গবেষণাবিদ আইসিস এবং পুত্র হোরাসের সাথে কুমারি মাতা মেরি যিশু খ্রিস্টের তুলনা দিয়েছেন।  

দেবী আইসিস-যার স্বামীর প্রতি প্রেম ও নিষ্ঠার ফলেই পুনর্জন্ম ঘটে অসিসের; Photo Source: Britannica

আইসিসকে খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮৬ সালের হায়রোগ্লিফিকে প্রথম পাওয়া যায়। মূলত স্বামী আইরিসকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো এবং পাতালপুরীর দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই খ্যাতি লাভ করে এই দেবী। পরবর্তীতে দেবতা হোরাসের মা এবং জাদুবিদ্যার দেবী হিসেবে অধিষ্ঠিত হয় আইসিস। এছাড়াও একে দেবতাদের মাতা হিসেবেও মানা হয়। অভিজাত নারী বেশেই তাকে দেখা যায় বিভিন্ন লিপিতে। 

থোত

জ্ঞান প্রজ্ঞার দেবতা থোত। অন্য দেবতাদের মতো বিধ্বংসী  ষড়যন্ত্রের শিকার ছিল না এই দেবতা। মানবদেহের উপর সারস সদৃশ আইবিস পাখির অথবা বেবুনের মাথা নিয়ে গঠিত মিশরীয় জ্ঞানের এই কাণ্ডারি। হায়রোগ্লিফিক লেখন পদ্ধতি আবিষ্কারের সাথে যুক্ত এই আছে এর নাম। সরাসরি ঈশ্বরের কাছ থেকে বাণী পেতো থোত আর তাই লিখে রাখতো নিজের ভাষায়। অন্যান্য দেবতা যেসব জাদুবিদ্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না, তাও ছিল থোতের কণ্ঠস্থ।

ঈশ্বরের পরম প্রিয় দেবতা থোতের উপর বর্তে ছিল এক বিশেষ দায়িত্ব। মৃত্যুর পর দেহ থেকে হৃদপিণ্ড বের করে তার পাপ পুণ্য পাল্লায় মাপতো এই দেবতা। সেই হিসাবের উপর ভিত্তি করেই শাস্তি বা পুনর্জন্মের ধরণ নির্ধারণ করতো দেবতা অসিরিস। নিজ গুণেই থোত এতদূর এসেছিল। বিশ্বব্রক্ষান্ড সুচারুভাবে পরিচালনা ছাড়াও গণিত, জাদুবিদ্যা, বিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, ভাষা, জ্যোতির্বিদ্যা  প্রভৃতিতেও পণ্ডিত এই থোত। ৩৬৫ দিনে বছর ধরে পঞ্জিকা উদ্ভাবনও করে সে। 

জ্ঞানের একচ্ছত্র আধার থোত; Photo Source: Pinterest

সেথ 

উৎশৃঙ্খল হিংস্র হিসেবে দুর্নাম আছে দেবতা সেথের। চরম বিশৃঙ্খলা , মরুকরণ ঝড়ের দেবতাও সে। আপন ভাই অসিরিসকে হত্যা করে মিশর দখলের পরিকল্পনা ছিল তার। পরবর্তীতে তা বিশাল যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।  

ধ্বংস ও হিংসার দেবতা সেথ

পুরাণমতে ভাই অসিরিসসহ অনেক দেবতারই মাথাব্যথার কারণ ছিল সেথ। তার ধ্বংসলীলায় বিরক্ত ছিল দেবরাজ্যের অধিকাংশ সদস্য। তেমনি একালের গবেষকেরাও বেশ নাকানি চুবানি খাচ্ছেন এই দুষ্ট দেবতার আকৃতি নিয়ে। সেথের দেহ মানুষের মতো হলেও মাথা ছিল কোন বন্য প্রাণির। তবে নির্দিষ্ট করে কোন প্রাণির সাথে এর সাদৃশ্য পাওয়া যায় নি। শূকরের মতো নাক, লম্বা কান, কিছু জায়গায় কুকুরের মতো সূচালো মুখের নিদর্শন মেলে। খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে থেকেই সেথকে বিভিন্ন লিপিতে পাওয়া যায়। 

হোরাস

মানুষের দেহে বাজপাখির মাথা জুড়ে নিলেই পাওয়া যায় দেবতা হোরাসকে। আকাশ, যুদ্ধ শিকারের এই দেবতার পিতা অসিরিস এবং মা আইসিস। সেথকে পরাভূত করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয় হোরাস।

হোরাসের চোখকে আরোগ্যের প্রতীক মানা হয়; Photo Source: Real from history

যুদ্ধক্ষেত্রে সেথের হাতে বাম চোখ হারালেও দেবতা থোতের সাহায্যে সেরে ওঠে তা। এর পেছনের গল্পটাও অপূর্ব। যুদ্ধে সেথ হোরাসের বাম চোখ উপড়ে নিয়ে তা ছয় ভাগে কেটে ফেলে। এই প্রতিটি ভাগের সাথে যুক্ত আছে সূর্য, নক্ষত্র চাঁদ সংশ্লিষ্ট মাপজোক। সেই মাপটি হলোপুরো চোখের ডান অংশের মান/চোখের বাম পাশের মান/১৬, চোখের তারার মান/, চোখের ভ্রুর মান/, প্রতীকের বাকানো মতো অংশের মান/৩২ এবং চোখ থেকে পড়া অশ্রু বিন্দুর মান/৬৪। 

এই অংশগুলোর মান যোগ করলে হয় ৬৩/৬৪। স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে, বাকি /৬৪ কোথায়? মনে করা হয়, এই হারানো একটা অংশ হলো দেবতা থোতের ঐশ্বরিক ক্ষমতা, যা অন্য কারুর নেই। আরেক মতানুসারে, এই অংশ দ্বারা বিশ্বজগতে ঈশ্বর ব্যতিত কোনো কিছুই যে নিখুঁত নয় তা নির্দেশ করা হয়।

এই সাত দেবতা বাদেও জেব, মুত, হাথোর, বাস্ত, বাবি, নুই, আতেন, খনসো প্রভৃতি দেবতার রহস্য রোমাঞ্চে পূর্ণ কাহিনি আছে মিশরীয় পুরাণে। এর কতকটা সত্য, কতকটা মনগড়া। তবে প্রাচীন মিশরের পথে পথে যে আজও রহস্যের হাতছানি পাওয়া যায়তা কিন্তু মিথ্যে নয়। 

লেখক- সারাহ তামান্না 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *