গত ৫ বছরে দেশে ফিরেছে ১৭ হাজার ৩০৩ জন প্রবাসী শ্রমিকের লাশ1 min read
Reading Time: 3 minutesবিখ্যাত অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক তৌকির আহমেদ তার “অজ্ঞাতনামা” চলচ্চিত্রে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীর লাশ দেশে ফেরা নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতা এবং ভুল ঠিকানায় পৌঁছানো লাশ নিয়ে তার পরিবারের দুর্বিষহ ভোগান্তির চিত্র তুলে এনেছিলেন। পরিচালক ও অভিনেতাদের গুণে আমরা অনেকেই কিছুক্ষণের জন্য হলেও মৃত প্রবাসী আসির উদ্দিনের পরিবারের দুঃখ কষ্ট কিছুটা অনুভব করেছি, আবেগ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। কিন্তু প্রতি বছর মধ্যপ্রাচ্য থেকে তিন হাজারের বেশি প্রবাসী শ্রমিকের লাশ যে দেশে ফেরে এই খবর কয়জনের জানা আছে?
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের প্রকাশ করা তথ্য থেকে দেখা যায় গত ৫ বছরে দেশে ফেরত আসা বৈধ প্রবাসী শ্রমিকদের মরদেহের সংখ্যা ১৭ হাজার ৩০৩। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৫ জন, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩০৭ জন, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৮১ জন, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৮৭ জন, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৭৯৩ জন শ্রমিক লাশ হয়ে দেশে ফেরেন।
সরকারি সূত্র বলছে বেশির ভাগ শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ বা স্ট্রোক। কিন্তু প্রবাসী এই শ্রমিকদের অধিকাংশের বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। এভাবে বছরের পর বছর কম বয়সী এত শ্রমিক মারা গেলেও তাদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা আমাদের চোখে পড়ে না।
একজন প্রবাসীর মৃত্যুর পর দেশে লাশ পাঠানো নিয়েও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। কখনো কখনো লাশ দেশে পাঠানোর জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। আমাদের দেশের শ্রমিকরা ঐ সব দেশের আইন সম্পর্কে জানেন না। বাংলাদেশী দূতাবাসগুলো শ্রমিকদের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ায় না এই অভিযোগ তো অনেক পুরনো। প্রবাসে লেবার উইং এর সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। বেশির ভাগ শ্রমিকের ক্ষেত্রেই চাঁদা তুলে লাশ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে বিমানবন্দর থেকে লাশ গ্রহণের সময় মৃতের পরিবার লাশ পরিবহণ ও দাফনের জন্য ৩৫ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা পান। ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল থেকে প্রবাসে মারা যাওয়া কর্মীর পরিবার ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান পান। কিন্তু এই টাকা যে সরকার নিজে থেকে দেয় ব্যাপারটি এমনও না। প্রত্যেক কর্মীকে বিদেশে যেতে হলে আবশ্যিকভাবে প্রবাসী কল্যাণ তহবিলে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে হয়। সেই তহবিল থেকেই মৃত প্রবাসীর পরিবারকে অনুদান দেওয়া হয়।
এছাড়া যেসব কর্মী বৈধভাবে বিদেশে কাজের জন্য যাবেন এবং ফিরে আসবেন তাদের ঋণ সহায়তা দেয়ার জন্য ২০১০ সালে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিল থেকে ৯৫ কোটি টাকা এবং সরকারের থেকে পাওয়া ৫ কোটি টাকা, মোট ১০০ কোটি টাকার তহবিল দিয়ে এই ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ব্যাংকের প্রবাসীদের পাশে সেভাবে দাঁড়ানোর নজির নেই।
বাংলাদেশের শ্রম রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শ্রমিক যান সৌদি আরব। ১৯৭৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈধভাবে সৌদি আরবে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ৩৬ লাখ ৫০ হাজার ৫৪৪ জন। একই সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বৈধভাবে গেছেন ২৩ লাখ ৬৮ হাজার ২২৭ জন, কুয়েত গেছেন ৬ লাখ ১৬ হাজার ৬৫১ জন, ওমান গেছেন ১৪ লাখ ২৮ হাজার ২১৬ জন, কাতার গেছেন ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯৮ জন।
২০০৮ সাল থেকে সৌদি আরবের শ্রম বাজার বাংলাদেশের জন্য বন্ধ ছিল। ৭ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সালে সৌদি আরব আবার নতুন করে বাংলাদেশী শ্রমিকদের নেয়া শুরু করে। সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে গৃহ খাতে শ্রমিক নিতে বাংলাদেশের সাথে চুক্তি করে সৌদি আরব। এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ২০১৬ সালে ৬৮ হাজার ২৮৬ জন, ২০১৭ সালে ৮৩ হাজার ৩৫৪ জন, ২০১৮ সালে ৭৩ হাজার ৭১৩ জন নারী শ্রমিক সৌদি আরব যান। কিন্তু এর ফলাফল হয় ভয়াবহ।
২০১৭ সাল থেকেই প্রায় প্রতি মাসেই সৌদি থেকে কিছু না কিছু নারী শ্রমিক ফিরে আসছেন। ফিরে আসা নারীদের মধ্যে যৌন নির্যাতনের কারণে অন্তঃসত্ত্বা নারী যেমন আছেন, তেমনি আছেন ভয়াবহ অত্যাচারে মানসিক ভারসাম্য হারানো নারীও।বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফিরে আসা নারীদের তাদের পরিবার গ্রহণ করতে চায় না। আবার অন্তঃসত্ত্বা নারীরা নিজে থেকেও পরিবারের কাছে যেতে চান না সামাজিক লজ্জার ভয়ে। সরকার থেকে তাদের পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানের জন্য নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ।
২০১১ সালে ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়টি দেশ সৌদি আরবে তাদের নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়। তাদের এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ ছিল নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এখনো আমাদের দেশের অনেক নারী অভাবের তাড়নায় সব জেনে শুনে বুঝেও সৌদির পথে পা বাড়াচ্ছেন। বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের ওপর এই ভয়াবহ অত্যাচার বন্ধ করতে বাংলাদেশ সরকারের কোনো প্রতিবাদ নেই। আমাদের দেশ থেকে কর্মী পাঠানো হয় এমওইউ-এর মাধ্যমে৷ তাই চাইলেও আইনি অধিকার অনেক সময় আদায় করা সম্ভব হয় না৷ সরকার শক্ত হয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে কর্মী পাঠালে অনেক সমস্যার সমাধান পাওয়া যেত৷
প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের জিডিপির ৭ শতাংশ এবং পোশাকশিল্পের পর আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত। ২০১৮ সালে তারা আমাদের পাঠিয়েছেন মোট ১ হাজার ৫৫৪ কোটি মার্কিন ডলার। আমরা যদি আরও বড় করে হিসেব করি তাহলে ১৯৭৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা।
এই হিসেব থেকে এটা বুঝতে কারো সমস্যা হওয়ার কথা না যে প্রবাসী শ্রমিকদের ঘাম ও রক্তে গড়া অর্থের বিনিময়েই আমাদের অর্থনীতির চাকা জোর গতিতে ছুটছে। কিন্তু তারা তাদের প্রাপ্য সন্মান, মর্যাদা কি পাচ্ছেন? আমরা কি শুধু রেমিট্যান্সটাই বুঝে নেবো? এতগুলো লাশের দায় নেবো না?
[তথ্যসূত্র- জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো]