খেলা

“পেলে” এক ফুটবল যাদুকরের গল্প।1 min read

নভেম্বর ১২, ২০১৯ 4 min read

author:

“পেলে” এক ফুটবল যাদুকরের গল্প।1 min read

Reading Time: 4 minutes
স্রষ্টা প্রদত্ত ভাগ্য নিয়ে অনেকেরই ভিন্ন মতবাদ রয়েছে। নিজের জীবনকে কেউ পুরোপুরি ভাবেই ভাগ্যের উপর সমর্পণ করে বসে, কেউ  আবার এমনটা বিশ্বাস করেন যে আত্ম চেষ্টায় ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব, কেউ কেউ আবার ভাগ্যের উপর বিন্দু মাত্র বিশ্বাস করতে রাজি নন। কিন্তু, জগৎের হাতে গোনা ক’জন কিংবদন্তীর সাফল্যের কথা আপনার সম্মুখে আনলে বোধহয় পুরোপুরি ভাবেই ভাগ্যে বিশ্বাসী হয়ে উঠবেন। এমন কিংবদন্তীদের একজনের নাম “এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু (Edson Arantes do Nascimento)।” ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েসে ১৯৪০ সালের ২১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। যাকে বলা হয় ফুটবলের রাজা বা যাদুকর। শুরুতেই বলে রাখা ভালো আজ যাকে আপনারা “পেলে” বলে চেনেন-জানেন ছোট বেলায় এটা তাঁর ব্যাঙ্গাত্মক নাম ছিল। তাঁর শৈশবের ডাক নাম “ডিকো”।
.
একদম নিন্মবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া পেলের ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো ব্রাজিলের জাতীয় দলের হয়ে খেলার। কিন্তু দারিদ্রতা যেন তাঁকে স্বপ্ন দেখতেও বারণ করতো। তাঁর মা-বাবা দু’জনেই বাহিরে কাজ করতেন। বাধ্য হয়ে মায়ের সঙ্গে মাঝে মধ্যে তাঁকেও ঘর মুছার কাজে যেতে হতো।
একটা মজার কাহিনী বলা যাক; ডিকো তাঁর মায়ের সাথে একদিন কাজে গিয়েছিল এক বড় লোকের বাড়িতে। কাজ করার  সময় বাড়ির মালিকের ছেলে ও বন্ধুদের মুখে শুনতে সে পায় সান্তোস ক্লাবে নতুন খেলোয়াড় নিচ্ছে। বাড়ির মালিকের ছেলে ও তাঁর বন্ধুদের এসব কথোপকথন খুব মন দিয়েই শুনছিল ডিকো। মালিকের ছেলে তখন বললো জানিস’ই তো আমি ইতালির মেজ্জোলার মত খেলি, আমি চান্স পাবোই। ঘড় মুছতে মুছতে ডিকো হুট করে বলে বসলো, আমি পেলের মত খেলি। ওরা তো হা করে তাকিয়ে থাকলো পেলেটা আবার কে ? যার নাম গন্ধ কখনো শুনিনি! ডিকোর তখন পেলেকে চিনিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা, ভাস্কদা যিনি গোলকিপার । সবাই তখন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসতে হাসতে শেষ। আরে গর্দভ উনার নাম তো বিলে, পেলে না। মালিকের ছেলের এক বন্ধু বলে উঠে চল ওর নাম পেলে রেখে দেই। ঠিক তখন থেকেই ডিকোর নাম হয়ে বসলো পেলে! যে নামে ডাকলে তাঁর প্রচুর মন খারাপ ও রাগ হতো। কিন্তু, তাঁর এই ব্যাঙ্গাত্মক নামটাই যে একদিন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে তা কেউ কি ভেবেছিলো তখন! সেই পেলেই কি না পরবর্তীতে হলেন ব্রাজিলের জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা ও তিনবার বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র ফুটবলার।
ফুটবল মাঠে এমন দুরন্ত পেলেকেই দেখতে পেত দর্শক
ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি বাড়তি আকর্ষণ ছিল পেলের। একটু সময় পেলেই পাড়ার ছেলেদের সাথে মেতে উঠতো ফুটবলে। একটা সময় পড়াশুনার পাশাপাশি বাড়তি ইনকামের জন্য জুতা সেলাই ও জুতাতে কালি করার কাজও পর্যন্ত তাঁকে করতে হয়েছে। তবে এমনটা ভাবার সুযোগ ছিলোনা যে আমাকে কেনো এসব কাজ করতে হচ্ছে। কারণ, তাঁর বাস্তবতাটাই ছিলো ওরকম। কিন্তু, দারিদ্রতা কি আর তাঁকে ফুটবল থেকে আটকে রাখার ক্ষমতা রাখে? জুতা সিলাইয়ের কাজ বাদ দিয়েই মাঝে মাঝে ফুটবলে মেতে উঠতো সে।
তবে পেলের মা অবশ্য একদমই পছন্দ করতেন না এসব। একদিকে দারিদ্রতা অন্যদিকে পেলের বাবার অতীতের হৃদয়বিদারক স্মৃতি তাঁর মাকেও যে বেশ কষ্ট দিতো। পেলের বাবাও একজন ফুটবলার ছিলেন, কিন্তু বার বার ইনজুরিতে পরার কারনে তাঁর আর সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, ইনজুরির কারণেই তাঁর ক্যারিয়ারটাই নষ্ট হয়ে যায়। সঙ্গত কারণেই পেলের পরিবারে আর্থিক সমস্যাটা আরও বেশি দেখা দিয়েছিল। তাই ফুটবল নিয়ে পেলের অনেক বড় স্বপ্ন থাকলেও পরিবার থেকে কোনো আর্থিক সাপোর্ট পাচ্ছিলোনা সে।
.
পেলের বয়স যখন আনুমানিক ১১ বছর তখন পেলেদের পাড়ার টিমের সাথে স্থানীয় একটি ক্লাবের অনুর্ধ ১৬ টিমের খেলা হয়েছিলো। মজার ব্যাপার হলো বিপক্ষ ক্লাবটিতে ছিলো সেই মালিকের ছেলে। বিপক্ষ দলের কোচ, শৃঙ্খলা, খেলার যাবতীয় পোশাক সব থাকলেও জুতা-মোজা হীন পেলেদের কাছে স্থানীয় ফুটবল ক্লাবটি সেদিন ৫-৬ গোলে হেরে গিয়েছিলো। সেদিনই পেলে তাঁর ফুটবলের নিখুঁত নৈপুণ্যতা দেখিয়ে মুগ্ধ করেছিলো সবাইকে। মূলত এখান থেকেই পেলেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মাঠের সব সব দর্শক তখন পেলে পেলে বলে স্লোগান দিতে শুরু করে, আর সেখান থেকেই পেলে নামটা অফিশিয়াল নাম হওয়া শুরু করে। সেখান থেকে তাঁর বাবাই তাঁর ফুটবলের প্রশিক্ষক হয়ে উঠে। কখনো ফুটবল আর কখনো বা আপেল দিয়ে পেলেকে শৈল্পিক ফুটবল শেখানোর চেষ্টা করতো তাঁর বাবা। এর কিছু বছর পর ক্লাব সান্তোস ও পরবর্তীতে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয় পেলের। মজার ব্যাপার হলো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষেই তাঁর আন্তর্জাতিক অবিষেক হয় (১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই)। মারাকানায় অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে ব্রাজিল হারে ২-১ গোলে। যদিও সেই ম্যাচে ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে ব্রাজিলের হয়ে প্রথম গোল করে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতার নাম লিখিয়ে ফেলেন পেলে।
বিশ্বকাপের শিরোপা হাতে তিনবারের বিশ্বকাপ জয়ী পেলে
.
১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপে পেলের পায়ের ছন্দে এবং পুরোনো সেই জিঙ্গা স্টাইলে কুপোকাত হয়ে বসে সেই সময়ের শক্তিশালী দল সুইডেন। ইতিহাস গড়ে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি ঘরে তুলে নেয় ব্রাজিল। সেই সঙ্গে বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে আট বছর আগে পেলে তাঁর বাবাকে দেওয়া কথা রাখে। গোটা ব্রাজিলের জন্য এক অনন্ত আক্ষেপের নাম ১৯৫০ বিশ্বকাপ। নিজেদের মাঠে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ব্রাজিল হেরে গিয়েছিলো উরুগুয়ের কাছে। মারাকানার সেই স্বপ্নভঙ্গ এখনো ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে ঘটায় রক্তক্ষরণ। ‘মারাকানাজো’ নামে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া সেই ট্র্যাজেডির সময় পেলের বয়স ছিল ১০ বছর। ফুটবলার বাবার অসহায়ত্বের কান্না দেখে পেলে তখন বলেছিল; “আমি বিশ্বকাপ এনে দিবো, তোমাকে কথা দিলাম”।  মূল কথা জীবন যখন সিনেমাকেও হার মানায় তখন জীবনটাও শৈল্পিকভাবে এগুতে থাকে। স্রষ্টা ব্যতিত তখন কেউ আর আটকে রাখার ক্ষমতা রাখেনা।
বলে রাখা ভালো; ১৯৫৮ ফিফা বিশ্বকাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে পেলে তাঁর প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলেন। প্রথম রাউন্ডের সেই ম্যাচটা ছিল প্রতিযোগিতার তৃতীয় খেলা। সেই বিশ্বকাপের  সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় পেলের সতীর্থ ছিলেন গ্যারিঞ্চা, যিতো এবং ভাভা। ওয়েলসের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে করা গোলটি ছিল প্রতিযোগিতায় পেলের প্রথম এবং সেই ম্যাচের একমাত্র গোল, যার সাহায্যে ব্রাজিল সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয়। ম্যাচের সময় পেলের বয়স ছিল ১৭ বছর ২৩৯ দিন, বিশ্বকাপের গোলদাতাদের মধ্যে সবচেয়ে কম।
.
ব্রাজিলের হয়ে তিনি ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৭০ সালে মোট ৪টি বিশ্বকাপ খেলার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৬৬ সাল বাদে বাকী ৩টি বিশ্বকাপ তাঁর হাত ধরেই জয় পায় ব্রাজিল। জাতীয় দলের হয়ে ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল (বিশ্বকাপে ১২ গোল), লীগ ম্যাচে ৬৯৪ ম্যাচে ৬৫০ গোল, সর্বমোট ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮১ গোল করেন তিনি।
.
ফুটবল কিংবদন্তী পেলের শৈশব থেকে এখন অবধি লিখে শেষ করা মোটেও সম্ভব নয়। আপনারা যারা পেলে সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য এবং তাঁর অমানবিক শৈশব ও আশাজাগানিয়া কৈশোরের চমকপ্রদ সব তথ্য জানতে চান তাঁরা অবশ্যই Pelé: Birth of a Legend (2016) এই মুভিটি দেখে নিবেন।

লেখক- আলী রেজা রাজু

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *